মীর আব্দুল আলীম 
নতুন বছর, নতুন বাজেট—সব সময়ই ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিশ্রুতির তালিকা লম্বা, কিন্তু বাস্তবায়নের গতি কি সেসব কথা মতোই ত্বরান্বিত? ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্ব—যেখানে দারিদ্র্য শূন্য, বেকারত্ব শূন্য এবং কার্বন নির্গমন শূন্য—একটি স্বপ্ন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে আমাদের জাতীয় বাজেট কি সত্যিই এই তিন জিরো অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে? নাকি বাজেট হয়ে যাচ্ছে শুধু বড় বড় সংখ্যা আর মিষ্টি ভাষণের আয়োজন? দারিদ্র্য কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশ রক্ষায় বাজেটের ভূমিকাই বা কতটা ফলপ্রসূ—সেটাই আজকের বিশ্লেষণের মূল প্রশ্ন। আসুন, খুঁটিয়ে দেখি, এই বাজেট কি প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার জন্য কতটা শক্তিশালী হাতিয়ার, নাকি কেবল প্রহসনের অংশ।
বাজেটের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশ রক্ষা কতটা সম্ভব হচ্ছে—এগুলোই আমাদের মূল প্রশ্ন। আজকের বিশ্লেষণে আমরা এই তত্ত্বের বাস্তবায়নের সঙ্গে বাজেটের সঙ্গততা ও অমিল খুঁজে বের করব, যা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য অত্যাবশ্যক। তবে আমাদের দেশে বাজেট ঘিরে এমনও প্রশ্ন ওঠে, এটি কি সত্যিই ‘জনগণের বাজেট’ নাকি কেবল কাগজে লেখা একটা সংখ্যার সমষ্টি? আজকের বাজেট বিশ্লেষণে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর এবং বাস্তবতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, যা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে।
দারিদ্র্য হ্রাস না অনুদান?
বাংলাদেশের বাজেট বক্তৃতায় “দারিদ্র্য হ্রাস” একটি নিয়মিত মুখস্থ শব্দ। ২০২৫–২৬ সালের বাজেটও ব্যতিক্রম নয়। বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বেড়েছে, নতুন নতুন নাম এসেছে তালিকায়, বেড়েছে ভাতার সংখ্যা। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—এই টাকাটা কাদের হাতে যাবে? এবং যারা পাবে, তারা আদৌ কীভাবে জীবনধারণের মানোন্নয়ন করতে পারবে? যারা বয়স্ক, অক্ষম কিংবা বিধবা—তাদের জন্য মাসিক কিছু অর্থ বরাদ্দ নিঃসন্দেহে দরকার। কিন্তু এর চেয়ে জরুরি হলো কর্মক্ষম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষদের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ঘরে বসে বয়স্ক ভাতা পেলেই জীবন বদলায় না; বরং সেটা এক প্রকার ‘নির্ভরতাজনিত গৃহবন্দিত্ব’। মানুষ সাহায্য চায় না, চায় কাজ—চায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ। যখন একটি যুবক ভাতা পায় ৫০০ টাকা, কিন্তু হাটে গেলে ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৪০ টাকা, তখন সে বুঝে যায়—এই অনুদান তাকে ত্রাণ দিচ্ছে, সম্মান নয়। অথচ বাজেট তাকে উদ্যোক্তা বানাতে পারত, প্রশিক্ষণ দিতে পারত, এমনকি ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্পে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারত। ভাতা নয়, চাই দক্ষতাভিত্তিক স্বনির্ভরতা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে একবিংশ শতাব্দীর ভাষায় বলতে হলে—‘সামাজিক সক্ষমতা কর্মসূচি’। এই সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে মানুষ ভিক্ষুক নয়, হোক উদ্যোক্তা। সেলাই মেশিন দেওয়া নয়, সেলাই শেখানো জরুরি; পাঁঠা বিতরণ নয়, শেখাতে হবে পশু পালনের টেকসই কৌশল। আরেকটি দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েরা যেন শিক্ষায় থাকে। বাজেটে সেই দিকটায় নজর কম। আজকের দরিদ্র শিশু যদি লেখাপড়া না শিখে ঝরে পড়ে, তবে আগামীকালের বাজেটে তার নাম আবারও ‘ভাতাভোগী’ হিসেবেই থাকবে। দারিদ্র্য যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে রক্তের মতো বয়ে চলে। এই বাজেট দারিদ্র্য কমানোর কথা বললেও, দারিদ্র্যের চক্র ভাঙার কোনো রূপরেখা দেয়নি। সুতরাং প্রশ্ন উঠছে, আমরা দারিদ্র্য কমাচ্ছি, না কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘরে বসিয়ে একটি মাসিক সম্মানহীন অনুদানে বন্দি করে রাখছি?
কর্মসংস্থান—বরাদ্দ কই, ভরসা কই?
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, আর এদের হার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা দেশের জন্য নন্দনীয় নয়; বরং গভীর উদ্বেগের কারণ। একদিকে শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন ‘চাকরি চাই’ বলে উচ্চস্বরে দাবি তুলছে, অন্যদিকে বাজেট ঘোষণার সময়ে এই দাবি যেন স্রেফ বাতাসে মাখানো কল্পকাহিনী হয়ে গেল। ২০২৫ সালের বাজেটে কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ কোথায়—উত্তর মেলেনি কারও কাছ থেকে। সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলেছে—যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু স্মার্ট অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে কীভাবে, যদি স্মার্ট কর্মসংস্থান গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা না থাকে? আজকের যুব সমাজের চাকরির সন্ধান যেন এক দীর্ঘশ্বাস; প্রতিদিন পত্রিকার চাকরির পাতা উল্টানো তাদের জীবনের নিয়মিত অংশ। বাজেট ঘোষণা শুনে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন—এই বাজেট তাদের জন্য নয়, তারা এখনও গৃহীত নীতির বাইরে। এই বাজেটে কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে শোনা গেলেও, সেই বরাদ্দ বাস্তবে কতটুকু কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজে লাগানো হবে, তা বলা হয়নি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন, উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ, শিল্পখাতের সম্প্রসারণ—এসব বিষয়ে আলোচনা থাকলেও বাস্তবায়নে তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য প্রকৃত অর্থায়ন কম, প্রচার বেশি। যুব সমাজের স্বপ্নের শহর ঢাকার রাস্তায় কর্মসংস্থানের অভাবে হাজার হাজার ছেলে–মেয়ে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে কাজ। অনেকেই ঢাকার রাস্তায় কিংবা দেশের বড় বড় শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকের কাজ নিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ বাজেটে তাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই, কোনো স্বপ্নের খোঁজ নেই। ‘চাকরি হবে, হবে’—এই ধরনের অসম্পূর্ণ আশার ওপরই তাদের জীবন ঝুলে আছে।
যুব সমাজের একাংশ উদ্যোক্তা হতে চায়, কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে অর্থ, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দরকার, বাজেটে সে জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ নেই। ফলে ভালো আইডিয়া থাকলেও তারা এগোতে পারে না। এমনকি প্রযুক্তি খাতেও প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সীমিত। আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় না, নিরাপদ ঋণ পরিবেশও তৈরি হয়নি। সুতরাং, এই বাজেট যুব সমাজকে নতুন কর্মসংস্থানের ভরসা দেয়নি; বরং তাদের স্বপ্নগুলোকে ঠেলে দিয়েছে একধরনের অনিশ্চয়তার গহ্বরে। যারা দেশের ভবিষ্যৎ, তাদের জন্য বাজেট কতটুকু কাজ করবে, তা সময়ই বলে দেবে—তবে জনজীবনের বাস্তবতা থেকে বাজেটের দূরত্ব যেন দিন দিন বাড়ছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের মাঝেও বাজেট নির্লিপ্ত
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। আমাদের নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বর্ষার অনিয়মিত ছন্দ আর বারবারের বন্যা সবই প্রমাণ করে—জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় আমাদের কেবল অদূর ভবিষ্যতের নয়, বর্তমানেরই বাস্তবতা। অথচ বর্তমান বাজেটে পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে বরাদ্দ বেশ কম; এবং তা প্রায়শই ভাষাগত মায়া ও প্রতিশ্রুতির গণ্ডি পেরোতে পারেনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, কার্বন নির্গমন হ্রাস কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর কোনো নীতিগত বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সরকারের নানা মহল থেকে জলবায়ু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা শোনা গেলেও বাজেটের কাগজে-কলমে তা স্রেফ প্রতিশ্রুতি। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ‘জিরো কার্বন এমিশন’ ধারণা, যা আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের বড় মাইলফলক হতে পারত, সেটি বাজেটে কোথাও ছায়ামাত্র। কার্বন নির্গমন হ্রাসে প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো তহবিল নেই, আর পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করার নীতিমালাও স্পষ্ট নয়। পরিবেশ রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় প্রক্রিয়া জটিল; ফলে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বন্যা, ভেজালযুক্ত পানি, ভয়াবহ তাপদাহ ও খাদ্য সংকটের মুখে রেখে যেতে চাই? পরিবেশের প্রতি বর্তমান বাজেটের অবহেলা কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, বরং সমাজের দুর্বল অংশের জীবনমানকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। বাজেট পরিকল্পনায় পরিবেশকে কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে না পারলে আমরা শুধু প্রকৃতি নয়—নিজস্ব অস্তিত্বও হারানোর পথে হাঁটছি।
সুবিধাভোগী—কে হবে?
দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আজ সবচেয়ে বঞ্চিত। তারা গরিব নয়, তাই ভাতা বা সরকারি সহায়তা পায় না; আবার সুবিধাভোগীও নয়, তাই সরকারি নানা প্রকল্পের বাইরেই থাকে। বাজেট ঘোষণায় তাদের জন্য কোনো স্পষ্ট স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি চাকরিজীবীরা বিশেষভাবে করের চাপের মধ্যে দিশেহারা; যার ফলে তারা দিনের শেষে সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। কর কাঠামোয় মধ্যবিত্তের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর কারণে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা এক ধরনের আর্থিক শোষণ। কর সংগ্রহ বাড়ানো সরকারের ভালো লক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু এটি যদি মধ্যবিত্তের আয় ও জীবনযাত্রার উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে চালানো হয়, তাহলে তা সমাজের অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। মধ্যবিত্ত, যারা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাদের প্রতি বাজেটের উদাসীনতা ভবিষ্যতে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধীর হবে এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। বাজেটে যদি এই শ্রেণির স্বার্থ ও সুবিধা বিবেচনায় না নেওয়া হয়, তবে ‘জনগণের বাজেট’ নয়—‘কিছু শ্রেণির বাজেট’ হয়ে যাবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বাধা।
কৃষি বরাদ্দে সন্তুষ্টি, বাস্তবে হতাশা
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে শোনা গেলেও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। প্রকৃত কৃষকরা অধিকাংশ সময়ই পান না সময়মতো বীজ, সার, সেচ বা প্রযুক্তির সুবিধা; বরং সুবিধাভোগী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এসব সুবিধার বড় অংশই কুক্ষিগত করে। কৃষকরা যখন ন্যায্যমূল্যের দাবিতে আন্দোলন করে, তখন তাদের কথা বাজেটে উপেক্ষিত থেকে যায়। সরকারি পরিকল্পনায় কৃষকের ক্ষমতায়ন, বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় নানা জটিলতা ও দুর্নীতি বিদ্যমান। ফলে অধিকাংশ কৃষক দারিদ্র্যের সীমানায় আটকা পড়ে। বিশেষ করে বীজ, সার ও সেচ সুবিধা পেতে গড়ে ওঠা দুর্নীতি আর অনিয়ম মাঠ পর্যায়ে কৃষককে হতাশ করেছে। বরাদ্দ বাড়ানো হলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন না হলে বরাদ্দের অর্থ কৃষকের জীবনে পরিবর্তন আনে না। ফলশ্রুতিতে, কৃষি খাতে বাজেট কাগজে উন্নয়ন—মাঠে অবহেলা। এটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের বিপদ।
শিক্ষা: গৌরবের ভাষণ না অবহেলা
শিক্ষা খাত নিয়ে বাজেটে ‘মানসম্মত শিক্ষা’ গড়ার কথা বলা হলেও বাস্তবতা ছিন্নভিন্ন। সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট, শিক্ষার মানের অবনতি স্পষ্ট। একই সঙ্গে প্রাইভেট শিক্ষার খরচ বাড়ছে, যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে। সরকারি বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষাপরিকাঠামো আধুনিকায়নের জন্য বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। এতে গরিব শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মোট শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার অভাব ভবিষ্যতে দেশের কর্মসংস্থান, উদ্ভাবন ও সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাজেটের বড় বড় ভাষণে শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা মাঠ পর্যায়ে পূরণ হচ্ছে না। ফলে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
স্বাস্থ্য: হাসপাতালের দেয়ালে উন্নয়ন, ভেতরে অব্যবস্থা
সরকারি হাসপাতালের নতুন ভবন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত হলেও সেবার মানে তেমন উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতি, ওষুধের অভাব এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বহীনতা এখনও বিদ্যমান। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে বারবার, কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। কোভিড-১৯ মহামারি থেকে শিক্ষা না নেওয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ সামলাতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ এখনও অসম্ভব। অপ্রতুল পরিকাঠামো ও সেবার গুণগত মান উন্নয়নে বাজেটে তেমন কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেই। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও, প্রকৃত পরিবর্তনের চাবিকাঠি হলো দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বশীলতা—যা আজও অনুপস্থিত।
রাজস্ব আয় ও ঘাটতির গল্প
সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তবে আদায়ের কাঠামো দুর্বল। আয়কর ও ভ্যাট নীতির অতিরিক্ত চাপ সাধারণ মানুষের ওপর পড়ছে, যা তাদের আর্থিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কালো টাকার সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় এবং দুর্নীতিবাজদের উৎসাহ জোগায়। ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে, যা ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির কারণ হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা ভালো হলেও কাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্নীতি ও দূরদৃষ্টি-হীনতা এই লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজেটের ঘাটতি ও কর নীতি জনজীবনে চাপ সৃষ্টি করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করতে পারে।
দুর্নীতি ও বাস্তবায়ন ঘাটতি
যে কোনো বাজেট সফল হয় তার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক বিলম্ব, বরাদ্দের অপচয় এবং নিম্নমানের কাজের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতি প্রকল্প ব্যয় বাড়ায়, অথচ জনগণের জন্য প্রত্যাশিত সেবা ও উন্নয়ন হয় না। এতে বাজেটের বড় অংশ কাগজেই থেকে যায়। সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জবাবদিহিতার অভাব স্পষ্ট। সঠিক তদারকি ও স্বচ্ছতার অভাবে প্রকল্পগুলো মাঠ পর্যায়ে পৌঁছায় না। এতে দেশের জনগণের হতাশা ও আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজেট যতই বড় হোক, কার্যকর না হলে তা অর্থহীন।
বাজেট কি সত্যিই ‘জনগণের বাজেট’?
বাজেটের প্রতিটি দিক গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—সৃষ্টিশীল কোনো দিক ছাড়াও বাজেটের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতি, স্বার্থ ও রূপকথার গন্ধ রয়েছে। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে তৈরি বাজেট দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে অক্ষম। বাজেট যদি দুর্নীতি, অসংগতি ও দায়িত্বহীনতা দূর করতে না পারে, তাহলে তা দেশকে উন্নয়নের পথ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের কষ্ট কমানোর কোনো বাস্তব উদ্যোগ না থাকায় বাজেট জনগণের নয়—প্রভাবশালীদের বাজেট বলেই মনে হয়। সরকারকে এখনই সৎ মনোভাব, বাস্তবমুখী পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে ‘জনগণের বাজেট’ নির্মাণ করতে হবে; না হলে দেশের মানুষ প্রতিদিন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হবে।
উপসংহার
বাজেটের ঘোষণায় যতই আশার আলো থাকুক, বাস্তবায়নের ময়দানে তা অনেক সময়ই ভিন্ন চিত্র দেখায়। দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত, কৃষক থেকে চাকরিজীবী—দেশের নানা শ্রেণির মানুষের প্রত্যাশা পূরণে বর্তমান বাজেট সীমাবদ্ধ। পরিবেশ রক্ষা থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও করের বোঝা, আর দুর্নীতি ও অপর্যাপ্ত বাস্তবায়ন—সব মিলিয়ে বাজেট যেন দেশের সাধারণ মানুষের জন্য নয়, বরং স্বার্থবাদী কোনো অংশের জন্য সাজানো এক পরিকল্পনা। তাই এখন প্রয়োজন সততা, দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে বাজেট নির্মাণ, যাতে দেশের প্রতিটি নাগরিক নিজেকে এর অংশ মনে করতে পারেন। নইলে শুধু কাগজে উন্নয়ন লেখা থাকবে, বাস্তবে মানুষ দুঃখে কাটাবে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত। আসুন, আমরা সবাই মিলে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলি, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের বাজেট সত্যিকার অর্থেই ‘জনগণের বাজেট’ হয়। সেই পরিবর্তনই আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করবে।
লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক ও মহাসচিব—কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
