ছয়তলার একপাশে তাপস-তপতী দম্পতির নিজেদের ফ্ল্যাট।
মেয়ে দুটো নিয়ে চারজনের সংসার ওদের ; তাই দুই কামরার ফ্ল্যাটে কুলোয় না। গায়ে-গায়ে লাগে; তবু রোজগার না বাড়ায় এভাবেই থাকতে হচ্ছে। তাপসের ইচ্ছে আছে, ছোট পরিসরের বস্ত্র-ব্যবসাটা একটুখানি বেড়ে উঠলেই সে এই কম আয়তনের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়ে বড় একখানা কিনে নেবে। সেই স্বপ্ন বুকে চেপে সে এগোচ্ছে সামনের সম্ভাবনাময় দিনগুলোর দিকে।
মাঝে মাঝে ফ্ল্যাটের পরিসর নিয়ে তপতীর আহাজারি বেড়ে গেলে স্বামী হিসাবে সে প্রায়ই উত্তর দেয়,‘একটুখানি সবুর কর। সবুরে মেওয়া ফলে।’ এ সান্ত¦না-বাণী তপতীর জন্য যথেষ্ট নয়। এককথা বারবার শুনে শুনে সে অভ্যস্ত , গোমড়া মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
এমনিতে তপতী বেশ কড়া মহিলা ; সামান্য কারণে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। তার যত টেনশন সব মেয়েদের ঘিরে ; সারাক্ষণ চোখে-চোখে রাখে ওদের ; মেয়েরা একটুখানি চোখের বাইরে গেলেই সে অস্থির হয়ে পড়ে। একরাশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ওকে জাপটে ধরে। কেবলই মনে হয়, চোখের বাহিরে গেলেই বুঝি ওরা কোনো বিপদ ডেকে আনবে। এ ভাবনা থেকেই যত অধৈর্যপনা তপতীর, তত নিত্য খবর্দারি ওর।
সেদিক থেকে তাপস একেবারে উল্টো। মাই ডিয়ার টাইপ। বাবাকে কখনোই ওরা ভয় পায় না। ছাদ-বাগানের গাছের মতো বন্ধু বলে মনে হয় ; অথচ নির্দয় স্কুল-শিক্ষিকার মতো তপতী ; দশটা চোখ তার, ওদের উপর তদারকি ফলাতে কেবলি চড়কির মতো ঘুরছে সারাক্ষণ।
তুষ্টির বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের মেজাজ কড়া। একটুতেই বকাঝকা করতে শুরু করে দেয়। অথচ তাতে সৃষ্টির কিছু আসে-যায় না। সে মায়ের সঙ্গে রীতিমতো চোপা শুরু করে দেয়। এজন্য যখন তখন মার পর্যন্ত খেতে হয় ওকে।
কিন্তু তুষ্টি সহজেই নার্ভাস হয়ে যায়। সামান্যতেই হাতপা ঠাণ্ডায় জমে যেতে শুরু করে। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি। এরকম পরিস্থিতিতে একবার তো সে জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছিল। সৃষ্টি পরে ওকে বলেছে, জানিস , তোর দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার পর মাকে অনেক বকুনি খেতে হয়েছে বাপির কাছে । তখন মায়ের জন্য আমার কান্না পাচ্ছিল ভীষণ। তুই যে কী, একটুতেই হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে যায়। হি হি হি।
তুষ্টি ঘরে ঢুকে দেখল, সব চুপচাপ। মা কিচেনে। বাপির অফিসের জন্যে খাওয়া তৈরি করছে।
ওর পায়ের শব্দ পেয়ে বলল ,‘ একটু পড়ায় বোস। সারাদিন গীটারে মন পড়ে থাকলে চলবে ? ছোটবেলায় তো ভাল রেজাল্ট করতি। এখন খারাপ হচ্ছে কেন ? ’ অন্তর্নিহিত ¯েœহে টসটস করছে মায়ের কণ্ঠ। রাগের কোন লক্ষণই সেখানে নেই।
তুষ্টি নিজের কক্ষে ঢুকে বই বের করে পাতা উল্টাতে শুরু করে। যত পাতা ওল্টাচ্ছে তত রাগ জমতে থাকে সৃষ্টির জন্যে। সে শুধু শুধু ওকে মিথ্যা বলে ছাদ থেকে নামিয়ে এনেছে। নইলে খানিকটা সময় সে আরও কাটাতে পারত ওর বৃক্ষ-সখাদের সাথে।
বই-র পাতায় মন বসছে না। ঘুরে-ফিরে ছাদে চলে যাচ্ছে সমস্ত মনোযোগ। সৃষ্টি কী করছে তা নিয়ে প্রচÐ কৌতূহল মনে।
সাধারণত সৃষ্টির মতো কথায় কথায় অভিযোগ করার বাই নেই ওর । তবু এখন রাগ হচ্ছে বড়।
সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে মাকে বলল,‘ মা, সৃষ্টির না পরীক্ষা ? ও ছাদে গিয়ে কী করছে ?’
তপতীর তখন রান্নাঘরের ধোঁয়া আর গরমে নাকাল অবস্থা। কাজের লোক দুদিনের ছুটির কথা বলে সপ্তাহ কাটাচ্ছে। এমনিতেই তিতি-বিরক্ত ।
তুষ্টির কথায় যেন রাগ ঝাড়ার একটা যথার্থ মওকা পেয়ে গেল। গ্যাসের লাইন অফ করে গজরাতে গজরাতে দরজা খুলে সোজা ছাদের দিকে পা বাড়ায়।
এখানে সৃষ্টি হলে ঠিক মায়ের পিছু নিত। তুষ্টিকে মা কিভাবে নাজেহাল করে, তা নিজ চোখে না দেখলে যেন ওর শান্তি নেই।
কিন্তু তুষ্টি সেরকম নয় ; সে তা করবে না। সে নিজের পড়ার টেবিলে বসেই বুঝতে পারছে , ছাদে কী হচ্ছে। তাতেই মনে মনে হেসে কুটি-কুটি সে। দেখার কি দরকার ?
একটু বাদে গীটার হাতে সৃষ্টি ফিরে এল রুমে। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তুষ্টির পাশেই ওর পড়ার টেবিল। সেখানে গীটারটা দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখল প্রথমে ; তারপর পড়ার টেবিলে বসে চোখের সামনে ক্লাস সেভেনের সমাজশিক্ষা বইটির একটি চ্যাপটার খুলে কোনদিকে না তাকিয়ে গলায় যত জোর আছে তা প্রয়োগ করে পড়তে শুরু করে দিল। যেন ভেতরকার অব্যক্ত সমস্ত রাগ ও উষ্মা সে পড়ার উপর ঝাড়তে চাইছে।
তুষ্টির মনে হচ্ছে, সৃষ্টির গলার তাগদ এমনি তীব্র ও বিদারী যে একটু পর হয়তো ফ্ল্যাটের সবকিছু বাতাসে উড়ে-উড়ে ভাসতে শুরু করে দেবে।
তুষ্টির পড়া এগোচ্ছে না। তবু কিছু বলছে না। বলতে গেলেই সমস্ত রাগ এসে ওর উপর পড়বে। গলা ফাটিয়ে কেঁদে ভাসাবে আর ওকে দোষারূপ করবে। এজন্য সে কোনরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছে।
তাপস এসময়টায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল বিছানায়। ছোট মেয়ের গলার চড়া শব্দে বিছানায় থাকতে না পেরে ছুটে এল।
‘এ্যাই, এত জোরে পড়ো কেন, মা ? ভোকাল কর্ড ফেটে যাবে তো ? আস্তে পড়, প্লিজ।’ বলে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
ব্রাম্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে তাপসকে বি.এ. পাস করার পর চাকরির সন্ধানে ঢাকায় চলে আসতে হয়। লেখাপড়ায় মেধাবী হয়েও টাকার অভাবে পড়ালেখা আর এগোয়নি। ওর চেয়েও কম মেধাবী যে-বন্ধুরা ভাল চাকরি-বাকরি যোগাড় করে সমাজে ভাল অবস্থান করে নিয়েছে, ওদের কথা উঠলে যন্ত্রণাটা আরও বাড়ে।
এমনিতে বেশ ন¤্র-ভদ্র আর শালীন ব্যবহার তাপসের। কণ্ঠের মাধুর্য যে কাউকে প্রথম দর্শনেই টেনে নেয়। সৌম্য চেহারার সাথে কণ্ঠটি অবলীলায় মিলে যায়।
একটু বাদে শুরু হয় মায়ের খবরর্দারি। কিচেন থেকে বেরিয়ে সৃষ্টির পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখ-চোখে অসহ্য বিরক্তিবোধ।
‘ব্যাপারটা কি ? তুই কি এই ফ্ল্যাটে কাউরে থাকতে দিবি না ?’
‘কি করছি ?’
‘গলা ফাটাইয়া পড়তেছিস ক্যান ?’
‘তুমিই তো বল বড় গলা করে পড়লে মনে থাকে সব। ’
‘সেজন্য অত ? ফাজলামি করার আর জায়গা পাও না। গলা নামিয়ে পড়। আর চোপা কম কর।’ বলে ধমকে ওঠে তপতী। সহসা প্রেশার-কুকারের হুইসেল ওঠায় তপতীর কথা আর শেষ হলো না, ছুটে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
সৃষ্টি গলা নামাল বটে ; কিন্তু চাপা স্বরে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,‘ আমি রোবট তো। যখন গলা নামাতে বলবে , আমি নামাব। যখন গলা উঁচুতে তুলতে বলবে , আমি তুলব। গানের ইশকুলে আর বাসায় একরকম। আজব।’
শুনে তুষ্টির হাসি এসে যাচ্ছিল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয়।
দ্রুত বাহানা করে সে সটকে পড়ে। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,‘স্কুলের ড্রেসটা ইস্তারি করব. মা? ’
‘এখন পড়ার সময়। এখন ইস্তারি করতে মন চেয়েছে? ফাঁকিবাজ কোথাকার। যা, ড্রয়িংরুমে রাখা আছে। বেশি সময় নিস না দেখিস।’
‘আচ্ছা। ’
তুষ্টি নিজের জামা ইস্ত্রি করছে আর বারবার সৃষ্টির কথা মনে করে আপনমনে হাসছে। মনে হচ্ছে , অনেকদিন পর চালাকচতুর ছোটবোনটাকে একটা ধোলাই দেয়া গেছে মাকে দিয়ে।
সবসময় সৃষ্টির দুষ্টু বুদ্ধির কাছে ওকেই হেনস্থা হতে হয়। আজ উচিত শিক্ষা পেয়েছে। হিঃ হিঃ হিঃ।
Leave a Reply