শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৮:৫২ পূর্বাহ্ন

নস্টালজিয়া নামের এক রোগ যেভাবে এখন একটি আবেগের নাম

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ৭.০৩ পিএম

‘নস্টালজিয়া’ শব্দটি দিয়ে এমন এক আবেগ বোঝায় যা মানুষকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে, প্ররোচিত বা প্রলুব্ধ করে। কিন্তু এর সঙ্গে কিছুটা দুর্নামও জড়িয়ে গেছে।

এটা হয়েছে বিশেষ করে রাজনীতি ও সমাজে শব্দটির সাম্প্রতিক ব্যবহারের কারণে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বোঝাতে অনেকে উদাহরণ দিয়ে থাকেন ব্রেক্সিটের। ব্রিটেন তার অতীতের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয় বলে দাবি তাদের।

‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা ‘আমেরিকাকে আবারও মহান বানাও’– ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই স্লোগানটিকেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের নস্টালজিয়ার অন্যতম উদাহরণ বিবেচনা করা হয়।

ইদানিং নস্টালজিয়া বিষয়টির রাজনৈতিক ব্যবহার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, তবে এর আগে ‘আবেগ’ হিসেবে এর দীর্ঘ ও আলোড়িত করার মতো ইতিহাস রয়েছে।

‘ন’নস্টালজিয়া: এক বিপজ্জনক আবেগের ইতিহাস’ বইটির লেখক বলছেন, বই লেখার সময় তিনি আবিষ্কার করেছেন যে কিছু অনুভূতি বিস্তৃত হলেও এগুলোকে নস্টালজিয়া বলে চাপিয়ে দেয়াটা কঠিন।

এর একটি কারণ হতে পারে যে গত তিন শতাব্দীতে অন্যান্য আবেগের মধ্যে যদি কোনোটার আমূল রূপান্তর ঘটে থাকে, তা হলো নস্টালজিয়া।

মাত্র একশ বছর আগেই এটি কেবল কোনো আবেগ ছিল না, বরং রোগ হিসেবে বিবেচিত ছিল।

সুইজারল্যান্ডে প্রথম নস্টালজিয়াকে চিহ্নিত করা হয়, আর দেশটির  চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এর জন্য দায়ী করা হয়
সুইজারল্যান্ডে প্রথম নস্টালজিয়াকে চিহ্নিত করা হয়, আর দেশটির চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এর জন্য দায়ী করা হয়

উৎপত্তি ও বিবর্তন

প্রথমবারের মতো ১৬৮৮ সালে নস্টালজিয়া টার্মটি (রোগ নির্ণয়ে) ব্যবহার করেন সুইস চিকিৎসক জোহানেস হোফার।

গ্রীক শব্দ নস্টোস (বাড়িতে ফেরা) ও অ্যালগোস (ব্যথা) থেকে উদ্ভূত এই রহস্যময় অসুস্থতাকে নস্টালজিয়া রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রোগীদের মধ্যে এটি আলস্য, বিষণ্নতা ও বিভ্রান্তির মতো মানসিক পরিবর্তন ঘটাতো।

হৃদস্পন্দন, চামড়ায় ঘা এবং ঘুমে ব্যাঘাতের মতো কিছু শারীরিক উপসর্গও দেখা দিতো অনেক সময়।

এটিকে গুরুতর রোগ বলে ধরা হতো যার চিকিৎসা করা কঠিন, আর নিরাময় ছিল প্রায় অসম্ভব।

কোনো কোনো রোগীর জন্য এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতো এবং না খেতে খেতে অনেকে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়তো।

প্রথমবার সুইজারল্যান্ডে শনাক্ত হওয়ায় এটিকে সেখানকার রোগ বলেই মনে করা হতো।

দেশটি এতটাই সুন্দর, আর এর বাতাসও এতোই পরিশোধিত ছিল যে এটি ছেড়ে যাওয়ার কারণে যে কারো মধ্যেই বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টির ঝুঁকি ছিল বলে মনে করা হতো।

এক্ষেত্রে ছাত্র ও গৃহকর্মীদের বিশেষ রকমের দুর্বল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে যারা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এবং ফেরাটাও যাদের জন্য কঠিন ছিল।

নস্টালজিয়া প্রথমে আল্পস পর্বতমালা এলাকায় দেখা দিলেও শিগগিরই তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মানসিক এই মহামারীর সর্বোচ্চ প্রকোপ দেখা যেত শরৎকালে। এসময় ঝরে পড়া পাতা সময়ের বয়ে চলা ও নশ্বর জীবনের চিন্তাকে প্ররোচিত করে বিষাদকে উসকে দিতো।

সাম্প্রতিক শতাব্দীতে 'রোগ' থেকে মুক্তি পেয়ে ‘আবেগের’ স্বীকৃতি পেয়েছে নস্টালজিয়া
সাম্প্রতিক শতাব্দীতে ‘রোগ’ থেকে মুক্তি পেয়ে ‘আবেগের’ স্বীকৃতি পেয়েছে নস্টালজিয়া

ইংল্যান্ডের উত্তরে একটি ব্যারাকে কর্মরত ডাক্তার রবার্ট হ্যামিল্টন ১৭৮১ সালে উদ্বেগজনক হোমসিকনেসে (ঘরে ফেরার জন্য বিচলিত) আক্রান্ত এক রোগী পান।

কিছুদিন আগেই রেজিমেন্টে যোগ দেয়া ওই সৈনিককে তার ক্যাপ্টেন হ্যামিল্টনের কাছে পাঠান। মাত্র কয়েক মাস ব্যারাকে থাকা ওই সৈনিক তরুণ, সুদর্শন ও ‘কাজের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত’ ছিল।

কিন্তু তার ‘মুখে ছিল বিষণ্ণতা আর গালে ছিল ফ্যাকাশে ভাব’।

ওই সৈনিক ‘সাধারণ কিছু দুর্বলতার’ কথা জানান। যেমন তার কাওেন ঘণ্টার মতো শব্দ অনবরত বাজতো এবং মাথা ঘোরাতো। তার ঘুম হতো না এবং তিনি কিছু খেতে বা পান করতে পারতেন না।

গভীরভাবে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন এবং তার মনে হতো বুক ভারী হয়ে আসছে।

কোনো চিকিৎসায়ই কাজ না হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী থাকার পর তিনি আরও ক্ষীণকায় হয়ে যান।

সবচেয়ে খারাপ পরিণতির আশঙ্কা করে হ্যামিল্টন ধরে নিয়েছিলেন যে ওই সৈনিক আর কখনোই সুস্থ হবেন না।

একদিন সকালে একজন নার্স হ্যামিল্টনকে জানান, ওই সৈনিক তার বাড়ি ও বন্ধুদের নিয়ে ঘোরের মতো করে প্রলাপ বকছেন।

হাসপাতালে আসার পর থেকেই ওই যুবক বারবার তার বাড়ি ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। অসুস্থ যুবককে দেখতে গিয়ে হ্যামিল্টন তাকে তার নিজ এলাকা ওয়েলস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন।

সৈনিকটি উৎসাহের সঙ্গে সাড়া দিয়ে সমৃদ্ধ ওয়েলশ উপত্যকা নিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। তিনি এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে তার গল্প থামছিলই না।

হ্যামিল্টনকে ওই সৈনিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাকে বাড়ি যেতে দেওয়া হবে কিনা। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে ছয় সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি ফিরতে পারবেন বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দেন ওই চিকিৎসক।

নিছক বাড়ি ফেরার চিন্তা থেকেই ওই রোগী পুনরুজ্জীবিত বোধ করেন। অনেকটাই সুস্থ হয়ে প্রফুল্ল পদক্ষেপে ওয়েলসের উদ্দেশে রওনা দেন।

নস্টালজিয়াকে ধরা হয় মানুষের একটি আবেগ হিসেবে
নস্টালজিয়াকে ধরা হয় মানুষের একটি আবেগ হিসেবে

পরিবর্তন

নস্টালজিয়া ইউরোপ থেকে এরপর পাড়ি জমায় উত্তর আমেরিকায়। আফ্রিকান ক্রীতদাসদের জাহাজে করে ইউরোপ থেকে নেওয়া হতো উত্তর আমেরিকায়, সঙ্গে ছিল নস্টালজিয়াও।

আবেগটির ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত ভাবনাগুলোকে আশকারা দেওয়ার যে প্রবণতা আছে বলে মনে করা হয়, তখন এরকম ছিল না বিষয়টা। বরং কাউকে হত্যা বা আঘাত করে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো মানসিক প্রবৃত্তিকেও নস্টালজিয়ার অংশ মনে করা হতো।

এমনকি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় লড়াইয়ের বাইরে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এটি।

হোমসিকনেসের রেকর্ডকৃত সবশেষ শিকার ছিলেন ১৯১৭ সালে পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধরত একজন পদাতিক সৈনিক।

তবে বিশ শতকে এসে নস্টালজিয়ার ধারণা বদলে যায়। এটি হোমসিকনেস বা গৃহকাতরতা থেকে আলাদা করা হয়। প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি এবং পরে আমাদের আজকের পরিচিত আবেগ হিসেবে এটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

প্রথমদিকে মনোবিশ্লেষকরা নস্টালজিয়া এবং নস্টালজিয়াপ্রবণ মানুষদের সম্পর্কে ম্লান দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন। কারণ তাদের বাতিকগ্রস্ত, পশ্চাতমুখী, অত্যধিক আবেগপ্রবণ এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হতে অক্ষম বলে মনে করা হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নস্টালজিয়ার অংশ বিবেচনা করে দেশপ্রেমের অনুভূতিটি নিয়েও সন্দেহ করা হতো।

নাক উঁচু কিছু মনোবিশ্লেষক সেসময় লিখেছেন, “কেন দুর্বিষহ অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা কোনো পুরনো একটি দেশ নস্টালজিয়ায় আক্রান্তদের জন্য একটি কল্পনার রাজ্যে পরিণত হবে?”

তাদের ধারণা ছিল, বিশ্বজনীন অভিজাতদের চেয়ে ‘নিম্ন শ্রেণির’ মানুষের মধ্যেই নস্টালজিয়া বেশি প্রকট ছিল।

পরবর্তী সময়ে থেরাপিস্ট বা মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণা আর না থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনায় নস্টালজিয়া বেশ প্রচলিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজের ওপর প্রভাব হিসেবে নস্টালজিয়ার খ্যাতি আজ খুব একটা মধুর নয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালে দুটি প্রধান নির্বাচনের ব্যাখ্যা হিসাবে নস্টালজিয়ার কথা বলা হয়, একটি ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতি হওয়া এবং আরেকটি ছিল ব্রেক্সিট ভোট।

কিন্তু সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা যখন বিপর্যয়কর ভূ-রাজনৈতিক মুহূর্তগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য নস্টালজিয়া শব্দটির ব্যবহার করেন, প্রায়শই তারা আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর বা অযৌক্তিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য এটিকে এক ধরনের নির্ণায়ক হিসেবে দেখেন।

ব্রেক্সিটের কথা উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ রবার্ট সন্ডার্স যেমন ব্রিটেনের ছেড়ে আসার জন্য ভোটের বিতর্কটিকে “একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি: যুক্তি দিয়ে এর সমাধান নয়, বরং এর চিকিৎসা প্রয়োজন” বলে চিহ্নিত করেছেন।

নস্টালজিয়া বর্তমানে কোনো রোগ হিসেবে চিহ্নিত না হলেও এনিয়ে পুরনো সব চিন্তা মুছে যায়নি। অনেকের কাছেই এটি কিছু মানুষের কম প্রগতিশীলতা ও আরও অযৌক্তিক রাজনৈতিক পছন্দের ব্যাখ্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

মারাত্মক না হলেও এটি এখনও এক বিপজ্জনক আবেগ।

* *অ্যাগনেস আর্নল্ড-ফরস্টার এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্কটল্যান্ড) মেডিসিন, ইমোশনস অ্যান্ড মডার্ন ব্রিটিশ হিস্টোরির একজন গবেষক।

মূল নিবন্ধটি দ্য কনভার্সেশনে প্রকাশিত হয়েছিল এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে এটি ভাষান্তর কর আবারও প্রকাশ করা হয়েছে।

বিবিসি বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024