শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-১১)

  • Update Time : শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

বিজ্ঞান ক্লাসের সুবোধ স্যার সবসময় একটা বেত নিয়ে হাঁটেন স্কুল প্রাঙ্গনে। এখনকার শিক্ষকরা সবাই বেত ছেড়ে দিলেও তিনি কেন এটি নিয়ে স্কুলের আঙিনায় ঘুরাঘুরি করেন তা কেউ বলতে পারে না। প্রধানশিক্ষিকা রওশন আরা বেগম বেশ কবার উনাকে সতর্ক করার পরও কিছু হয়নি।

এ স্কুলের পুরনো শিক্ষক তিনি। কিছুতেই এই পুরনো অভ্যাসটি ত্যাগ করতে রাজি নন। জনৈক সহকর্মীকে তিনি বলেছেন,‘এই বেত হইল শিক্ষককূলের গর্বের প্রতীক। একে ছাড়া যাবে না। এই বেত খাইয়া অনেক অমানুষ মানুষ অইছে। অহন ইয়োরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত অইয়া এরে অস্বীকার করলে অইব ? সবাই করুক, আমি এর মধ্যে পড়ি না।’

‘এইডা তো মেয়েদের ইশকুল, স্যর। ’

‘হউক গা। আমি বেতওলা সুবোধ স্যার। যদ্দিন বাঁচুম আমি এমনই থাহুম।’ চোখেমুখে ফুটে ওঠে তীব্র জেদ আর অহংকার।

সেই সুবোধ স্যরের শ্রেণিকক্ষেও তুষ্টির শান্তি নেই। স্যার ঘুরেফিরে তুষ্টির কাছে এসে দাঁড়ায়। ওকে লক্ষ্য করে। সহসা পঞ্চাশোর্ধ বেঁটেখাটো এই মানুষটি  ওর কাছে এসে ব্যাঙের মতন  একখানা তিড়িং বিড়িং লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন,‘তুমি কি নিউটন হবা ? মাথার উপর কবে আপেল নাইলে গয়াম পড়ব আর তুমি দুনিয়ারে  বুঝাইয়া দিবা, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কারে কয়? অত সোজা ?’

তুষ্টির বুক ধড়ফড় করে। হাতের বেতটা পেতœীর  জিহŸার মতন লকলক করে। ত্রাসে সে সেদিকে তাকাতে পারে না। যদি কয়েক ঘা ওর পিঠেও পড়ে। যদিও স্যর কখনও কোনো মেয়েকে বেত মেরেছেন বলে তুষ্টি শোনেনি, তবু ভয় ওকে বগলদাবা করে রাখে। সে চোখ বুজে ফেলে একরাশ  শঙ্কায়।

‘লেহাপড়া অত সহজ না মাইয়া। বৃক্ষের দিকে, পংখির দিকে চাইয়া পড়ন যায় না। তোমারে একটা সহজ প্রশ্ন জিগাই। কও তো, মানুষ কি দিয়া পৃথিবীর প্রকৃত বয়স পরিমাপ করে ? সহজ প্রশ্ন। বহুবার কইছি এই ক্যালাশে। কও ?’ বলে সুবোধ স্যার ওর মুখের দিকে হ্যা করে তাকিয়ে থাকেন। তার হিটলারি গোঁফের কোনে হাসির রেখা। যেন অনেকদিন পর এক অমনোযোগী ছাত্রীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন।

‘কও, কও দেহি ?’ ফের জিজ্ঞাসা করেন।

‘পারব না, স্যর।’ আমতা আমতা করে তুষ্টি বলে।

সঙ্গে সঙ্গে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন সুবোধ স্যার।  চোখ দুটো নিমিষে লাল হয়ে যায়। প্রচÐ রাগের চোটে চারপাশে মুখের থুতু ছিটিয়ে বলতে শুরু করেন,‘তুমি আস ক্যান ইশকুলে ? তুমারে কেউ দিব্যি দিছে ইশকুলে আওনের ? তুমার মা-বাফরে কও বিয়া দিয়া দিতে। আগের কাল হইলে এই বয়সে দুই-তিনটা ছাওয়ালের মা হইয়া যাইতা। এই মাইয়ারা, আমরা কি দিয়া পৃথিবীর বয়স গণনা করি ?’

‘ইউরেনিয়াম গবেষণা করে, স্যার।’ সমবেতভাবে সবাই উত্তর দেয়, শুধু তুষ্টি ছাড়া।

‘ইউরেনিয়াম কি ?’ সুবোধ স্যরের চেরা গলায় প্রশ্ন।

‘এটা রূপালি-ধূসর রঙের এক প্রাচীন ধাতু। পৃথিবী সৃষ্টির সময় এটি গ্যাসের গোলক ছিল। ধীরে ধীরে পৃথিবী ঠান্ডা হতে শুরু করলে এটাও জমতে জমতে কঠিন মৌলে পরিণত হয়। এর থেকেই আমরা গণনা করে নির্ণয় করি পৃথিবীর বয়স সাড়ে-চারশত থেকে পাঁচশত কোটি বছর।’ চশমা পরা  চৌকশ মেয়ে সিনথিয়া গড়গড় করে বলে গেল সব।

‘ভেরি গুড।’ বলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে স্যার তাকিয়ে থাকেন। একটু পর চোখ ঘুরিয়ে তুষ্টিকে বলে ওঠে,‘ বুঝছ কিছু ?’

‘হ্যা , স্যার। ’

‘মনে থাকে য্যান।’ বলে অন্য পড়ায় চলে যান মানুষটা।

টিফিন আওয়ারে মনমরা তুষ্টি স্কুলের পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ টিফিন খেতে ইচ্ছা করছে না। এই পুকুরটার কাছে একটা ভাঙা ঘরে স্কুলের দপ্তরি থাকে। তার নাম হুসেন মিঞা।

তুষ্টি হুসেন কাকার মেয়েকে টিফিনের বাটিটা দিয়ে বলে ওঠে,‘আমার খেতে ইচ্ছা করে না। তুমি খেয়ে ফেল।’

চার-পাঁচ বছরের আমেনা খুশি হয়ে ওর দেয়া খাবার খেতে শুরু করে। আজ তপতী দুই মেয়ের জন্যে পাঁউরুটি আর ডিম দিেেয়ছে। হুসেন কাকার মেয়ে আমেনা পরম তৃপ্তি নিয়ে সেগুলো নিমিষে সাফ করে ফেলে।

একটু পর চোখ বড় বড় করে সে বলে ওঠে,‘আফা, জানেন, এই পুষ্কনিত ছিকল আছে। আবার ডেকচিও আছে। পূর্ণিমার রাইতে ভাইসা ওঠে। তহন কেউ আশেপাশে থাকলে টাইনা লইয়া যায়। ’

‘তুই জানলি ক্যামনে ?’ তুষ্টি হাসার চেষ্টা করে।

‘আমারে নিবার চাইছিল তো। আমি তো চালাক। তাই পারে নাই। ’

তুষ্টি এবার হেসে ওঠে। মন থেকে বিষণœতার চাপ কেটে যেতে থাকে।

তুষির প্রখর দৃষ্টি পুকুরের ময়লা জলের উপর। পুকুরটা পরিষ্কার হয় না অনেকদিন। পঁচাগলা পাতা আর ডালপালা ভাসছে এর বুকে। মাঝে মাঝে তলদেশ থেকে বুদ্বুদ ওঠে। তখনই তুষ্টি রহস্যের গন্ধ খুঁজে পায় এই জলাশয়ে।  কেন যেন মনে হয় কিছু একটা আছে এর অভ্যন্তরে। যা চামড়ার চোখে দেখা যায় না , হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না Ñ শুধু অনুভবের টর্চলাইট দিয়ে আন্দাজ করে নিতে হয়।

চোখের সামনে শুধু তেলাপিয়া মাছের ঝাঁক। সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলাশয়টার চারপাশে। তুষ্টির চোখের পলক পড়ে না। তাকিয়েই থাকে ঝাঁকঝাঁক মাছের উচ্ছল আনন্দময় চলাফেরার দিকে।

তুষ্টির বড় ইচ্ছা করছে, ওদের সঙ্গী হবার।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024