রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২২ পূর্বাহ্ন

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৫)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪, ৩.৫৯ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে মসলিনে ব্যবহৃত সুতার সবটুকু সমপরিমাণ মসৃণ ছিলনা, এবং ম্যানচেস্টারের কলে প্রস্তুত সুতার চেয়ে সূক্ষ্মতর হলেও ঐ সুতার চেয়ে অমসৃণ ছিল। জেমস টেলর এর উত্তর দিয়েছেন। তাঁর মতে ইংল্যান্ড বা অন্যান্য দেশে রপ্তানীকৃত মসলিনে সমপরিমাণ সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহার করা হতনা।

উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় ঢাকার মসলিন শিল্পীরা মাঝে মাঝে কম সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহার করে ক্রেতাকে ফাঁকি দিয়ে কিছুটা মুনাফা পূরণ করে নিত। একমাত্র মোগল সম্রাট ও বাংলার নওয়াবের জন্য প্রস্তুত মসলিন ছাড়া আর সকল ক্ষেত্রেই তাঁতিরা কম-বেশী ফাঁকি দিত এবং তাদের ঐ ফাঁকি অন্য কেউ সহজে ধরতে পারত না।ঢাকাই মসলিনের সূক্ষ্মতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জেমস টেলর আরও একটি প্রমাণ দিয়েছেন।

অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তিনি বলেছেন যে, ঢাকাই মসলিনের এক একটি সূতা চুলের মত মনে হয় এবং এটির ব্যাস ১/১০০০ থেকে ১/১৫০০ ইঞ্চি পরিমাণ। পরিশেষে জেমস টেলর বলেছেন যে, ১৮৫১ সালের বিদেশের প্রদর্শনীতে যে মসলিন প্রদর্শন করা হয়েছিল, তা এত সূক্ষ্ম এবং তার সুতা এত মসৃণ ছিল যে, অভিজ্ঞ বিচারকরা তার সবটুকু সুতা সমপরিমাণ সূক্ষ্ম বলে স্বীকার করেছেন।

ঢাকার ফুটী কার্পাস কলের সাহায্যে সুতা তৈরীর উপযুক্ত ছিলনা, অন্য পক্ষে লম্বা আঁশ বিশিষ্ট আমেরিকান কার্পাস থেকে ঢাকার সুতা কাটুনীরা টাকুর ( সুতা কাটার যন্ত্র) সাহায্যে মিহি ও সূক্ষ্ম সুতা তৈরী করতে সক্ষম ছিলনা। ১৮১১ সালে ঢাকাস্থ ইংরেজ বাণিজ্য বিষয়ক কর্মচারী (Commercial Resident) কিছু কার্পাস আমেরিকা থেকে আমদানী করে ঢাকার তাঁতিদের কাছে পাঠান। অনেক চেষ্টা করেও ঢাকার তাঁতিরা সেই কার্পাস থেকে সুতা কাটতে পারেনি এবং তারা একসাথে রায় দেয় যে, আমদানীকৃত আমেরিকান কার্পাস ঢাকার তাঁতে ব্যবহারের অনুপযোগী।

ঢাকাই মসলিনের শ্রেষ্ঠত্বের আরও দুইটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ ঢাকার ফুটী কার্পাসের দ্বারা প্রস্তুত সুতা ধোওয়ার ফলে ফুলে উঠতনা বরং জড়সর হয়ে যেত। তাঁতিদের মতে যে সুতা ধোওয়ার সময় কম ফুলে এবং বেশী জড়সর হয়, সে সুতা উত্তম; ঐ সুতায় প্রস্তুত কাপড়ের বুননী ঘন হয় এবং কাপড় অধিকতর টেকসই হয়। ম্যানচেস্টারের কলে তৈরী সুতা (অর্থাৎ বিদেশী কার্পাসের তৈরী সুতা) ধোলাইয়ের সময় ফুলে উঠত এবং অপেক্ষাকৃত কম টেকসই ছিল। দ্বিতীয়তঃ সুতার সূক্ষ্মতা নির্ভর করত সুতা কাটার সময় কাটুনীদের হাতের টিপের উপর।

সুতা যত বেশী টিপে মোড় (twist) দেওয়া হত তত বেশী সূক্ষ্ম ভাবে তৈরী হত। এ ব্যাপারে ঢাকার সুতা কাটুনীরা অত্যন্ত দক্ষ ছিল। এর জন্য সুতা কাটনীদের আঙ্গুলের ডগার অত্যাশ্চর্য চেতনা শক্তির প্রয়োজন ছিল এবং ঢাকার কাটুনীরা এর জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল।

কাপড় বোনা

উপরোক্ত আলোচনায় অনেকেই হয়তঃ মনে করবে যে, ঢাকাই মসলিনের ভালোত্ব বিচার করত দেশজ কার্পাস বা দক্ষ সুতা কাটুনীদের উপর, কিন্তু তবুও তাঁতিদের অবদান কোন অংশে কম ছিলনা। ভালো সুতা সংগ্রহ করে তাঁত থেকে কাপড় বের হওয়া পর্যন্ত আরও কয়েকটি স্তর আছে; এসব স্তরে  সুন্দরভাবে কাজ শেষ করার পিছনে তাঁতিদের অপরিসীম দক্ষতার প্রয়োজন ছিল। এসব স্তর হচ্ছে- ১। সুতা নাটান (winding and preparing the yarn), ২। টানা হোতান (warping), ৩। সানা বাঁধা (applying the reed to the warp), ৪। নারদ বাঁধা (beaming or applying the warp to the end roll of the loom), ৫। বু-বাঁধা (preparing the heddles or harness), ৬। কাপড় বুনা (weaving)!

সুতা নাটান

সুতা যোগাড় করার পর তাঁতির প্রথম কাজ হচ্ছে, সূক্ষ্মতার পরিপ্রেক্ষিতে সুতাগুলিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে নেওয়া। সূক্ষ্মতম সুতাগুলিকে বেছে নিয়ে, সেগুলিকে আবার সূক্ষ্মতার পরিপ্রেক্ষিতে দুই ভাগে ভাগ করা হয় –১ম ভাগ অর্থাৎ সূক্ষ্মতম অংশ বানায় এবং দ্বিতীয় অংশ টানায় ব্যবহার করা হয়। অতঃপর টানা সুতাকে তিন দিন ধরে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। ঐ পানি আবার দিনে দুইবার বদল করে দেওয়া হয়। চতুর্থ দিনে সুতা পানি থেকে তুলে নিয়ে ভাল করে মুচড়ে নেওয়া হয় এবং ছোট বাঁশের ফলকে গুটিয়ে নেওয়া হয়। পরে ঐ সুতা বড় নাটাই-এ গুটিয়ে নেওয়া হয়। নাটাইটিও বাঁশের তৈরী।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৪)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৪)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (৫ম কিস্তি)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (৫ম কিস্তি)

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024