শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০২:১২ অপরাহ্ন

কেউ কি আছে

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ৩.০০ পিএম

দিলরুবা আহমেদ

মিমি সুপার মার্কেটে যাওয়ার প্লেন-টা মাসীর ,মানে খালার। দু’দিন না যেতেই তারও মাসী আসছে মুখে। যে যেখানে থাকে সেরকমই কি আসলে হয়ে যায়! গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে তো মাসী শুনছে, নিজেরও অজান্তে এখন তাই ডেকে উঠেছে।

মাসী খুশি হয়ে বললেন,

যেটা ভালো লাগে তাই ডাক, মাসী পিসী খালা ফুফু, সবই এক।

শাপলা খেয়াল করেছে মাসী খুব পরিষ্কার ভাবে কথা বলেন। যে জানে না সে ভেবে বসবে উনি বোধ হয় কলেজের প্রফেসর। আসলে গৃহবধু। সুগৃহিনী। বিশাল একটা পরিবার তার শ্বশুর বাড়ির, দুই হাতে সামলাচ্ছেন। অনেকবার বললেন, দেখ না আমাদের দেবীর কতগুলো হাত। মেয়েদের এরকম ভাবেই সব সামলাতে হয়। এখন ওনার উদ্দেশ্য হচ্ছে দু’জনকে দুটো শাড়ি বা জামা কিনে দেওয়া। প্রথমে নিয়ে গিয়েছিলেন নিউমার্কেটে। চট্টগ্রামের নিউমার্কেটটা দারুন। তিন কি চার তলা। কি সুন্দর রাস্তার মতন করে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে সিড়ি। এটাকে কি সিড়ি বলে!! মনে হয় ঘুরে ঘুরে চারতলা পর্যন্ত একটা রাস্তাই যেন উঠে গেছে। এই এত বছরের পুরাতন মার্কেটে এসকেলটরও আছে, আশ্চর্য্য। যাই হোক ঐ মার্কেট ঘুরে তারপরে আসা হয়েছে এই মিমি সুপার মার্কেটে। এখানে পছন্দ না হলে যেতে হবে সেন্ট্রাল প্লাজা। নাহ ,এখান থেকেই একটা কিছু কিনে ফেলতে হবে। শাড়ি জামা যাই হোক কিনে ফেলবে। দ্রাবিড়া’দি ধীর গতিতে শাড়ি পছন্দ করছেন। শাপলার অবশ্য মনে হচ্ছে উনি মানুষ পছন্দ করতে এসেছেন। ঘুরে ঘুরে, ফিরে ফিরে সবার মুখ দেখছেন। এদিক ওদিক বসে থাকা ছড়িয়ে থাকা রাস্তার দরিদ্র মানুষগুলো তার বিশেষভাবে দর্শনের বিষয়। সবাইকে দেখছেন। চোখ দিয়ে গিলে খাবেন যেন। শাপলা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো গোপনে। যার দুঃখ সে বুঝে। অন্য সে, কিভাবে বুঝবে। নিউমার্কেটে যাবার আগেই বলেছিল,

চল না মাসী পটিয়ায় নানার পুরানো বাড়িটাতে যাই।

মাসী সাথে সাথে বললেন,

ওখানে এখন কেউ নেই রে। কয়েকটা পুরানো নারিকেল গাছ আছে। কোন গাছের নিচে কেও তোকে ফেলে গেলেও গাছগুলো সে ইতিহাস এখন আর বলতে পারবে না।

না আমি এমনি এমনি বলছিলাম।

এমনি এমনি না, কারণে কারণে বলছিস। আর শোন কতবার বলবো তোকে যে, তোর মা যেদিন তোর ঐ  মুসলমান বাবার সাথে চলে গিয়েছিল এরপর তো আর কোনদিন আমাদের কাছে আসেনি। আমরা কেওই কিছু জানি না। এই একটা দিকে তোকে খুজতে হবে না। আমরা কেও তোর অতীত ইতিহাস জানি না।

ও।

হ্যাঁ তাই। আমার বোনকে তুই মা ডাকতি, তোর জন্য আমারও তাই কিছু মমতা আছে। তার দোহাই দিয়ে বলছি এদিকে আমরা কেউ কিছু জানি না। আর তুইও থেমে যা। ভগবানের দোহাই লাগে থেমে যা।

আচ্ছা।

বলছিলেন উনি আচ্ছা, কিন্তু দ্রাবিড়া’দির দুচোখ বলছে উনি খুজে বেড়াচ্ছেন। উনি কি বাকিটা জীবনই দু’জন মানুষকে খুজবেন! কে জানে! কে কিভাবে এসেছে এই দুনিয়ায় সেটা মনে হয় সবাই জানতে চায়। আর ওনার   ক্ষেত্রে  ধর্মেই শুধু আলাদা নয় দেশও আলাদা। ওনার চারদিকে কত অজানারে!

মিমি সুপার মার্কেট থেকে খুবই কম পছন্দ হওয়া দুটো শাড়ি দুজনে নিয়ে নিলো। একই রকম এবং এ-টাই একমাত্র ভালো দিক। দু’জনে একই রকম শাড়ি পরে আজ বিকেলে সী-বিচে যাবে। ভুতুম ভাইকে পাওয়া গেছে। উনি আসবেন গাড়ি নিয়ে। ভুতুম ভাইয়ের সাথে যাবে শুনে খালার আদি বুড়ী শ্বাশুড়ী ভ্র-কুচকে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, কোথাকার কোন এক অচেনা ছেলের সাথে যেতে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে বড় বৌ। খালা কিছু বললেন না প্রথমে। তারপরে বললেন, শাপলার আত্মীয়। বুড়ী এরপরে বলল, তোমার বোনের আপন মেয়ে হলে হয়তো তুমিই যেতে দিতে না। খালা এখনও বুড়ীর মতন প্রায় অন্ধ হয়ে উঠেননি। চোখে দেখেন। দেখতে পাচ্ছেন সে দাড়িয়ে রয়েছে সামনেই। ভাগ্যিস দ্রাবিড়া’দি ছিল না। উঁনি তখন আপন মনে ঐ সাড়ে তিন না আড়াই তলা উপরের ঘরটায় ল্যাপটপে আর্যদার সাথে চ্যাট করছেন। আর্য’দা সম্ভবত ওনার মান অভিমান অনেকটা ভাঙ্গাতে পেরেছেন। ফেইসবুকে আর ফোনে ৫০০ ম্যাসেজ দেওয়ার পর আজ সকাল থেকে চ্যাটচ্যটি শুরু হয়েছে। ভালো ভালো। খুবই ভালো। মিল হলেই ভালো। যে বিয়ের আয়োজনের কারনে এত বড় একটা ঘটনা বেরিয়ে এলো শেষতক তা হলেই ভালো। এতদিন জানতো চাচা আরেক ধর্মে  বিয়ে করায় যোগাযোগ কম, আর আজ এই ২০ বছর বয়সে জানলো ঐ ২৫ বছর বয়সী কাজিনটি তার কেও না । কি ভয়ংকর !

শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পোটকোট ও কিনতে হবে। ছোট ধরনের একটা দোকানে ঢুকলো। দোকানী বুড়ী ধরনের এক হিন্দু মহিলা খুব দ্রুত দোকান গুচ্ছাচ্ছেন। খালা বললেন,

কী মাসি দোকান বন্ধ করে দিবা নাকি।

ও অপলা, ভালো আছিস। দেরী করিস না মা, চলে যা। শুনলাম কোন এক দোকানে নাকি হামলা হয়েছে। ঝামেলা বাড়তে পারে। আগে আগে চলে যাচ্ছি তাই। এরা কারা রে!!

আমার বোন ঝি, আর বোনেরই দেওয়েরের মেয়ে।

অবুক, কোন বোন, তোর বোন তো একটাই ছিল, ঐ যে বহু আগে কোলকাতায় ভেগে গেছিল সেই জন?

হ্যাঁ মাসী। এর নাম দ্রাবিড়া।

বুড়ী থমকে দাড়িয়ে দ্রাবিড়া’দিকে দেখলেন। ভাবলেন হয়তোবা, বাপতো হিন্দু ছিল না তাহলে এই নাম কেন, বা অন্য কিছু হয়তো ভাবলেন। তার সব ভাবনাই হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কেন যে ঘুরপাক খাচ্ছে কে জানে। নিজেই বিরক্ত হলো।

শাপলাকেও পরিচয় করালেন। শাপলা সালাম দিল। উনি অবশ্য দ্রাবিড়া’দি-কেই দেখতে ব্যস্ত, একটু হেসে বললেন, দেখতে তো মায়ের মতন হয়নি, মনে হয় বাপের মতন হয়েছে।

আমার বাবাও খুব ফর্সা। আমি শুধু কালো। পাতিলে তলার মতন কালো। ওর মা আমাকে কালো পাতিল ডাকে।

কী বাজে বকো দ্রাবিড়া’দি, মা কবে তা বলল।

বুড়ী দোকানী হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

এক জীবনে অনেক কালীই আমরা গায়ে মাখি। রাজহাস কিছুই গায়ে মাখে না বলে কাদার মাঝে ঘুরে বেড়িয়েও ফক ফকা সাদা থাকে।

এটা বললেন কেন? কি জানেন আপনি?

না,কি জানবো! জানার কি আছে? অবুক।

শাপলা তাড়াতাড়ি সামাল দিল পরিস্থিতি। বলল,

উনি ঐপার থেকে এসেছেন তো সবার সব কথা ঠিক মতন বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও।

ও তাই! শেষবার যখন ওর মাকে দেখেছিলাম সেও কি কি সব আবোল তাবোল বলছিল।

কোথায় দেখেছিলেন? কি বলছিল? দ্রাবিড়া’দি জানতে চেয়েই খুব আশা নিয়ে চেয়ে থাকলো।

এই যে এখানেই তো এসেছিল? বাচ্চাদের কাপড় কিনছিল। তোমার জন্যই হবে হয়তোবা। বললো তার নিজের বাচ্চার জন্য কিনছে, হয়নি তখনও, তাইতো বলছিল, পেটও তো বড় হয়নি। আমি কিছুই বুঝিনি। কি যে কি বলল!

আর কে ছিল সাথে তার?

চিনি না, ছিল কেও হয়তোবা, মনে নাই।

আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন আমাকে।

আমার ফোন বাজলেই আমি তুলি না। আমাকে ফোন করলেও পাবে না।

আমি আসবো আবার আপনার কাছে খোজ করতে।

কি খুজতে? কি হারিয়েছো?

আমি হারিয়ে গেছি।

মহিলা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন। ভাবলেন যা বললেনও তা,

তোমরা মা-মেয়ে দু’জনাই দেখছি-মতিচ্ছন্ন মানুষ। উলা পাওয়া মানুষ।

জী, তাই।

খালা এক প্রকার জোর করেই দ্রাবিড়া’দিকে ধরে নিয়ে এসে গাড়িতে বসালেন। কিন্তু কোন শাসন বা বকা কিছুই দিলেন না। যেন উনি বুঝতে পারছেন দ্রাবিড়া’দির মানসিক যাতনা। বললেনও একটু পরে, দিদির উচিত ছিল কাউকে একটা কিছু বলে যাওয়া, তোর বাবাকে তো বটেই।

গাড়িতে এসি নেই। খোলা জানালার বাতাস এসে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে শাপলার ছোট ছোট চুলগুলো। দ্রাবিড়া’দি চুল সব মাথার উপর তাজমহল বানিয়ে তুলে রেখেছেন। খাওয়া দাওয়া ভুলেও যা ভুলতে পারছেন না সেই বিষয়েই জিজ্ঞেস করলেন দ্রাবিড়া’দি,

মাসী, মায়ের কোন বান্ধবী আছে, জান কিছু।

সে তো আছেই। কতজনই ছিল। এখন তো আর ওনাদের খবর জানি না। মেহেদীবাগ,মাদারবাড়ী ,লালখান বাজার কত জায়গায় কত  বান্ধবী ছিল।

খবর নেবে একটু। আত্মীয় স্বজনদের সাথে যখন যোগাযোগ ছিল না তখন বন্ধুদের কাছেই হয়তো এসে উঠেছিল।

দেখি, আচ্ছা।

শাপলা বললো,

দ্রাবিড়া’দি,তুমি না আজ সকালে বলেছিলে কাল চলে যাবে, আর দৌড়াবে না মরীচিকার পেছনে।

শাপলা, এ কী আমার পিছু আর ছাড়বে কখনো! এ ভাবনা আমার সাথে সাথেই ঘুরবে বলে মনে হচ্ছে।

দ্রাবিড়া’দি তুমি কত খুজবে। কোথায় খুজবে!! কতদিন খুজবে?

জানি না রে।

যেতে দাও, বাদ দাও।

পারবো না মনে হয়। চেষ্টা তো করছি। কিন্তু মন চাইছে জনে জনে প্রতি জনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা শুনুন আপনার কি একটা কালো মেয়ে হয়েছিল? যাকে আপনারা কাওকে দিয়ে দিয়েছিলেন।

বুড়া ড্রাইভার যে কিনা কানে কম শুনে, দেখেও কম, তারপরও বহুদিনের পুরাতন ড্রাইভার বলে বসে আছে এ বাড়ীর গাড়ীর স্টীয়ারিং ধরে সে হঠাৎ বললো,

বলেন কি দিদিমনি, কোন বিড়ালের কালো বাচ্চা দিয়ে দেবেন। নেবে না কেও। কত  বিড়ালের  বাচ্চা চারদিকে গড়াচ্ছে, কে নেবে!

দ্রাবিড়া’দি স্বম্ভিত।

খালা একটাও কথা না বলে চুপচাপ বাহিরের দিকে চেয়ে থাকলেন।

শাপলা একবার এর আরেকবার ওর মুখের দিকে চেয়ে চুপচাপ দুজনের মাঝে বসে থাকলো, ভাবে কি আজব এই দুনিয়া। যে যার মতন করে ভেবে নিচ্ছে যা খুশী।

 

কথাসাহিত্যিক, উপন্যাসিক ও গল্পকার দিলরুবা আহমেদ

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024