পালা বদল
‘দিনটা স্কী করার মতো নয় রে। দেখ-না, কেমন ঝড় উঠেছে।’ ‘
উঠুক গে ঝড়।’
‘স্কীয়ের পথগুলো নিশ্চয় বরফে ঢেকে গেছে।’
‘নতুন পথ কাটব আমরা। আমি যাব আগে-আগে। নাও, পোষাক পরো।’ ‘
কালকে গেলে হয় না?’
‘আমি গিয়ে স্কী নিয়ে আসছি, তুমি পোষাক পরে নাও।’ ‘বেশ।’
ছেলে তার জেদ ছাড়লে না। স্কী আনতে গেল সে, আর অনিচ্ছায় জুতো পরতে
লাগল বাপ। ঠান্ডা, কড়া জুতো, পশমের মোটা মোজা পরা পা তাতে কিছুতেই ঢুকতে চাইছিল না। তারপর বহুক্ষণ ধরে ফিতে বাঁধতে লাগল সে, যেন ইচ্ছে করেই সময় নিচ্ছে: ঠান্ডায় বেরতে চাইছিল না।
ছেলে ওদিকে স্কী নিয়ে, পোষাক পরে, এসে দাঁড়িয়েছে পাশেই, অধীর হয়ে এ-পা ও-পা করছে। ‘হল?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘নাও, চলো, বেরই…’
এমন আবহাওয়ায় গরম থেকে রাস্তায় বেরুনো মানে ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দেওয়া: তাপমাত্রার প্রচণ্ড বদলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, কাঁপুনি ধরে গায়ে। চোখ কোঁচকালে বাবা, জোর হাওয়াটা থেকে মুখ ঘোরালে, আর ছেলে সতর্কের মতো দেখতে লাগল তাকে, ভয় হচ্ছিল এই বুঝি তার মত বদলাবে, বাড়ি ফিরে যাবে। বাপ কিন্তু ততক্ষণে বসে স্কী লাগাতে শুরু করেছে জুতোয়।
‘আমি লাগিয়ে দেব?’
‘না, তার দরকার হবে না। বাইন্ডিংটা খুব আঁটো… আবহাওয়া বটে…’
‘হল?’
ভ্রুকুটি করছিল বাপ আর ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল ছেলে।
শেষ পর্যন্ত রওনা দিলে ওরা। ছেলে চলল আগে-আগে। স্কী করার পথ কাটছিল সে, যেভাবে বরফ-ভাঙা জাহাজ সমুদ্রে বরফ ভেঙে পথ করে দেয় ভারি ভারি জাহাজের। তাড়াতাড়ি করছিল সে, অনাবশ্যক দেহভঙ্গি করছিল অনেক। আর রক্ত গরম হয়ে উঠে নিশ্বাসের কষ্টটা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত বাপ গুরুভার ভঙ্গিতে এ-পায়ে ও-পায়ে ভর দিয়ে কী করছিল।
‘ঝড়ে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না!’ ঘাড় ফিরিয়ে চে’চাল ছেলে, ‘এ বরং আরো ভালো।’
বাপ কোনো জবাব দিলে না। দম রাখার চেষ্টা করছিল সে। তুষার-ঝড় বইছিল ডান দিক থেকে; তার হিমেল ছোঁয়ায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে থুতনি। কী দায় পড়েছিল এমন আবহাওয়ায় বনে যাওয়ার!
খোঁচা খোঁচা তুষার-কণার ঝাপটা থেকে মুখ বাঁচাবার জন্যে ঘাড় নিচু করে চী করছিল বাপ। দেখতে পাচ্ছিল শুম্ভু চকচকে দুটো ফালি ছেলের পাতা ফাঁ- পথ। আর মাঝে মাঝে যখন মাথা তুলছিল, চোখে পড়ছিল ছেলের লম্বাটে, সামান্য নিচু-হওয়া বরফমাখা মূর্তি’, এপাশ-ওপাশ দুলছে, ক্লান্তি নেই। মনে হবে যেন ওকে না থামালে ছেলেটা এক নিশ্বাসে তুষার-ঢিবি ভরা মাঠ বন পেরিয়ে সোজা এগিয়ে যাবে।
বাপ পেছিয়ে পড়ছে কিনা দেখবার জন্যে ছেলেটা মাঝে মাঝে ফিরে চাইছিল আর তখন তুষার-কণা জমা চোখের পাতার তল থেকে আনন্দে জলজ,লিয়ে উঠছিল চোখ।
বাপের জন্যে। বাপ আসতে ছেলে বললে:
এই ভাবেই ওরা পৌঁছল খাদ পর্যন্ত। ছেলে সেখানে থেমে অপেক্ষা করলে ‘আর তুই?’
‘এখান দিয়ে যেও না। ওই দিকে বাঁয়ে আছে নামার মতো ঢালু জায়গা।’
‘আমি কিন্তু এখান দিয়েই যাব।’
ছেলের দিকে চাইলে বাপ। এই সেদিন, বছর পাঁচেক আগে ওকে কী করতে শেখানোর কথাটা মনে পড়ল তার। ছেলে যাতে পড়ে না যায়, আঘাত না লাগে, তার জন্যে অল্প উচু একটা ঢিবি বেছেছিল সে। ছেলে কিন্তু আপত্তি করলে: ‘আমি তো আর ছোটো নই!’ জিদ ধরেছিল উ’চু ঢিবি বেয়ে নামবে। সে ছেলে এখন লম্বা হয়ে উঠেছে, ঠোঁটের ওপরে দেখা দিয়েছে গাঢ় রোঁয়া। বাপকে সে বলছে: ‘বাঁয়ের দিকে আছে নামার মতো ঢালু জায়গা’। কী বলবে সে ছেলেকে? ‘আমি এখনো বুড়ো হই নি’? কিংবা ওই ধরনের কোনো কথা?
আপন মনে হাসলে বাপ। ছেলের অপ্রত্যাশিত অভিভাবকত্বে খুশি লাগল তার, শান্ত হয়ে এল মন। হালকা লাগল তার গোটা শরীর, ইচ্ছে হল ঠিক এই খাড়াই পাড় দিয়েই সে নামবে। জোরে সে চেপে ধরল স্কীয়ের লাঠি, ঝাঁকে পড়ল সামনে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরপাক খেয়ে গেল তুষার-কণার বেঘোর ধবল ঘূর্ণিপাকে। আপনা থেকেই বুজে এল চোখ, হাত এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পর মুহূতেই আর টাল সামলাতে পারল না। পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই পাশে এসে দাঁড়াল ছেলে।
‘লেগেছে?’
‘মা-না… কিছু হয় নি।’
বাপকে সে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলে, বরফ ঝাড়তে লাগল দস্তানা দিয়ে।
‘কেন আসতে গেলে এখান দিয়ে?’
‘তাতে কী হয়েছে?”
‘আমি তো বলেইছিলাম যে বাঁয়ের দিকে নামার মতো ঢালু আছে। যাক-গে চলো এগোই।’
যে-পায়ের ওপর পড়েছিল সেটা ব্যথা করছিল। কিন্তু বাপ চাইছিল না সেটা ছেলের নজরে পড়ে। তাই তাড়াতাড়ি করে বললে:
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, চল যাই, তুই সামনে এগো।’
অবলীলায় এগিয়ে গেল ছেলে, যেন ভেসে গেল বাতাসে, লম্বা দোলায় ঘন-ঘন হাত নাড়ছিল ডানার মতো, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি যদি সে একটা ভালো স্পীড নেয়, তাহলে মাটি ছেড়ে উড়ে যাবে কালো কালো ছুঁচলো-ডগা ফার গাছগুলোর ওপর দিয়ে।
সাবধানে বাপ তার দেহের ভার সরিয়ে আনলে অনাহত পা-খানার ওপর, লগি দিয়ে স্কী ঠেলার বদলে বরং তা লাগাচ্ছিল ঠেকা দেওয়ার কাজে। এগুতে অসুবিধা হচ্ছিল ওর, ব্যথা করছিল। তুষার-ঝড় কমে এসেছে। হিমেল শাদা মসলিন জড়িয়ে গেছে গাছের গুঁড়িতে, ঝোপঝাড়ের ডালপালায়। ফার গাছের কেশর থেকে তুষার উড়িয়ে ফেলছে না বাতাস। শান্ত হয়ে এসেছে বন।
সত্যিই বাঁদিকে যেখানে ঢালু ছিল সেখান দিকে এলেই ভালো হত নাকি? সে কথা ভাবতেই তার রাগ হল নিজের ওপর, ছেলের ওপর সে ছেলে অনায়াসে, যেন দেহের ভার মুক্ত হয়ে পিছলে যাচ্ছে তুষারের ওপর দিয়ে, পেছনে বাপ কী ভাবে হাঁকপাঁক করে আসছে তাতে তার কিছুই এসে যায় না।
ভাবনাটা যেন টের পেয়েই থেমে গেল ছেলে। মুখ না ফিরিয়েই বললে:
আরে, ওই শোনো।’
বাপ থেমে গিয়ে কান খাড়া করলে। ‘
মাথা নাড়লে বাপ। নিজের বুকের শব্দ ছাড়া আর কিছুই সে শুনছিল না। ‘টুপির ফিতেটা খুলে ফ্যালো,’ পরামর্শ দিলে ছেলে।
শুনতে পাচ্ছ?’
দস্তানা খুলে বাপও বাধ্যের মতো আলগা করে দিলে টুপির ফিতে। সঙ্গে সঙ্গেই কান তার ভরে উঠল অজস্র ছোটো ছোটো ঘণ্টার চঞ্চল শব্দে। বাতাসের শন-শন আর বুকের চিপ-ঢিপ চাপা দিয়ে তা বাজছে সবকটা স্বরগ্রামে।
‘কোথায় রে?’
‘ওই ফার গাছটায়।’
পিরামিড আকারের যে উচু ফার গাছটার সামনে ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ, কাঁচকে বাপ তাকাল সেদিকে। ডালগুলোর ওপর অসংখ্য চটপটে ছোটো ছোটো পাখি দেখতে পেলে সে। ক্রমাগত সেগুলো এ-ডালে ও-ডালে লাফালাফি করছে আর ঘণ্টাধ্বনির মতো কাকলি তুলছে একটু করে।
‘জানো এগুলো কী পাখি?’ জিজ্ঞেস করলে ছেলে।
বাপ মাথা নাড়লে।
‘ছেয়ে গাইচুকা,’ বললে ছেলে, ‘চলো যাই।’
টুপির ফিতে বাপ আর বাঁধলে না। কান পেতে রইল, অমনি একটা ফার গাছ আরো পড়ে কিনা। কিন্তু হাঁটাপথটা বরাবর ফার গাছগুলোই সবই শব্দহীন। তাছাড়া ব্যথা করছিল হাঁটুতে। যাচ্ছিল সে মাথা নিচু করে, চেষ্টা করছিল যথাসম্ভব
সুস্থ পা-টা চালাতে।
হঠাৎ ওর খেয়াল হল ছেলে থেমে গেছে, লক্ষ করছে ওকে। ‘হাঁপিয়ে গেছ?’ বাপকে চাইতে দেখে জিজ্ঞেস করলে ছেলেটা।
‘উ’হ’, আর তুই?’ মৃদু হাসলে। তারপর বললে:
জবাব না দিয়ে ছেলে ‘তুমি এখানে, এই পথটায় একটু দাঁড়িয়ে থাকো। ইচ্ছে হলে সিগারেট খেয়ে নাও।’ বাপ দাঁড়িয়ে রইল আর স্কীয়ের তলে ফাঁয়ো-ফায়ো উ’চু তুষার-স্তূপ দলিত করে বনের গভীরে চলে গেল ছেলেটা। লগিতে ভর দিয়ে বাপ চেয়ে রইল সেদিকে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝলক দিচ্ছিল ছেলের কাঁজো-পানা মূর্তিটা। কাঁ যেন খুজেছিল ছেলেটা। তারপর এক জায়গায় থেমে গিয়ে উবু হয়ে বসে বরফ সরাতে লাগল হাত দিয়ে।
‘কী খুজেছিস? চে’চালে বাপ, ‘গুপ্তধন নাকি?’ ‘হ্যাঁ।.. তুমি একটু জিরিয়ে নাও।’
বকের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে রইল বাপ, জখম পা-টায় আলগা দিলে। ব্যথা করছে হাঁটুতে, জলছে।
কিছুক্ষণ পরে ছেলেকে দেখা গেল হাঁটাপথটার ওপর। দস্তানা চেপে রেখেছে দাঁত দিয়ে, স্কীয়ের লগি বগলে। ঠান্ডায় লাল-হয়ে-ওঠা দু’হাত অজলি করা। তাতে করে কাঁ যেন দিয়ে আসছে সে, নিয়ে আসছে সাবধানে, প্রদীপ নিয়ে আসার মতো। বাপের কাছে এসে সে হাত বাড়িয়ে দিলে। তাতে বেগুনী একটি বিন্দু।
‘কী এটা?’
‘ভায়োলেট ফুল।’
তাকিয়ে দেখলে বাপ। সুতোর মতো সরু সবুজ বোঁটায় ছোট্ট তাজা একটি ফুল।
‘কোথেকে খুঁড়ে তুললি?’
‘ফার গাছের নিচে, বরফ থেকে। আরো নিয়ে আসতে পারি।’
‘থাক, দরকার নেই। দস্তানা পরে নে, হাত তোর জমে গেছে।’
‘ছাই! নাও এটা।’
সাবধানে ফুলটা নিলে বাপ। তুলে ধরলে চোখের কাছে, তারপর মুখ দিয়ে ফাঁ দিলে, ঠান্ডা পাপড়িগুলো একটু গরম হোক।
‘শীতকালে তুমি ভায়োলেট খোঁজো নি কখনো?’ হাতে দস্তানা টেনে চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করলে ছেলেটা।
‘না।’
কিছুই বললে না ছেলে। লগি হাতে নিয়ে আন্তে ঠেলা মারলে। আর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল বাপ, ভেবে পাচ্ছিল না ভায়োলেটটা নিয়ে কী করবে, জখম পায়ে ভর দেবারও সাহস হচ্ছিল না। ওর মনে হল, এই বুঝি ছেলেটা চিরকালের মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে, ও পড়ে থাকবে একলা। মূহর্তে’র জন্যে একটা তিক্ত
জন্মালায় আচ্ছায় বোধ করে সে। ‘কী হল বাবা?’ মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলে ছেলেটা।
‘কিছু না, কিছু না,’ তাড়াতাড়ি জবাব দিলে সে, ‘এক্ষুনি আসছি… কিন্তু
ফুলটা রাখি কোথায়?’
‘ঠোঁটে চেপে রাখো,’ বলে এগিয়ে গেল সে।
চলছিল ও হেলে দুলে, যাতে তার পাল্লা ধরতে বাপের অসুবিধা না হয়। বাপও খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল তার পেছ-পেছ। লম্বা-হয়ে-ওঠা কংজো-পানা এই যে ছেলেটা তাকে পাখির গান শুনিয়ে, বরফ থেকে ভায়োলেট ফুল তুলে দিয়ে, পেছন- পেছন আসতে যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্যে ধীরে ধীরে চলে তার যন্ত্রণা ভোলাবার চেষ্টা করছে, তার প্রতি একটা নতুন অনুভূতি টের পেল সে। জীর্ণ জুতো, না-ধোয়া হাত, কম-পাওয়া নম্বরের অভ্যন্ত জগত থেকে সহসা বেরিয়ে এসে ছেলে বাপের সামনে দাঁড়িয়েছে একটা আশ্চর্য’ নতুন আলোয়, বরফের মধ্যে ফুলটার মতোই যা ভারি অপ্রত্যাশিত। ‘হাঁপিয়ে যাও নি তো বাবা?’
‘তাড়াতাড়ি করার দরকার নেই। প্রায় এসে পড়েছি। ঝড়ও কমে এসেছে।’
‘না।’
বন থেকে বেরিয়ে তারা এবার যেতে লাগল সমতল মাঠের ওপর দিয়ে। একজন সংযত করে রেখেছে তার উদ্দাম ধাবন, অন্যজন খোঁড়াচ্ছে তার জখম পায়ে।
বাড়ির কাছে এসে বাপ বললে: ‘কাল ফের ক্ষী করতে যাব, কী বলিস?’
‘কাল হবে না,’ বললে ছেলে, ‘কাল আমরা ছেলেরা যাব দল-বে’ধে।’
‘তাহলে অন্য আরেক দিন…’
দোষী-দোষী ভাব করে বাপ হাসলে;
মাটি-ঘে’ষে হালকা একটা বাতাস বইছিল বরফ-ঢাকা মাঠে। মনে হয় সে বরফের গভীরে কোথাও যেন গরম রয়েছে, ভাপ উঠছে তুষার-কণা ফাঁড়ে।
Leave a Reply