শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৫২ অপরাহ্ন

মেহের গাজীর ভয়াবহ বাঘ শিকারের কাহিনী পচাব্দী গাজীর মুখে

  • Update Time : সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ৯.০১ পিএম

ফয়সাল আহমেদ

বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ তেমন একটা দেখা যায় না। সুন্দরবনের বাঘ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু একটি সময় ছিল যখন সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে বাঘ ছিল। ঐ সময় বাঘের পরিমাণ বেশি থাকায় কিছু কিছু বাঘ লোকালয়ে এসে গবাদি পশু এমনকি মানুষও খেয়ে ফেলত। আর তখন এই বাঘগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল মানুষ খেকো বাঘ। সেই সব বাঘ শিকারের কাহিনী গুলো আজও রোমাঞ্চকর। বাংলাদেশে মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন তার নাম পচাব্দী গাজী। তারা কয়েক পুরুষ ধরেই ছিলেন এ ধরনের বাঘ শিকারি। পচাব্দী গাজী নিজেই বলেছিলেন তার পিতা মেহের গাজীর ভয়ংকর এক বাঘ শিকারের কাহিনী ।

-খুলনার পাইকগাছা থানার গোলখালী গ্রাম সুন্দরবনের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত। বড় নদী কপোতাক্ষীর পাড়ে বড় গ্রাম গোলখালী, পুরা নাম শিঙের গোলখালী। গ্রামবাদী অধিকাংশ মানুষই গৃহস্থ, হাল-বলদ আছে, চাষাবাদ করে, মাছের অভাব নেই, কাঠেরও অধিক নেই। কিছু কিছু লোক অতি দরিদ্র, তারা বাওয়ালী ও মৌয়াল, নদীর ওপারের গভীর বনে গিয়ে কাঠ-লাকড়ি-গোলপাতা কাটে, মৌচাক কেটে মধু আহরণ করে। এই গ্রামের কেউ কেউ বনে কাজ করতে গিয়ে বাঘের এমন কি মুখামুখি হয়েও রক্ষা পেয়ে এসেছে, কিন্তু বাংলা১৩৫২ সালে একটি বাঘ যখন গোলখালী গ্রামেই গিয়ে একের পর এক মানুষ মারতে থাকে, গৃহস্থের হালের বলদ খেয়ে ফেলতে থাকে তখন অসহায় গ্রামবাসীগণের মধ্যে মহা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়। বাঘ প্রথমে নিয়ে যায় একটি গরু।

হালের বলদ, দুপুরের পরে জঙ্গলের ধারে খুঁটিয়ে রেখেছিল এক গৃহস্থ, সন্ধ্যার আগক্ষণে গোহালে আনতে গিয়ে দেখে গরু নেই, দড়ি ছিঁড়া। এক জায়গায় রক্ত দেখে তার মনে সন্দেহ হয়। গ্রামের লোকজনসহ হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢুকে আন্দাজ শ দুই হাত ভিতরে আধা-খাওয়া বলদ খুঁজে পায়। তারা বলদের সেই অর্ধেকটাই টেনে খোলা জায়গায় এনে গর্ত করে পুঁতে রাখে।

গোলখালীর মানুষ সেই প্রথম গ্রামে বাঘের উপস্থিতি জানতে পারে। এই ঘটনার অনেক বছর আগেও একবার গ্রামের প্রান্ত থেকে বাঘে গরু নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখন গরু পর্যন্তই, বাঘ কোন মানুষকে আক্রমণ করেনি। এ বছর তার ব্যতিক্রম ঘটল। উক্ত ঘটনার পরের দিন একজন লোক নিজেরই প্রয়োজনে শুকনা ডাল কাটার জন্যে গ্রামের জঙ্গলে যায়। বাঘ যেখান থেকে গরু নিয়ে গিয়েছিল সেই এলাকায় নয়, গ্রামের সামনে নদীর ধারের কতকটা খোলা জঙ্গলে, কাছে মানুষের চলাচল ছিল। মাটিতে দাঁড়িয়েই উপরের ডাল কেটে কেটে জমা করছিল সে, হঠাৎ চীৎকার করে উঠে, দূরের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই বাঘের গর্জন শুনতে পায়, তারপরেই সব নীরব। দিনের বেলা, সকাল দশটা সাড়ে-দশটার ঘটনা। ভয়ার্ত গ্রামবাসী কিছুক্ষণের মধ্যেই একত্র হয়, গ্রামে বন্দুক ছিল, সেটা নিয়ে একজন শিকারী এবং অন্যান্য সবাই যার যা অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনতে যায়। জঙ্গলের অনেকখানি ভিতরে তার দেহ খুঁজে পায় কিন্তু দেখে যে তার মধ্যেই ক্ষুধার্ত বাঘ পেট আর উরু খেয়ে ফেলেছে।

এর তিনদিন পরে নদী থেকে গ্রামে ফিরার পথে দুইজনের মধ্য থেকে পিছনেরজনকে বাঘে নিয়ে যায় বিকাল বেলা। তারা মাত্র চার-পাঁচ হাত তফাতে হেঁটে আসছিল, হাঁটু সমান হুদো লতার জঙ্গল, সেই হুদো বন পার হয়ে একটু খালি জায়গা, তারপরেই আবার একটা মাঝারি আকারের হুদো ঝোপ, আগেরজন ঝোপ পার হয়ে মাত্র কয়েক হাত গিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে ভয়ঙ্কর গর্জন। সে ভয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, সেই অবস্থায়ই পিছনে ফিরে দেখতে পায় সঙ্গেরজনকে মুখে করে ঝোপের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল বড় বাঘ। সে মরার মত কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকে, তারপর উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গ্রামে এসে সকলকে এই দুঃসংবাদ জানায়। মিনিট ত্রিশ-চল্লিশেকের মধ্যেই বন্দুক হাতে গ্রামের দুইজন শিকারীসহ অন্যান্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। শিকারীগণ মানুষখেকো বাঘের পারা দেখে চিনতে পারলেন। নদীর পাড় থেকে দুইজনকে আসতে দেখে বাঘ আগেই ঝোপের ভিতরে শুয়েছিল, কাছে আসামাত্র হুঙ্কার দিয়ে পিছনেরজনকে ধরে।

গ্রামবাসীগণ হৈ-চৈ, চীৎকার করতে করতে জঙ্গলের ভিতরে অগ্রসর হয়। খুবই সাবধানে আর ভয়ে ভয়ে এগুতে হচ্ছিল বলে মাত্র শ দুই হাত যেতেই অন্ধকার হয়ে যায়। তখন তারা বাধ্য হয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসে।

পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা আবার দল বেঁধে শিকারীর পিছনে পিছনে লাশ উদ্ধার করতে যায় এবং জঙ্গলের অনেক ভিতরে গিয়ে মৃতদেহ খুঁজে পায়। পেট, উরু, কোমর ও বুকের প্রায় সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। তারা হাড়গোড় এবং দেহের বাকী অংশ কাপড়ে জড়িয়ে এনে, গোসল দিয়ে, জানাজা পড়ে দাফন করে এবং বাঘের মুখে পর পর দুইজন মানুষের মৃত্যুসংবাদ কপোতাক্ষী ফরেস্ট অফিস ও বুড়ী গোলালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে জানায়।

কয়েকজন শিকারী সঙ্গে সঙ্গে গোলখালী আসেন। গ্রাম এলাকা বলে শিকারীদের এখানে কতগুলো সুবিধা ছিল, যেমন গাছতলায় গরু বা ছাগল বেঁধে রেখে মাচাতে বসে রাত্রে বাঘ মারার চেষ্টা করা বা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য- সহযোগিতা।

এই ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও বুড়ী গোলালিনীর বন কর্মকর্তা নিশ্চিত হতে পারলেন না, বিশেষ লোক মারফত আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আমার বাবা, সুন্দরবনের সুন্ শ্রেষ্ঠ শিকারী মেহের গাজীকে খবর পাঠালেন। বাবা চাকরী করতেন না, কিন্তু বন দফতরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে শিকার করতেন। সুন্দরবনের কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলেই বাবাকে খবর দেওয়া হত, তিনি গিয়ে সেই বাঘ মেরে বন দফতরের ঘোষিত নগদ পুরস্কার নিতেন। ইতিপূর্বে একটি মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ছিল তৎকালীন দুইশ টাকা, কিন্তু গোলখালীর বাঘ বিভীষিকা সৃষ্টি করে ফেলায়, এবং বলতে গেলে গোটা গ্রামকেই একেবারে অচল করে দেওয়াতে বন দফতর থেকে সরাসরি তিনশ টাকা ঘোষণা করা হয়।

মানুষখেকো বাঘের কথা একবার শুনলে বাবা আর ঘরে থাকতে পারতেন না। আমাদের বাড়ী সোরা গ্রামে, শ্যামনগর থানায়, আর শিঙের গোলখালী পাইকগাছা থানায়। কিন্তু উভয় গ্রামই থানার সীমান্তবর্তী হওয়াতে দুই গ্রামের মধ্যে দুরত্ব আড়াই মাইলের বেশী নয়; যেতে হয় কপোতাক্ষী নদী পার হয়ে। বাবা সেই মুহূর্তেই বন্দুক আর ছত্রা-বারুদ বের করলেন। দোনলা গাদা বন্দুকটি তিনি কিনেছিলেন এবং সেই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বন্দুকটি দিয়েই তিনি জীবনের অধিকাংশ প্রায় পঞ্চাশটা রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছিলেন। আমি আর চাচা, বাবার ছোট ভাই, তিনিও নামকরা শিকারী ছিলেন, নাম নিজাম্দী গাজী, তৈরী হতে হতে বাবা বন্দুকের দুই নলই ভরে ফেললেন, তারপর মাকে কোন কিছু না বলে তক্ষুণি রওনা হলেন। বিকাল তিনটা নাগাদ আমরা কপোতাক্ষীর তীরে গিয়ে পৌঁছলাম। নদী পার হতে হতে মাঝির কাছে শোনলাম যে, গতরাতেই গোলখালীর এক গৃহস্থের গোহাল থেকে বাঘ একটা গরু নিয়ে গেছে, গোহালের দরজা বরাবর খোলা থাকে, গতরাত্রেও খোলাই ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে গাভীর ঘাড় ভেঙে দড়ি ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। গোহালের প্রায় সংলগ্নই বাড়ীর লোকেরা অন্য সব গরুর ছটফটানি শুনতে পেয়েছিল, বুঝতেও পেরেছিল যে বাঘ এসেছে, কিন্তু প্রাণভয়ে কেউ বের হয়নি। সকালে বাঘের পায়ের ছাপ ও তাজা রক্ত পায়। অন্য দুইটা বলদ দড়ি ছিঁড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

গোলখালীর লোক সকলেই মেহের গাজীর নাম জানত। আমরা গ্রামের একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌছতেই অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে প্রায় জনাত্রিশেক লোক জড়ো হল। তারা গতরাতে বাঘে গরু জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে যেখানে খেয়েছে তক্ষুণি সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিতে চাইল, এবং বাবাও সেই মুহূর্তেই যেতে তৈরী ছিলেন; পাঁচ মিনিটও বিশ্রাম না করে হস্তদন্ত অবস্থায় ভয়ঙ্কর হিংস্র মানুষখেকো বাঘ মারতে রওনা হলেন। গ্রামের মানুষের অবস্থা তখন অতি বিপজ্জনক। সন্ধ্যা হবার আগেই সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এমন কি দিনের বেলাতেও কেউ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সাহস পায় না, হাট-বাজার বলতে গেলে প্রায় বন্ধই; গরু ছাগল পর্যন্ত ঘরের বাইরে নেয় না।

বেলা চারটার পরে আমরা গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে আধা-খাওয়া গরুটা দেখলাম। গরুর উপরে তখন দুই গাছে দুইজন শিকারী বসে ছিলেন, একজন বন অফিসের, একজন গ্রামবাসী। গোহাল থেকে জঙ্গলের সেইখানটা অন্ততঃ পাঁচশ হাত দূরে। বাবা ও চাচা দুইজনেই বাঘের পারা দেখলেন এবং আন্দাজ করলেন যে, বাঘ মরি রেখে পুব-দক্ষিণ দিকের হুদোরনে ঢুকে গেছে, রাতের মধ্যে অবশ্যই আবার আসবে, কিন্তু ধূর্ত জন্তু যদি চক্কর দিয়ে থাকে তবে হয়ত কাছেই কোথাও শুয়ে মাচার উপরে বসা দুই শিকারীকেই লক্ষ্য করছে। শিকারীগণ বাবাকে জানালেন যে, তাঁরা একেবারে সারা রাতের জন্যে তৈরী হয়ে বসেছেন।

বাবা গ্রামের সকল লোককে যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বললেন। তারা একটু খোলা এবং মোটামুটি নিরাপদ স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা জঙ্গলের কিনারায়ই অপেক্ষা করলাম; তারপর মরি থেকে পশ্চিমমুখী অগ্রসর হলাম। শ দুই হাত যেতে বাঘের পারা পাওয়া গেল। তাজা পারা। হুদো জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বমুখী গেছে। পারা ধরে অগ্রসর হলাম। বাবা আগে, তাঁর পিছনে চাচা, তারপরে আমি, বন্দুক শুধু বাবার হাতে।

হুদো সুন্দরবনের একরকম লতানো গাছ, গুচ্ছ গুচ্ছ হয়। সাধারণতঃ হাঁটু সমান উঁচু হয়, কোমর সমান খাড়াও হয়। সরু হুদোলতার ডালপালা হয় না, গোড়া থেকেই লম্বা লম্বা পাতা মেলে। এই হুদো বন একটানা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আর এত ঘন হয় যে তার ভিতরে বাঘ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে, ভিতরে চার-পাঁচ হাতের বেশী কিছুই দেখা যায় না বিপজ্জনক জঙ্গল ভেঙে দক্ষিণ-পুবমুখী আন্দাজ পঞ্চাশ হাত গিয়ে বাবা হঠাৎ থেমে গেলেন। সেখানে একেবারেই তাজা পারা, মাত্র কয়েক মিনিট আগে বাঘ হেঁটে গেছে। বাবা ও চাচা দুইজনেই থেমে খুব ভালভাবে জায়গাটা পরীক্ষা করলেন, তারপর ইশারায় স্থির করলেন যে অনুসরণ করবেন।

আধা-খাড়া আধা-বসা অবস্থায় আমরা এগুতে লাগলাম। নিশ্চিত যে বাঘ তখন আমাদের থেকে দূরে নেই, হয়ত আমরা যে রকম বাঘের দিকে এগুচ্ছিলাম বাঘও তেমনি আমাদের ঘ্রাণ ওঁকে বা হুদোগাছের নড়াচড়া দেখে আমাদের দিকে তাক করছিল; মৃত্যুভয় বহন করে আমরা এক পা এক পা করে সামনে এগুতে লাগলাম।

বাবা একটু যান, থামেন, কখনও বা এক পা পিছনে হঠে আসেন, আবার বিবেচনা করে খাড়া হুদো লতার ফাঁক দিয়ে এক পা সামনে বাড়েন। হঠাৎ হুদোঝোপ ভেঙে তিনি বামদিকে একবারে তিন-চার হাত পিছনে সরে এলেন। চাচা আর আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর পিছনে ছুটে গেলাম। বাঘের গর্জন ও লাফ আর বাবার বন্দুকের আওয়াজ একই সঙ্গে হল; বিজলীর মত বাঘটা ডান দিক থেকে এসে আমাদের মাত্র পাঁচ হাত সামনে পড়ল এবং বাবা দ্বিতীয় ট্রিগার টানার আগেই পূবমুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাত্র এক ঝলক আমি বাঘের কোমর থেকে লেজ দেখলাম, তারপর হুদোবন ভাঙা ছাঁড়া আর কিছুই দেখলাম না। একটা লতা সামনে থাকলেও বন্দুকের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়, তার হুদোবনের ভিতর দিয়ে ছুটে যাওয়া অদৃশ্য বাঘকে গুলি করাটা একেবারেই অর্থহীন কাজ হত।

 

বাবা আর গুলি করলেন না, যতদূর দেখতে পেলেন বাঘের গতি লক্ষ্য করলেন, তারপর চাচার হাতে বন্দুকটা দিয়ে দুই হাত কোমরে রেখে চিন্তা করতে লাগলেন। মানুষখেকো বাঘ ঠিকই আমাদের লক্ষ্য করছিল এবং তার কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়েছিল; বাবা যদি পিছনে হঠে গুলি না করতেন তবে দ্বিতীয় লাফে অবশ্যই বাবাকে ধরত। অভিজ্ঞ শিকারী, গুলি করেছিলেন বলেই বেঁচে গেলেন, কারণ বাঘ কখনও গুলি খাওয়ার পরে আর শিকারীকে আক্রমণ করে না। সামনে এগুতেই বাঘের রক্ত দেখলাম, হুলো গাছের গোড়ায় ও গুলি লেগেছে ঠিকই কিন্তু বাঘ ঘায়েল হয়নি। মাটিতে। অর্থাৎ বেলা তখন আর খুব বাকী ছিল না, বাঘ যতদূর গেছে হুদোবন ঠেলে সে পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাদের অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন অসহায় অবস্থায় গুলি খাওয়া বাঘের সামনে পড়ব। বাবা ও চাচা দুইজনেই ভেবেচিন্তে সেদিনের মত বাড়ী ফিরা স্থির করলেন, গোলখালীর সকলকে রাত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকার কথা বলে, কপোতাক্ষী পার হয়ে আমরচ বাড়ী ফিরে এলাম। ভাত খেয়ে রাত্রেই বাবা আবার বন্দুক ভরতে বসলেন, তখন মা বাধা দিলেন। দারুণ জেদী শিকারী হলেও বাবা রাত্রির মত বন্দুকটা রেখে দিলেন। কিন্তু মার বাধাকে পরোয়া না করে খুব ভোরে তিনি বন্দুক নিয়ে বসলেন, গাদা বন্দুকের দুই নলে বারুদ-ছরা ভরলেন। চাচা নিজামদী গাজীও নিজের বন্দুক ভরলেন; সকাল সাতটার মধ্যেই আবার বাবা গোলখালী রওনা হলেন। এবারও আমরা তিনজন, তবে গতকাল বন্দুক ছিল এক বাবার হাতে, আর আজ বাবা-চাচা দুইজনের হাতে দুই বন্দুক: আমি চললাম শুধু একটা একটা লাঠি হাতে।

গোলখালী গিয়ে বাবা প্রথমেই গ্রামবাসী সকলকে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় থাকতে বললেন, কেন না গুলি খাওয়া মারাত্মক হিংস্র বাঘ নিশ্চিত গ্রামের সীমানার মধ্যে রয়েছে। বেলা তখন সাড়ে-নয়টা দশটার বেশী হয়নি। গতকাল বাবা গুলি করে বাঘ মারতে না পেরে ফিরে যাওয়ার পর থেকে সকাল পর্যন্ত কোন একটি প্রাণীও বাড়ী থেকে চল্লিশ হাত দূরে যায়নি, গোহাল থেকে কেউ গরু বের করেনি। বাবার কথামত গোলখালীর জনাদশেক সাহসী যুবক একটি রন্দুক সমেত গ্রামের বাড়ী বাড়ী সবাইকে সতর্ক করে দিতে রওনা হয়ে গেল, আর বাবা, চাচা আমি এগিয়ে গেলাম গ্রামের ও বাইরে গতকালকের ঘটনাস্থলে, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানে।

ঠিক যেখানে বাঘকে গুলি করেছিলেন গতকাল, সেখানে আজও গেলেন এবং বাঘের পারা ও কাত হওয়া হুদোর চারা দেখে অত্যন্ত সাবধানে, অতি সতর্কতার সঙ্গে বাবা পূর্বমুখে অগ্রসর হলেন। আগে বাবা, বাবার হাত পাঁচেক পিছনে চাচা, আর চাচার হাত আষ্টেক পিছনে আমি লাঠি হাতে, যা বাঘের আক্রমণের মুখে হয়ত অতি সামান্যই কাজে আসবে।

ঘন হুদো বনের ভিতরে সামনে বা পাশে কোনদিকেই চার-পাঁচ হাতের বেশী দৃষ্টিতে আসছিল না, আমরা চোখের উপরে যতটা ঘ্রাণশক্তির উপরে তার চেয়ে বেশী নির্ভর করে অতি ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে এগুতে লাগলাম, একটা কাঁচা পাতা নড়ার শব্দও তখন সঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম।

বাবার কালকের গুলি, খুব কার্যকরভাবে না হলেও, বাঘের গায়ে লেগেছিল এবং অবশ্যই বাঘ আহত হয়েছে। তিনি বুকে গুলি করেছিলেন, সে গুলি নিশ্চয়ই কাঁধ বা ঘাড়ের চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকবে। অনুসরণ করতে করতে স্থানে স্থানেই আমরা মাড়েতে আমর হুদো পাতায় জমাট রক্ত দেখতে পেলাম, কিন্তু কোনখানেই খুব বেশী মাটিতে আর ফোঁটা ফোঁটা। নিশ্চিত হয়ে কিছু ধারণা করার মত চিহ্ন নেই। খুব জখম পরিমাণে তবেগে ধাবমান বাঘের দেহ থেকে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ না হতে পারে, আবার গুলি কেবলমাত্র চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকলেও এ রকম হতে পারে। তবে সম্ভবতঃ বাঘ যেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আজ সেখানেই শুয়ে রয়েছে। যেখান্ডোয় আমরা সামান্যই এগুতে পারলাম। সামনে, ডানদিকে, খুব ভাল করে লক্ষ্য করে, বার বার রুদ্ধপ্রায় নিঃশ্বাস টেনে তারপর একটি পা সামনে এগুতে হচ্ছিল। চ্য করে রোমক দক্ষিণে একটা মাঝারি আকারের কেওড়া গাছ থেড়েল, তার ঠিক নীচে হুদোবন কিছুটা পাতলা ছিল, বাঘ গেছে সেদিকে। যদিও গ্রাম থেকে দূরত্বহেতু ঘয়েল হুদোৱন কিছু যে কোন আড়াল-আবডালে শুয়ে থাকা সম্ভব ছিল, তবু সেই হালকা হাদয়ৰনে গাছের পিছনেই যে বাঘ থাকবে এটা সম্ভবতঃ বাবা রায়ছাড়া কেউ ধারণা হুদোবনে গাছেন। কেওড়া গাছটা বরাবর আরও হাত আষ্টেক গিয়েই বাবা হঠাৎ থপ করে থামলেন। পাতার একটু নড়াচড়া হল এবং তারপর একেবারে আচম্বিতে ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ ছুটে এসে বাবাকে আক্রমণ করল। বন্দুক তাক করার আগেই হা-হা করে এসে বাবার উপরে পড়ল, তিনি বন্দুক হাতে কাত হয়ে একপাশে পড়ে গেলেন, বাঘ তার মাথায় একটা থাবা মেরেই আরেক লাফে গিয়ে চাচাকে ধরল।

পচাব্দী গাজী, বন কর্মকর্তা শাফায়াত আহমদ খান ও অনুলেখক হুমায়ুনখান। [ফটো: ওসামু মন্ডেন]

চাচা বন্দুক নিশানা করে থাকা সত্ত্বেও বাবা সামনে থাকায় ট্রিগার টানতে পারলেন না, বাঘ আরেকটা হুঙ্কার দিয়ে চাচার হাতে কামড় দিল এবং পরমুহূর্তে হুদোবনে ঢুকে গেল। মাত্র হাত-দশেক দূরে থেকেও আমি বাঘ দেখতে পাইনি। হুদোগাছ ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলাম বাবার বিকট চেহারা; মাথার বামদিকে তালু থেকে কপাল, কান ও চোয়ালের মাংসপেশী আল্লা হয়ে কাঁধের উপরে ঝুলে পড়েছে, মাড়ির দাঁত বের হয়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায়ই বন্দুক আমার দিকে এগিয়ে অবিশ্বাস্য সাহসের অধিকারী বাবা চীৎকার করে হুকুম দিলেন, ‘ধর বন্দুক! গুলি কর।’ এক হাতে আদেশমত বন্দুক এবং আরেক হাতে বাবাকে বুকে ধরে সামনে তাকিয়ে অন্ততঃ দেড়শ হাত দূরে আমি কেবল হুদোগাছ নড়তে দেখলাম। চাচার দিকে চেয়ে দেখি তিনিও ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে এক হাতেই বন্দুক নিশানা করে বাঘের বরাবর চেয়ে আছেন, আরেকটা হাত কনুই-এর উপর থেকে নীচে ঝুলে আছে, রক্তের ধারা ছুটছে। বাবা ও চাচা দুইজনকে অতিকষ্টে ধরে হুদোবন ও জঙ্গল পার করে গোলখালী গ্রামে নিয়ে এলাম।

গ্রামবাসীরা যে যতদূর পারল সাহায্য করল, সাধ্যেরও বেশী করল। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের দুই বিখ্যাত শিকারী ভাই-এর শিকার জীবনে যতি নেমে এল-একজনের চিরতরে। দীর্ঘ তিনমাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে আমার বাবা মেহের গাজী সেরে উঠলেন, এবং তারপরেও আরো পাঁচটা বাঘ মেরে শেষ পর্যন্ত সুপতির মানুষখেকো বাঘের কামড়ে মারা যান; আর চাচা নিজাম্দী গাজী এর পরে যদিও আরো আঠারো বছর জীবিত ছিলেন তবু একহাতে আর বাঘ মারতে পারেননি।

চাচাকে সেই দিনই শ্যামনগর থানার সরকারী ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সুধীর ডাক্তার অপারেশন করে কনুইর উপর থেকে তাঁর হাত কেটে বাদ দেন। বাবাকে বাড়ীতেই চিকিৎসা করেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের এক ভদ্রলোক, তিনি বাঘের কামড়ের বনজ চিকিৎসা জানতেন। পুরা তিন মাসে তিনি ভাল হন, কিন্তু ঘা শুকিয়ে চামড়া কুঁচকানোর ফলে বাবার সুন্দর চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। তিনি পুরা মুখ হা করে ভাতের নওলা মুখে দিতে পারতেন না, অতিকষ্টে নরম ও তরল খাবার খেতেন। সামনের দুই পায়ের থাবায় অবিশ্বাস্য শক্তি ধরে বাঘ, চকিতের মধ্যে বাবার মাথায় একটা থাবা মারতেই খুলির অংশ, কান, চোয়ালের মাংসপেশী সব আলগা হয়ে যায়।

বারো দিন পরে বাবার জীবনের আশঙ্কা দূর হয়। আমাদের শিকারী পরিবার, তাই গোলখালীর বাঘ মারার জন্যে আমাদের দায়িত্ব চলে যায়নি। তাছাড়া সুন্দরবনের মহাবীর মেহের গাজীকে তার ভাইসহ জখম করেছে গোলখালীর বাঘ, এখন তার চূড়ান্ত মোকাবিলা না করে আমরা পারি না, কেন না পরিবারের সকলেই আমরা বন্দুক ধরতে জানি।

বারো দিনের দিন আমার ছোট দাদা, অর্থাৎ বাবার চাচা, ইসমাইল গাজী এবং আমার দুই চাচা আতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী গোলখালী রওনা হলেন, আমিও সঙ্গে চললাম। কপোতাক্ষী পার হয়ে সেই গ্রামে গিয়ে দাদা কিছুক্ষণ গ্রামবাসীগণের সঙ্গে কথা বলে বাঘের সন্ধান নিলেন। মানুষখেকো বাঘ সেই বারো দিনে আরো একজন মানুষ ও দুইটা গরু খেয়েছে। গ্রামের কেউ মৃতদেহ বা বা গরু গ উদ্ধার করে আনতে পারেনি যদিও বন্দুকসহ দল বেঁধে গিয়ে তারা কিন্তু চেষ্টা করেছিল। ছল। এর মধ্যে একজন একদিন দুপুর বেলা বাজার থেকে ফিরার পথে দূরে হুদোবনের ভিতরে বাঘের গোঙানি শুনতে পেয়েছিল, সে প্রাণভয়ে ছুটে কোনরকমে বাড়ী ফিরে আসে।

যতদূর ধারণা করা গেল, বাঘ তখনো গোলাখালী গ্রামেই ছিল, জখম শুকায়নি- যদি গোঙানীর আওয়াজ শোনার কথা ঠিক হয়ে থাকে। বাবা ও চাচাকে কামড়ানোর পরে গ্রামবাসীরা তো বটেই শিকারীদের মধ্যেও এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে হদোবনে বাঘের অবস্থান জানা সত্ত্বেও কেউ আর সেই বাঘ মারার জন্যে কাছে যেতে সাহস পায়নি।

মৃত্যুরূপ মানুষখেকোর উপস্থিতি সত্ত্বেও এর মধ্যে গ্রামবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু দৈনন্দিন কাজ-কাম শুরু হয়েছিল। হাট-বাজার, কৃষিকাজ ও চলাফিরা না করে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তখন সকলেই যার যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত এবং প্রাণে ভয় বহন করে তারা রাত্রে ঘুমানোর চেষ্টা করত। যাই হোক, গ্রামবাসী সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে বিকাল তিনটার সময়ে দাদা আমাদের নিয়ে হুদোবনে নামলেন।

সবার আগে দাদা ইসমাইল গাজী, তাঁর হাতচারেক পিছনে প্রায় পাশাপাশি আমার দুই চাঙ্গ, অতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী, তাঁদের তিনজনের হাতেই বন্দুক, এবং তাঁদের ঠিক পিছনে খালি হাতে ছিলাম আমি। যেখানে বাঘ বাবা ও চাচাকে আক্রমণ করেছিল দাদা সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে আগে সেই কেওড়া গাছটার তলায় গেলেন, দুই চাচা দুই দিকে বন্দুক ধরে দাঁড়ালেন, দাদা গাছের গোড়ার চারদিকে ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে আমিও রাঘের অসংখ্য পারা দেখতে লাগলাম।

মানুষখেকো হোক আর সাধারণ হোক, বাঘমাত্রই অতি চঞ্চল জন্তু, এক জায়গায় বেশীক্ষণ শোবে না বা ঘুমাবে না, কেবল হাঁটাহাঁটি করবে। কেওড়া গাছের চারপাশে হাত দশ-বারো জায়গার মধ্যেই সম্ভবতঃ গত দুই দিনে বাঘ বার বার শুয়েছে ও হেঁটেছে, চিহ্ন থেকে তা বুঝতে পারলাম। এখনো বাঘ নিশ্চয়ই এই গাছটার পোয়া মাইল এলাকার মধ্যেই রয়েছে।

এক পা এক পা করে এগুতে লাগলাম। আমরা চারজন আগ বাড়তে যতটুকু শব্দ হচ্ছিল চারটা পিঁপড়া হেঁটে গেলেও সম্ভবতঃ তার চেয়ে বেশী আওয়াজ হত না। ঝানু শিকারী দাদা একটি একটি করে হুদো কাত করে উদ্যত বন্দুকটা হাতে পথ করে এগুচ্ছিলেন-তাঁর পরিণতির দিকে, আর পিছনে আমরা। দক্ষিণমুখে পঞ্চাশ হাতের বেশী যাইনি, হঠাৎ দাদার ডানপাশে কয়েকটা হুদোগাছ খাড়া হয়ে উঠল, দাদা বন্দুক ঘুরানোর আগেই ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ তাঁর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল । মাত্র চার হাত পিছনে চাচারা দুইজন দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু করতে পারলেন না, দাদাকে মেরে বাঘ বিজলীর মত অদৃশ্য হয়ে গেল। এত কাছে থেকেও আমি গর্জন শোনলাম, বাঘ দেখলাম না। সামনে ছুটে গিয়ে দেখি হুদো ঝোপের উপরে দাদার লাশ পড়ে আছে, মাথার একদিক কামড়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে বসে গেছে, রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জোড়া একটিমাত্র কামড়ে অন্ততঃ বিশটি বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতা অর্জনকারী খ্যাতনামা শিকারীর জীবনাবসান হল।

দাদার লাশ বহন করে, গোলখালীর লোকদের আরও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে আমাদের গ্রামে ফিরতে হল, বেবাক বাড়ীতে হাহাকার পড়ে গেল। দুর্বল এবং তখনো শয্যাগত বাবা আহত যোদ্ধার মত মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পর মুহূর্তে ইসমাইল গাজীর চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা বুকে ধরে শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন।

চারপাশের কয়েক মাইল এলাকার মধ্যে এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ল যে, শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো বাঘ মারার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। অনেকে, বিশেষ করে মেয়েলোকেরা, বিশ্বাস করেই বলতে লাগল যে, এটা বাঘ নয়, বাঘের রূপ ধরে এক নরখাদক প্রেতাত্মা এসেছে, বন্দুকের গুলি তার গায়ে লাগে না।

কিন্তু দীর্ঘদিনের ভয়ার্ত লোকে যাই বলুক না কেন, আমরা তো জানতাম যে সেটা বাঘ, হুদোবনের গভীর আচ্ছন্নতা ও আত্মগোপনের অবাধ সুযোগ পেয়ে এতদিন ধরে ক্রমাগত মানুষ মেরে যাচ্ছে। কোন না কোন শিকারীর গুলিতে একদিন সে মারা পড়বেই, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আর কে আছে যে তাকে মারতে যাবে?

দাদার মৃত্যুর পরও ষোল দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যে গোলখালী গ্রামের আরও একজন মানুষ মারা পড়েছে। বনে আমরা সেই খবর পাই। গরু ‘কয়টি গেল তা জানার মত মানসিক অবস্থা আর আমাদের ছিল না। ততদিনে বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে একটু একটু হাঁটতে পারেন। কিন্তু হেঁটে আর কোনখানে নয়, কেবল তাঁর চাচা ইসমাইল গাজীর কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন।

হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা বাবা ডাকলেন আমাকে। কাছে যেতেই মাকে ইশারা করলেন বন্দুক বের করতে। মা দোনলা গাদা বন্দুকটি বের করে দিতেই বাবা সেটি আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘ধর!’ দুই হাতে বন্দুকটি নিয়ে সামনে দাঁড়ালে তিনি বললেন, ‘যাও, তুমি ছাড়া আর কেউ এই বাঘ মারতে পারবে না।’ সুন্দরবনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঘ শিকারী, আমার বাবা মেহের গাজী তাঁর জীবনের হাতিয়ার ও অন্তরের দোয়া আমাকে দিলেন।

হাতে আন্দাজ করে বারুদ দিয়ে বললেন, ‘ভর।’ আমি বারুদ তরলাম। পাট নিজ হাতে দলা স্করে দিয়ে বললেন, ‘ভর।’ পাট ভরলাম। তারপর গণে গণে ছররা দিলেন, আমি ছররা ভরলাম, সবশেষে আবার পাটের দলা ভরলাম, ক্যাপ পকেটে নিলাম; ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যখন বাড়ী থেকে গোলখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম তখন বেলা আন্দাজ দুইটার কাছাকাছি। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঘরের বারান্দায় মার কাঁধে ভর দিয়ে বাবা আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন।

আমার বয়স তখন আঠারো-উনিশ বছর। বাবা ও চাচার সঙ্গে গিয়ে ইতিমধ্যে আমি চারটি বাঘ মেরেছি, কিন্তু তাদের কোনটিই মানুষখেকো ছিল না, ছিল সাধারণ বাঘ। শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো শিকার করতে বাবা ও দাদার সঙ্গে যে দুইবার গিয়েছিলাম, প্রতিবারেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি আর এবার জেদী বাপের হুকুমে বলতে গেলে অনভিজ্ঞ আমি যাচ্ছি গোলখালীর বিভীষিকার মোকাবিলা করতে। কিন্তু তবু আমার মনে কোন ভয় ছিল না, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন বাঘকে ভয় করলে আমাদের চলে না।

বেলা চারটায় গোলখালী পৌঁছলাম। গিয়েই শোনলাম, গতরাত্রে বাঘ এক গৃহস্থের গোহাল থেকে একটি বাছুর নিয়ে গেছে। গোহালের দরজা খোলা ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে বাছুর মুখে তুলে প্রায় দুই আনা মাইল দূরে হুদোবনে গিয়ে খেয়েছে। রাত্রে বাড়ীর লোকেরা বাঘের কোন গর্জন শোনেনি, কোন আওয়াজও পায়নি, সকালে গোহালে গিয়ে বাঘের পারা ও রক্ত দেখতে পেয়েছে।

সেদিন গোলখালীতে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং আরো দুইজন শিকারী ছিলেন; তাঁরা গোলখালী গ্রামের আরো একজন বন্দুকধারীসমেত গিয়ে হুদোঝোপের ভিতরে আধা-খাওয়া বাহুর খুঁজে পান। তারপর আর অগ্রসর না হয়ে রাত্রে বাছুরের উপরে বসবেন স্থির করে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন।

আমি যেতে এবার মোট শিকারীর সংখ্যা হল পাঁচ, যদিও তখন পর্যন্ত সত্যিকারের শিকারী আমি হইনি। আমরা স্থির করলাম যে, বাঘের সম্ভাব্য আসার পথে এবং আধা- খাওয়া বাছুরের উপরে বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে আমরা বসব।

বেলা পাঁচটার সময়ে প্রায় বিশ-পঁচিশজন সাহসী গ্রামবাসীসহ আমরা হুদোবনে ঢুকলাম। যেখানে নিয়ে বাছুর খেয়েছে সেখানে হুদোঝোপ ছিল অপেক্ষাকৃত পাতলা। বাছুরের প্রায় চার আনা খেয়েছে, কাজেই রাঘ রাত্রে যে আবার আসবে তা একেবারে নিশ্চিতই; কোনরকম বাধা না পেলে বাঘ তার শিকারের কিছুই ফেলে না।

হুদোবন একটানা নীচু হলেও কোথাও একটি-দুইটি, কোথাও একসঙ্গে কয়েকটি, এ রকম বড় গাছ ছিল। অন্যান্য শিকারীরা কেউ একা, কেউ একজন সঙ্গী নিয়ে যাঁর যাঁর সুবিধামত গাছে বসলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বন বিভাগের কপোতাক্ষী অফিসের ডেপুটি রেঞ্জার, কপোতাক্ষীই গোলখালী থেকে নিকটবর্তী বন অফিস। আমি বসলাম বাছুরটা থেকে প্রায় পনের হাত দূরে এক কেওড়া গাছে। ছোট ভাই আমার নির্দেশমত আমার মাথার হাতচারি উপরে বসে গাছের ডালের সঙ্গে তার কোমর বেঁধে নিল আর মাটি থেকে নয় হাত আন্দাজ উপরে যেখানে আমি বসলাম সেখান থেকে কয়েকটি ডাল একসঙ্গে বের হয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ ভাল আড়াল করেই বসতে পারলাম। আমরা শিকারীরা সবাই গাছে উঠে বসলে ডেপুটি রেঞ্জার সাহেবের নির্দেশে গ্রামবাসী লোকজন সবাই হৈ-চৈ করতে করতে যার যার বাড়ীতে চলে গেল।

চারজন শিকারী নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী গাছে বসেছিলেন; বাঘ আসার সম্ভাব্য দিক অনুমান করে এবং বাঘ দেখার ও গুলি করার সুবিধা বিবেচনা করে একজন থেকে আরেকজন প্রায় পঞ্চাশ-একশ হাত দূরে দূরে ছিলেন। আমি যে বাছুরটার মাত্র পনের হাত দূরে কেওড়া গাছে বসেছিলাম তা ছিল একেবারেই ঘটনাক্রমে, আমার কোন বিশেষ পছন্দ অনুযায়ী নয়; আর কোন শিকারীই সেই গাছে বসেননি। শষ পায়না জানাযারীচুরটা তখন আমার গাছ থেকে দক্ষিণে; আমার পিছনে, অর্থাৎ উত্তর দিকে, গোলখালীর শেষ বসতবাড়ী-বাছুর যার সেই গৃহস্থের বাড়ী, আমার গাছ থেকে তার ঘরের চাল দেখা যাচ্ছিল। বাছুরটা থেকে হাত তিরিশ দক্ষিণে একটি ছোট্ট খাল ছিল আর, আগেই বলেছি, সমস্ত জায়গাটা ছিল একটানা হুদোবন, হাঁটু সমান, কোথাও কোমর সমান, স্থানে স্থানে কেবল বিচ্ছিন্ন বড়-মাঝারি গাছ।

শিকারীরা কে কোন ‘গাছে ছিলেন তা প্রত্যেকেরই জানা ছিল। বাঘ সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় দক্ষিণ দিক থেকে আসবে, সে আন্দাজেই সবাই গাছ বাছাই করেছিলেন। আর এই রাত্রে যদি আসে তাহলে পাঁচজনের যে কোন একজনের হাতে মারা পড়বে, অন্ততঃ আরেকটা গুলি খাবেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত শিঙের গোলখালী গ্রামে ও হুদোবনে অন্ধকার নেমে এল। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, গ্রামে একটি বাতিও জ্বলে না।

অন্ধকার ও নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রায় একঘন্টা সময় কাটলে তখন পূব আসমানে ভরা চাঁদ উঠল, আর আলোর সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্য দিয়ে যেন একটা শিহরণ খেলে গেল; প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হুদোবন লণ্ডভণ্ড করে বাতাস ছুটল। এর ফলে একটা অসুবিধা দেখা দিল যে, বাঘ কাছাকাছি এলেও আমরা তার আওয়াজ শুনতে পাব না, এক চাঁদের আলোর উপরে নির্ভর করতে হবে, কিন্তু আলো তখনো তীর্যক ছিল বলে বাছুরটার কাছে যথেষ্ট ছিল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ধীরে ধীরে বাতাস থেমে গেল, তখন আবার পাতা নড়ার শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম। আন্দাজ নয়টার সময়ে অনেক দূরে টাই। টাই। করে হরিণের ডাক শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম, কিন্তু তার পরেই আবার নীরবতা। দশটার দিকে বন ফাটিয়ে চাঁদ এল প্রায় মাথার উপরে। সে আলো এত প্রখর ছিল যে পনের হাত দূরে অর্ধভুক্ত বাছুরটার ছাটনার হাড় পর্যন্ত আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। উজ্জ্বল আলোতে পরের দুই ঘণ্টা নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমি যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে বাঘ আর আসবে না, ঠিক তখন, রাত প্রায় বারোটার সময়ে, দক্ষিণের ছোট্ট খালে ঝপ্! ঝপ্! করে দুইবার শব্দ হল। দীর্ঘ প্রতীক্ষারত আমার কাছে সেই শব্দ কত বড় আকাঙ্ক্ষিত যে ছিল তা গভীর বনে মানুষখেকো বাঘ শিকার করেননি এমন কাউকে বুঝানো যাবে না; এক মিনিট পরে ঝক্ককা আলোতে আমি বাঘের পুরা শরীর দেখতে পেলাম। মরা বাছুরটা থেকে হাত দশেকের মধ্যে এগিয়ে এসে থামল, বসল, আবার উঠে ডানদিকে বামদিকে মুখ ঘুরিয়ে, বাছুরটার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। চটাৎ করে একটি অতি ছোট্ট শব্দ হতেই বাঘ সেদিকে ফিরে চাইল, তখন আর একটুও দেরী না করে আমি বুক বরাবর ট্রিগার টানলাম। বিকট একটা গর্জন করে বাঘ পিছনে ছিটকে পড়ল এবং চক্ষের পলকে হুদোঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। পরের আধা মিনিট পর্যন্ত আমি কেবল বাঘের গোঙানী আর চার পায়ের দাবড়া-দাবড়ি শুনতে পেলাম এবং তখন, কোন শিকারী যে কাজ হয়ত কখনো করতেন না, মুহূর্তের বিবেচনায় আমি তাই করে বসলাম; শব্দ লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি করলাম। পরের ছয় ঘন্টা আমরা সবাই গাছেই বসে রইলাম। চাঁদ ডুবে গেল, পূবের আকাশ ধলা হয়ে উঠল এবং দূরে একসঙ্গে কয়েকটি পাখী ডেকে উঠল। আমি, আমার ভাই বা শিকারীদের মধ্যে কেউই তখনো পর্যন্ত নিশ্চিত জানতে পারিনি যে বাঘ মরেছে না কি আবার হুদোবনেই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সূর্য উঠলে তখন চারজন শিকারী গাছ থেকে নেমে অতি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে এলেন। আমিও নামলাম। সঙ্গীদের পিছনে থাকৃতে বলে আমরা পাঁচজন শিকারী একসঙ্গে বাঘ সন্ধান করতে অগ্রসর হলাম যদিও আমার গাদা বন্দুকে তখন আর গুলি ছিল না। মাছির ভণ ভগ্ন কানে আসতেই বুঝলাম যে গুলি রাত্রে ঠিকই লেগেছে, এবং একটু পরে বাঘ টেনে খোলা জায়গায় আনার পরে দেখলাম যে আমার দ্বিতীয় গুলিও বাঘের পাঁজরেই লেগেছে।

সেখানেই মাপা হলঃ সাড়ে দশ ফুট লম্বা বুড়া বাঘ। যে ‘চটাৎ!’ শব্দের জন্যে আমি বাঘের বুকে গুলি করার সুযোগ পেয়েছিলাম সেটা ছিল জোংড়ার মুখ খোলার আওয়াজ। রাত্রির নীরবতায় শামুকের অত ছোট্ট শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম আধ ঘন্টার মধ্যে শিঙের গোলখালী গ্রাম শূন্য করে মেয়ে-পুরুষ-ছেলে-বুড়া বেবাক লোক হুদোবনে ছুটে এল, চীৎকার, গালিগালাজ, ক্রোধ প্রকাশ ও উল্লাসধ্বনি করতে করতে তারা বাঘের চার পা বেঁধে বয়ে নিয়ে এল সেই গৃহস্থের বার বাড়ীতে। দীর্ঘদিনের ত্রাস সৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর হিংস্র শত্রুর নিধনের আনন্দ এবং পুত্রহারা পিতামাতার হাহাকারে শিঙের গোলখালী গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

শিকারী ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, গোলখালী গ্রামবাসীদের আন্তরিক সহায়তায় কপোতাক্ষী নদী পার করে বাঘ আড়াই মাইল দূরবর্তী সোরা গ্রামে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এলাম।

বাড়ীতে আমরা সবাই মিলে আমাদের উঠানে গোলখালীর বাঘের চামড়া ছোলাই করলাম। আগেই বলেছি যে বাঘটা ছিল বুড়া, কয়েকটা দাঁত ছিল না, বাবার গুলি বাঘের কাঁধের নীচে চামড়া ও অনেকখানি গোস্ত ভেদ করে গিয়েছিল এবং পচন ধরেছিল, সেখানেই মাছি ভণ ভণ করছিল।

এই আমার জীবনের প্রথম মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী। বন দফতরে গোলখালীর বিভীষিকা এই বাঘের চামড়া জমা দিয়ে পুরস্কারের তৎকালীন ৩০০ টাকা পুরাপুরি এনে আমি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বাবা তখনও শয্যাগত, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন।

 

হুমায়ুন খানের অনুলিখনে পচাব্দী গাজীর স্মৃতিকথা অবলম্বনে এই রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024