রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন

আবারো আগরতলা

  • Update Time : শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ৮.১১ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

‘কি যে কন সার, আমি বাওনবাইরার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) পোলা। নাস্তা বুজমু না ক্যান!’

আগরতলা জিরো পয়েন্টের কাছে পথে বসা ফলবিক্রেতা হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট করে বলে দিলেন কতো দূর গেলে নাস্তার দোকান পাওয়া যাবে।
১৪ এপ্রিল ২০২৪, ১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহর লোকে লোকারণ্য থাকলেও আগরতলা জনশূন্য। এদিন তাদের ছুটি। আর ছুটি বলে কথা! খাবারের দোকানও বন্ধ। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কারণ আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত দোকান খোলা ছিল। হাজারো মানুষ পথে নেমে আসেন। অনেক রাত পর্যন্ত কেনাকাটা, আড্ডা চলে। কিন্তু পহেলা বৈশাখের সকালে সব হাওয়া। শুধু শহরের মাঝে রাজপ্রাসাদের বাবা সাহেব আম্বেরদকরের ওপর একটি প্রোগ্রাম হয়েছে। আর রাজবাড়ির সামনে মেলা বসবে। সেটাও দেরি আছে। কোথায় নাস্তা করা যেতে পারে সে লক্ষ্যে আমরা তিন সফরসঙ্গী বেরিয়েছি। পথে ফল বিক্রেতাকে দেখে ‘নাস্তা কোথায় পাওয়া যাবে’ জানতে চাইলাম। পাশে দাঁড়ানো সফরসঙ্গী সিনিয়র সাংবাদিক সালিম সামাদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইনি কি নাস্তার অর্থ জানেন?’

সাথে সাথেই উপরের উত্তরটি দিয়েছিলেন ফলবিক্রেতা। আগরতলায় অনেকের সাথেই কথা বলে দেখলাম, এখানের বড় অংশেরই আদি বাড়ি বাংলাদেশে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট এলাকার লোক বেশি। তাই এখানে শুধু প্রমিত বাংলা না, আ লিক ভাষাতেও কথা বলার সুযোগ আছে। এখানকার মানুষ বাংলাদেশের বিষয়ে খুবই আগ্রহী ও আন্তরিক। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। অনেক কথার পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের একটাই প্রত্যাশা, একবার হলেও আদিবাড়ি বাংলাদেশ দেখে যেতে চান।

আগরতলা প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্যের আগ্রহে এবং সিনিয়র সাংবাদিক সালিম সামাদের উৎসাহে এই সফর। ‘টিম লিডার’ ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সালিম সামাদ জীবনের সাত দশক পেরিয়ে এখনো তরুণ। অপর সহযাত্রী ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বয়সে তরুণ সাংবাদিক মিজান রহমান যিনি বুদ্ধি ও বিবেচনায় প্রাজ্ঞ। তিন সফরসঙ্গীর রাশি বৃশ্চিক হওয়াতে আমাদের এই যাত্রার নামকরণ করা হয়- ‘তিন বৃশ্চিকের আগরতলা সফর’।

২.
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। ঐতিহাসিক ভাবেই ত্রিপুরার সাথে বাংলার সম্পর্ক বহুদিনের। এক সময় এখনকার বৃহত্তর কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ত্রিপুরা এক সাথেই ছিল। ১৪০৬ সালে বাংলা ঘুরে যাওয়া চায়নিজ পর্যটক মা-হুয়ান জানিয়েছেন বাংলা থেকে বিদেশে রফতানি পণ্যের তালিকায় অস্ত্রও ছিল। লোহা দিয়ে বানানো ‘গোলা নিক্ষেপ যন্ত্র’ কামানের ব্যবহার বাংলায় শুরু হয় মোগলরা আসার অনেক আগে সুলতানি আমলে। এই কামানকে সে সময় ‘নাল’ নামে ডাকা হতো। ১৫১৩ সালের দিকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনাধীন এলাকায় বড় কামানের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই সময়ে তৈরি একটি কামান আগরতলায় কামান চৌমুহনীতে পথের ঠিক মাঝখানে সংরক্ষণ করা আছে। আগরতলার প্রতিটি চৌরাস্তার মোড়কে ‘চৌমুহনী’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন কামান চৌমুহনী, মঠ চৌমুহনী, প্যারাডাইজ চৌমুহনী ইত্যাদি। এই চৌমুহনীর নাম ধরে ঠিকানা খোঁজা হয়।

মোগল যুবরাজ শাহ সুজা পরাজিত হয়ে ঢাকা থেকে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম হয়ে আরাকানে আশ্রয় নেন। এসময় তার সঙ্গীদের মধ্যে মিয়া তানসেনের বংশধর খোদা বক্স ছিলেন। তিনি কুমিল্লায় থাকা কালে সেখানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রচলন করেন। শাহ সুজা যতোদিন কুমিল্লায় ছিলেন ততোদিন তাকে ঘিরেও সঙ্গীতের আসর বসতো। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব ত্রিপুরায় পড়ে।

পলাশীর যুদ্ধের আগেই ১৭৫৩ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শহীদ হন শমশের গাজী। রোশনাবাদ পরগণার কৃষক বিদ্রোহের এই নেতা নিজের অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার একক নেতায় পরিণত হন। ত্রিপুরার সিংহাসন ও রাজ্য নিয়ে যখন রাজপরিবারে দ্বন্দ্ব সংঘাত চরমে, স্থানীয় মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা যখন সংকটময় সে সময় ‘ভাটির বাঘ’ শমশের গাজী নামের দৃঢ়প্রত্যয়ী যুবকের আবির্ভাব ঘটে। তার জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। এক পর্যায়ে তিনি পুরো ত্রিপুরা রাজ্য, চাকলা রোশনাবাদ ও ইসলামাবাদের উত্তরাংশের অধিকর্তা হয়ে ওঠেন। এই এলাকায় বর্তমান বৃহত্তর ত্রিপুরা, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামের অংশ। শমশের গাজী এলাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের ‘রাজা’। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রতিরোধে তিনি বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন।

পলাশীল যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে পটপরিবর্তন হলে সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তার বিরুদ্ধে সক্রিয় একটি চক্র, ঢাকার নবাবেব প্রতিনিধিগণ ইংরেজদের সাথে হাত মেলান। তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে শমশের গাজী পরাজিত হয়ে বন্দী হন। এক পর্যায়ে তিনি বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করা হয়।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার যে মামলা পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ দেয় তার সাথেও আগরতলা জড়িয়ে আছে। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুবর রহমান এবং অন্যান্য মামলা’ নামের এই মামলাটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে বেশি পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা নামটি ছিল বহুল উচ্চারিত। স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রথম নিরাপদ স্থান হিসেবে এটি বিবেচিত হতো। শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল, মেলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হসপিটাল, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, প্রবাসী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া সব কিছুর সাথেই আগরতলার নাম জড়িয়ে আছে।

ত্রিপুরা রাজ্যের ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের ৮৩৯ কিলোমিটারই বাংলাদেশের সাথে। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৫৬ হাজার। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হিসেবে অক্টোবর ১৯৭১ পর্যন্ত ত্রিপুরায় গিয়েছেন ১৩ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। পরে তা বেড়ে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। এতো মানুষের উপস্থিতিতেও আগরতলায় কোনো বড় দুর্ঘটনা বা সংঘাত ঘটেনি। বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় আগরতলার স্কুল কলেজ বন্ধ করে দিয়ে শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি ক্লাস রুমগুলোতেও বাংলাদেশের মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়। বাংলাদেশের অনেক সম্ভান্ত পরিবারসহ অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন অচেনা কারো বাসা বাড়িতে।

৩.
আগরতলা প্রেসক্লাবের ভেতরে ‘অনিল ভট্টাচার্য স্মৃতি অতিথিশালা’-য় আমরা ছিলাম। রুমের বারান্দা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল লেক। যার এক পাশে রাজবাড়ি। পহেলা বৈশাখ সকালে গানের কিছু সুর ভেসে আসে লেকের বাতাসে। আগরতলা শহরটি পায়ে হেঁটে দেখলে এক ধরনের ভিউ পাওয়া যায়।
কলকাতা বা ভারতের অন্য অনেক শহরের চেয়ে আগরতলা আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে আছে। এখানে অনেক ব্র্যান্ড শপ আছে। পিটার ইংল্যান্ড বা অন্যান্য শপগুলোতে দেখা যায় তারা তাদের সেরাটা এখানে রাখে না। কলকাতায় যে শ্রীলেদারের শোরুমে দম ফেলা যায় না, আগরতলায় তার শাখায় সেলফগুলো ফাঁকা। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা কিনতে হয় প্রায় দ্বিগুণ দামে। সেটাও দুপুরের পর। বিমান মাশুল গুণতে হয় পাঠককেই।

লেনিন সরণির বিশাল এলাকা জুড়ে বইয়ের দোকান দেখে এগিয়ে গেলেও থমকে যেতে হয়। কারণ অধিকাংশই একাডেমিক বই। তারপরও মনে প্রশান্তি এনে দেয় জগন্নাথ বাড়ি রোডে বইয়ের শো রুম ‘বুক ওয়ার্ল্ড’। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘জ্ঞান বিচিত্রা’। একই নামে বইয়ের একটি প্রকাশনা সংস্থাও আছে এখানে। যার মাধ্যমে বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ের বহু রকম বই প্রকাশিত হচ্ছে। চলে নানা রকম পাঠচক্র ও সাহিত্য আড্ডা। পুরো কার্যক্রমটি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করে আসছেন দেবানন্দ দাম। অত্যন্ত সজ্জন এই মানুষটি ও তার স্ত্রী মিলে আগলে রেখেছেন প্রতিষ্ঠানটি। ছোট বড় পাঁচটি রুমে নানা ধরনের বই সাজানো আছে। তার অফিস রুম ভর্তিও বই। বইয়ের ক্রেতাদের বেশ চমৎকার ভাবেই হালকা চা, নাস্তা পরিবেশন করা হয়। বাড়ুতি হিসেবে পাওয়া গেল দেবানন্দ দামের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আভেরির হাতে আঁকা বুক মার্ক।

‘অক্ষর’ নামে আরেকটি বইয়ের দোকান আছে আগরতলায়। যেখানে বাংলাদেশের লেখকদের কিছু বই পাওয়া যায়। অন্যান্য সব কিছুর মতো এখানেও আপডেটেড বই পাওয়া কিছুটা দুষ্কর। কারণ সব বই আনতে হয় কলকাতা থেকে। এই দুটো বইয়ের দোকানই ভরসা। ওরিয়েন্ট চৌমুহনীর ‘ত্রিপুরা কুটির শিল্প’ দোকানে হাতের তৈরি কিছু স্থানীয় পণ্য পাওয়া যায়।

রাতে প্রেসক্লাবের অতিথিশালায় আড্ডা জমে ওঠে। প্রেসক্লাব প্রেসিডেন্ট জয়ন্ত ভট্টাচার্য, আগরতলার মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মানস পাল, সাংবাদিক অভিষেক দেব বর্মা মেতে ওঠেন নানা বিষয় নিয়ে আলোচনায়। স্বাভাবিক ভাবেই ঘুরে ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। ১৯৭১ সালে আগরতলাতে এফআরসিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তার ছিলেন ডা. এইচ এস রায়চৌধুরী। তিনি এবং সার্জন ডা. রথীন দত্ত -এই দুজন মিলে শরণার্থী শিবিরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন দিনরাত। এমন মানুষদের কথা অজানাই থেকে যায়। জানা যায়, মেলাঘরে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হতো বা যেখানে প্রথম ফিল্ড হসপিটাল তৈরি করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ সহ কয়েকজন সাহসী মানুষÑ সেসব জায়গায় কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এই জায়গাগুলো চিহ্নিত করে রাখার উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। আগরতলা প্রেসক্লাবের ট্রেজারার রঞ্জন রায় বিদায়ের আগে আমাদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা ও কিছু প্রকাশনা উপহার দেন।

৪.
অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রিয়জনদের একটি টিমের সদস্য হিসেবে আবার আগরতলা যাওয়ার সুযোগ হয়। ২ থেকে ৪ জুলাই ২০২৪। আগের মতো এবারো আখাউড়া স্থল বন্দর দিয়ে ঢোকা। স্থানীয় স্থলবন্দর অটোরিকশা চালক সমিতির সভাপতি রুবেল-এর টিম আগেই আখাউড়া রেলস্টেশনে হাজির ছিলেন। রুবেল সউদি আরব থাকলেও সেখান থেকে ইমোর মাধ্যমে তার টিমের কিবরিয়াকে প্রস্তুত রাখেন। সীমান্তে দুইবারই খুবই অল্প সময়ে কাজ শেষ হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে যতো সময় লাগে তার অর্ধেক সময়ে এবং অনেক কম খরচে আগরতলা ঘুরে আসা যায়। কুমিল্লা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে বেশ মিল রয়েছে।
আগরতলা শহরের ভেতর প্রধান আকর্ষণ রাজপ্রাসাদ। মাণিক্য পরিবারের এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। পুরো ত্রিপুরার নানা ঐতিহ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এর ভেতর একটি গ্যালারিতে ফটোগ্রাফার ও সংগ্রাহক রবীন সেনগুপ্তের তোলা মুক্তিযুদ্ধের অনেক ছবি রয়েছে। যা কিছুটা হলেও সময়কে থামিয়ে দেন। সে সময়ের বেশি কিছু দৈনিক পত্রিকার ফ্রন্টপেজও প্রদর্শিত হয় এখানে। পুরো সংগ্রহটিই প্রয়াত রবীন সেনগুপ্তের দান করা।

ত্রিপুরার একটি বড় আকর্ষণ নীরমহল। চারপাশে জলবেষ্টিত এই রাজপ্রাসাদটি ত্রিপুরার রাজা অবকাশ যাপনের জন্য তৈরি করেছিলেন। বর্ষায় পানির ব্যাপক স্রোতের মধ্যে নৌকায় রাজপ্রাসাদটিতে যেতেই এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে। ভারতের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় জলপ্রাসাদ। কিন্তু জয়পুরের মতো পর্যটক এখানে নেই। আগরতলা শহরের মধ্যেই রয়েছে একটি পার্ক – অ্যালবার্ট এক্কা ওয়ার মেমোরিয়াল। যেখানে ভারতীয় সৈন্যদের বীরত্বের বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হেরিটেজ পার্ক -এ পুরো ত্রিপুরার গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় স্থানগুলোর রেপ্লিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে। রয়েছে পুরানো স্থানীয় ধনী মুসলিম উদ্যোক্তা গেঁদু মিয়ার মসজিদ। পুরানো ঢাকার তারা মসজিদের কথা মনে পড়ে যায় এটি দেখলে। এর সামনের খোলা জায়গাতেই ঈদের জামাত হয়। আগরতলার কেন্দ্রীয় মসজিদ এটি। দেশ বিভাগের সময় গেঁদু মিয়া ত্রিপুরা রাজ্যকে সে সময়ের পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের সাথে একীভূত করতে আগ্রহী ছিলেন। ত্রিপুরায় সিনেপ্লেক্সে অবশ্য নতুন মুভি মুক্তি পায়। দুই দফার সফরে অজয় দেবগানের ‘ময়দান’ এবং অমিতাভ বচ্চন, প্রভাস, দীপিকা পাডুকনের ‘কল্কি’ দেখার সুযোগ হয় এখানে।
আগরতলার লোকজন ট্রাফিক আইন কঠোর ভাবে মেনে চলেন। এখানে একটি মোটর সাইকেলের পেছনে সারিবদ্ধ ভাবে যখন অন্যগুলো দাঁড়ায় তখন কিছুটা কৌতুহল সৃষ্টি হয়। প্রায় প্রতিটি পথের চৌমুহনী ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বরেণ্য ব্যক্তিদের স্ট্যাচু স্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা বীরেন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বাবা সাহেব আম্বেদকর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মাস্টারদা সূর্যসেন, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু-সহ রাজনীতি, শিল্প সংস্কৃতি, ধর্ম নানা ক্ষেত্রের সফল মানুষই আছেন এই তালিকায়। ভালো লাগলো ত্রিপুরার অভিজাত পরিবারের সন্তান সঙ্গীতজ্ঞ এসডি বর্মণ বা শচীনদেব বর্মণের ভাস্কর্য দেখে। যার ক্যারিয়ার অবশ্য গড়ে ওঠে প্রথমে বাংলায়, পরে বোম্বেতে। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ খ্যাত তার ছেলে রাহুলদেব বর্মণ প ম বা আরডি বর্মণ ও ছেলের স্ত্রী আশা ভোসলে বোম্বে বা মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গানের জগতে আলোচিত নাম। এসডি বর্মণের ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মনে হলো তিনি হয়তো তার ‘সিগনেচার’ কণ্ঠে গেয়ে উঠতে পারেন, ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসো নি?’

৫.
ত্রিপুরায় দ্বিতীয়বার আসা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এক কর্মকর্তা। কারণ কেউ একবার বেড়াতে এলে দ্বিতীয়বার আর আগরতলা আসার কথা ভাবেন না বলেই তিনি মনে করেন। একান্ত প্রয়োজন বা কম খরচে ভারতের অন্যান্য স্টেটে বিমানে যাওয়ার জন্য কেউ কেউ আবার আসেন। তবে বেড়াতে আসেন না।
আরেকজনকে বলছিলাম এর পরেরবার আগরতলায় গেলে মেলাঘর, ঊনকোটি, দেবতামুড়াসহ আর কোথায় যাবো, কার সাথে দেখা করবো। তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘আবারো আগরতলা!’

কিছুটা দম নিতে হলো। শহর আগরতলার চেয়েও এখানকার মানুষেরা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেছেন। মুখের হাসি দিয়েই উত্তর বুঝিয়ে দিতে হলো, ‘জ¦ী, আবারো আগরতলা।’

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024