শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:১২ অপরাহ্ন

জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মহান ভাষা আন্দোলন

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ২.০৭ পিএম

শান্তা মারিয়া

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বাঙালি জাতির কৃতী সন্তান হলেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না কে ছিলেন তিনি, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে কী ছিল তাঁর ভূমিকা।
১৯৪৭ সালে দেশ—বিভাগের আগেই নতুন গঠিত হতে যাওয়া রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শুরু হয় আলোচনা।
ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম যতই দানা বাঁধছিল ততোই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে প্রশ্নটিও উত্থাপিত হচ্ছিল। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সুনিশ্চিত হয়ে যায় তখন থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে নিয়ে পণ্ডিত মহলে ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন হিন্দি যেমন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে তেমনি উর্দুকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

এর দাঁতভাঙা জবাব দেন বাঙালি ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এটি বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধী এবং স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতিরও পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ের শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দুভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিত বটে।’

১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমরেড পত্রিকায় ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম নামে এক প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁর এই প্রবন্ধটি ছাত্রজনতার মধ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।

সেসময়ই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।’ আরেকটি প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে বলেন ‘ইহা জ্যামিতির স্বীকৃত বিষয়ের ন্যায় স্বতঃসিদ্ধ। উন্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিতে পারে না’।
১৯৪৭ সালের ১৪—১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর পর পরই রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্রের উদ্যোগে তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন নূরুল হক ভুঁইয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম।

সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে তমুদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এর শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ এই পুস্তিকাটিতে শিক্ষার বাহন, অফিস, আদালত ও সরকারী কাজকর্মে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার দাবি তুলে ধরা হয়। তমুদ্দুন মজলিসের এই ছোট্ট বইটি ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।
ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন , অধ্যাপক আবুল কাশেমসহ শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলার সপক্ষে যুক্তি দিতে থাকেন। তমুদ্দুন মজলিসের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক কর্মী জড়িত ছিলেন। বামপন্থী এই ছাত্রনেতারা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের মধ্যে ছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার, নাদেরা বেগম, মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ, আবদুল মতিন, মমতাজ বেগম, গাজীউল হক প্রমুখ।

এদিকে উর্দুভাষাকে বাংলার উপর চাপিয়ে দেয়ার পক্ষেও কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের সেসময়কার কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাবিদদের নিয়ে এ সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের আসল উদ্দেশ্য ছিল উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তানের প্রাদেশিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাপিয়ে দেওয়া। বাংলার বিপক্ষে এই শিক্ষা সম্মেলন ছিল বেশ জটিল একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে(পূর্ব পাকিস্তানসহ) শিক্ষার মাধ্যম ঘোষণা করা হয়। তার মানে বাংলাদেশের স্কুলে কলেজে সর্বত্র উর্দু ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই অযৌক্তিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণ। এই সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ভাষা আন্দোলনে দার্শনিকের ভূমিকা পালন করেন।
শহীদুল্লাহকে অগ্রাহ্য করা তখন পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ছিল চরম অসুবিধাজনক কারণ তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল প্রবাদপ্রতীম। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি ১৮টি ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন (এই ভাষাগুলোতে তিনি রীতিমতো পণ্ডিত ছিলেন), ২৭টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন (তার মানে ২৭টি ভাষায় কথা বলতে, পড়তে, লিখতে জানতেন) এবং ৪০টি ভাষা সম্পর্কে তাঁর পড়াশোনা ছিল। তিনি সংস্কৃত, প্রাচীন পাহ্লবী, আরবী, হিব্রু, খোতনি, তিব্বতি, পালি ইত্যাদি ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে এবং চর্যাপদ নিয়ে মূল গবেষণা করেছিলেন। তাঁর মতে বাংলাভাষার উৎপত্তি হলো গৌড়ীয় বা মাগধী প্রাকৃত থেকে। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা নয়, তবে নিকট আত্মীয়।
তিনি মনে করেন বাংলা ভাষার উৎপত্তি কাল সপ্তম শতাব্দি। তাঁর পাণ্ডিত্যের মূল বিষয় ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত ইত্যাদি তার অমর অবদান। তিনি উর্দু অভিধানও প্রণয়ন করেছেন এবং শ্রীলংকার ভাষার উৎপত্তিও নির্ধারণ করেছেন।
তিনি ১৮টি ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও গভীরভাবে ভালোবাসতেন বাংলাভাষাকে।
তাই তিনি যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একের পর এক যুক্তি উপস্থাপন করতে লাগলেন তখন তা প্রতিবাদী ছাত্র জনতার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ালো। তিনি পাকিস্তান সরকারের সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে তার সংগ্রাম চালিয়ে যান।
তিনি ভাষাআন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের জন্য ছিলেন প্রধান প্রেরণা। একুশে ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করেন। তাঁর দুই পুত্র মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ও মুর্তজা বশীর দুজনেই ভাষা সৈনিক ছিলেন। কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ছিলেন ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও কর্মী। আর মুর্তজা বশীর ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের(তকীয়ূল্লাহ তখন জেলখানায় রাজবন্দী ছিলেন) অন্যতম প্রধান কর্মী।
১৯৪৮ এবং ১৯৫২ দুটি পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মী ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, রফিকুল ইসলাম, মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ, গাজীউল হক, মুর্তজা বশীর, নাদেরা বেগম, হালিমা খাতুন প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শহীদুল্লাহ এই আন্দোলনের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যান।
১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে শহীদুল্লাহর জন্ম এবং ১৯৬৯ সালে ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কাছে মুসা খান মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তার অন্তিম শয্যার স্থান। এর পাশের ছাত্রাবাসটির নামকরণও হয় তাঁর নামে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর প্রিয় কর্মস্থল, যেখানে ছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা, যার অদূরে রয়েছে তাঁর মানস প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি এবং যার কাছেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার সেই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাঙালি জাতির এই কৃতী সন্তান।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অমর উক্তি, মাতা মাতৃভাষা মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024