শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০২ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-৪)

  • Update Time : বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

স্কুলের  গেট-ঘেঁষা  ছাউনির তলায় একটা ছোট প্লাস্টিক মোড়ায় মনমরা হয়ে বসে রয়েছে তপতী। চারপাশে অভিভাবকদের চেঁচামেচি। কেউ বেরুচ্ছে, কেউ দলে-দলে বিভক্ত হয়ে গাপুস-গুপুস খাচ্ছে আর আড্ডা দেবার নামে সমানে পরনিন্দা -পরচর্চায় মশগুল হচ্ছে। যেন প্রতিদিন গৃহবধু মায়েদের প্রাণখুলে  কথা বলার এক বাজার এটা। যা খুশি বলো , যা খুশি গেলো , যা খুশি কেনো অবাধ স্বাধীনতার এক উত্তম চারণক্ষেত্র যেন এ আসর।

তপতী এসব দল-উপদলের কোনোটাতেই নেই। এখানে যার যত হাতভরা টাকার জোয়ার, তার তত দাপট। তাছাড়া, স্বামীকে ঘায়েল করে কথা বলা এখানকার মায়েদের দস্তুর। তপতীর তা পছন্দ নয়। সে তাপসকে মনে-প্রাণে বুঝতে পারে। দিনরাত কত কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটাতে চাইছে সে। সীমিত আকারের বস্ত্র-ব্যবসায় কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই ভালো তো পরক্ষণেই মন্দ। অনেক যুদ্ধ করে, বলতে গেলে জিরো থেকে সে এ পর্যন্ত উঠে এসেছে। সবটুকুই ওর নিজস্ব । একদিন ভালো কিছু হবে এটুকু আশা-আকাক্সক্ষায় বুক বেঁধে এর গোড়ায় নিয়মিত জল-সার ঢেলে দিচ্ছে সে। এরকম এক নিবেদিত-প্রাণ  সংসারীকে তপতী কি করে অন্যদের মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ? তাই বাচ্চাদের সকল ঝামেলা ওকেই পোহাতে হয়। সেজন্য ওর চিল্লাচিল্লির অন্ত নেই। সারাক্ষণ ওর গলাবাজি লেগেই থাকে।

তবু দিনশেষে মনের মতন  রেজাল্ট হচ্ছে না মেয়ে দুটোর। এবছর তুষ্টির জেএসই পরীক্ষা। অথচ সে গান নিয়ে পড়ে থাকে। সুযোগ পেলেই হাত বাড়ায় গীটারটার দিকে। মাঝে মাঝে গীটারটা আস্তাকুঁড়ে  ছুঁড়ে ফেলে দেবার ইচ্ছে হয়। তাতে যদি মেয়েটা মনোযোগী হয়ে ওঠে পড়ায়। পরক্ষণে মনে হয় , মেয়েটা যেরকম অন্তর্মুখী আর নরোম দিলের মানুষ,  তাতে ওর হাত থেকে  গীটারটা কেড়ে নিলে  সে নির্ঘাৎ বড় কষ্ট পাবে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যদি খারাপ কিছু একটা করে বসে, তখন ? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে তপতীর।

তবু বকতে ছাড়ে না তপতী। তুষ্টি কিছুটা ভাবুক স্বভাবের। যা দেখে, ভাল লাগলে সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক বিভোর মগ্নতায় ডুবে যায় ক্ষণে ক্ষণে। এজন্য তুষ্টিকে নিয়ে তপতীর বড় ভয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনার এত শ্রম আর এত ঘামে গড়া ছেলেহীন এ সংসারে মেয়ে দুটো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে তো ? নিজেদের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যতের  যে প্রতিমা ওরা আঁকতে চাইছে , তা মাঝ দরিয়ায় এসে ডুবে যাবে নতো ? অথচ লেখাপড়ায় তুষ্টি গর্ব করবার মতো ভাল ছিল একসময়; ইদানীং যে কী হচ্ছে ওর Ñ তাপস-তপতী কেউই ঠিক বুঝতে পারছে না।

সৃষ্টিকে নিয়ে অত চিন্তা নেই। সে দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পেলেই আগুন-আগুন চেঁচিয়ে এলাকা ছেড়ে দেবে। কিন্তু  তুষ্টির ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ধোঁয়া দেখলে আরও কাছে গিয়ে এর কুÐলীর দিকে তাকিয়ে ভাবতেই থাকবে ; তবু দ্রæত জায়গা ত্যাগ করবে না। মেয়ের এই উপস্থিতবুদ্ধিহীনতায় তপতী শঙ্কিত; মেয়েদের  প্রধান অস্ত্রটাই হচ্ছে তাৎক্ষণিক এই বুদ্ধি-বিবেচনা , সেটা  কম থাকলে টিকবে কিভাবে এ বিরুদ্ধ সংসারে? জীবন যে অনেক বড়ো। ভেবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে তপতী।

স্কুলের সামনে বসে বসে সে এসবই ভাবে আর সময় কাটায়। পয়সা বাঁচানোর  জন্য দুপুরে কিছু মুখে দেয়  না পর্যন্ত। সেই টাকায় স্কুল ছুটি হবার পর মেয়েদের সে চিপস-লজেন্স কিনে দেয়।

হিসাবের টাকা ওর। সমঝে চলতে হয়। স্কুল ছুটি হলেই ওদের নিয়ে দৌড়াতে হয় সিদ্ধেশ্বরীর চিপা গলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোচিং সেন্টারের উদ্দেশে। পেট চোঁ-চোঁ করে ক্ষুধায়। তবু  সে সব সহ্য করে। ঢক-ঢক করে বোতল থেকে খানিকটা জল মুখে ঢেলে দিয়ে  আগুনমুখো ক্ষুধা চাপতে চায় সারাক্ষণ।

তবু সে স্বপ্ন দেখে, মেয়ে দুটো বড় হয়ে ওর সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করবে একদিন। ভেজা চোখে ওদের সাফল্য দেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনার তরতর করে সময়  কেটে যাবে। এদেশে সন্তানের জন্য জীবনপাতের এই আনন্দই তো যথার্থ সার্থক জীবনের পরিচয় , একে কদাচিৎ কেউ অস্বীকার করতে পারে !

স্কুল ছুটির পর মেয়ে দুটোকে যখন চোখের সামনে দেখতে পায় তখন তপতীর মনে হয়, সে স্বর্গের ছায়া দেখতে পাচ্ছে মেয়েদুটোর চোখেমুখে।

ওরা দ্রæত ছুটে যায় কোচিং-সেন্টারের দিকে। বিকালের দিকে রাস্তা পেরনো মুশকিল। তবু থামাথামি নেই। সৃষ্টি ওর ব্যাগটা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে। সব মিলিয়ে তিরিশ-বত্রিশটা খাতা-বই এর ভেতর। তবু তপতীর কোনো অনুযোগ নেই। যত দ্রæত কোচিং-সেন্টারে যেতে পারবে তত মুস্কিল-হাসান।

তুষ্টির বিজ্ঞান আর সৃষ্টির অঙ্ক ক্লাশ। দশ-বাই-দশের এক-একটি রুমে পাতা বেঞ্চে মোট চল্লিশজনের বসার ব্যবস্থা। ওরা দু-বোন দুইরুমে ঠেসে-ঠুসে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে কোনরকমে।

দুবোনের প্রত্যেকের জন্যে  মাসিক দেড়হাজার করে খরচ হয়  কোচিং-ফি।  সেন্টারে আসুক বা না আসুক তাতে কিছু যায় আসে না। মাসের প্রথমে কোচিং-ফি পরিশোধ করতে হবেই। নইলে  বসতেই দেবে না সেখানে। নোট, মডেলটেস্ট তো পরের কথা।

ছাত্র-ছাত্রির মা-বাবাদের সবার একটাই ঐকান্তিক  ইচ্ছা Ñ তাদের সন্তান-সন্ততির প্রত্যেকে যেন গোল্ডেন এ প্লাস পায় প্রতিটি পরীক্ষায়। আত্মীয়-পরিজন সবার মুখে-মুখে যেন থাকে তাদের  প্রশংসা। খেয়ে না খেয়ে টাকা ঢেলে সেই অধরা স্বপ্নটাকেই সবাই আপন করে পেতে চাইছে এখানে।

তপতী মেয়েদের কোচিং-খোঁয়াড়ের ভেতর ঢুকিয়ে একটা চিলেকোঠায় অন্যান্য অভিভাবকদের সঙ্গে গাদাগাদি করে বসে থাকে নীরবে। কথা বলতে ইচ্ছে করে না মোটেই ; শরীর ক্লান্ত , ইঁদুর-দৌড় ক্ষুধার পেটে ।

কোনো এক ভাবী হজ্বের সময় সৌদি আরব থেকে আনা দুটো খেজুর দেয় খাওয়ার জন্যে। একবার ভেবেছিল, দু-বোনের জন্যে রেখে দেবে। খেজুর ওদের বড় প্রিয় ।  কিন্তু  চোখের সামনে সবাই ঝটপট খেয়ে নিচ্ছে দেখে  চক্ষুলজ্জায় ওকেও  মুখে পুরতে হলো খেজুর দুটো।

এতক্ষণ  দৌড়ঝাঁপ করে  ক্ষুধাটা বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল ; খেজুর খেয়ে তা একটুখানি যেন কমল।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024