বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন চলতি বছরের সাতই জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে সেটিই সবচেয়ে বেশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেই নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার বিরোধী আন্দোলনের সমালোচনা করেন তিনি।
ঢাকায় গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরে হয়ে যাওয়া সংসদ নির্বাচন, আমেরিকার ছাত্রবিক্ষোভ, উপজেলা নির্বাচন, চলমান খরা পরিস্থিতি, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা।
এক প্রশ্নের জবাবে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র বিক্ষোভ দমনে মার্কিন সরকারের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন তিনি।
বলেছেন, “মার্কিন পুলিশ যেভাবে আন্দোলন থামায় আমরা সেটা করতে পারি। আমাদের পুলিশ মনে হয় এখন আমেরিকার পুলিশকে অনুসরণ করতে পারে। আমেরিকান স্টাইলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যারা নির্বাচন বর্জন করে তাদের আসলে নির্বাচন করারই আর সক্ষমতা নেই।
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে যে তাকে উৎখাতের পর [ক্ষমতা থেকে] কে আসবে? কাকে তারা [যারা উৎখাতে চেষ্টা করছে] আনতে চায়?
“সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। আর সেটা স্পষ্ট নয় বলে তারা জনগণের সাড়া পাচ্ছে না,” যোগ করেন শেখ হাসিনা।
প্রসঙ্গত, বিএনপি ও সমমনা দলসহ বেশকিছু বামপন্থী দল সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিলো। এখন তারা চলমান উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক থাইল্যান্ড সফর সম্পর্কে অবহিত করতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিলো।
২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র চক্রান্ত হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার অভিযোগ করেছিলেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে। তার সূত্র ধরেই উঠে আসা এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নির্বাচন নিয়ে অনেক কিছুই হয়েছে যাতে নির্বাচন না হয়। একটু হতাশা ছিল কারও কারও মনে।
“কিন্তু আমার শক্তি হলো দেশের জনগণ। জনগণ যতক্ষণ চাইবে ততক্ষণ থাকবো ক্ষমতায়। আমাদের দল কোনো মিলিটারি ডিক্টেটরের পকেট থেকে আসেনি। আওয়ামী লীগ সবসময় মানুষের কল্যাণে কাজ করে। যে কারণে বাধা আসলেও উতরে যেতে পারি,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেই এবারের নির্বাচন করা হয়েছে।
“৭৫ সালের পর যত নির্বাচন হয়েছে সেগুলো তুলনা করলে দেখা যাবে ২০২৪ সালের সাতই জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিটি নির্বাচনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই নির্বাচন হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “চক্রান্ত পাশ কাটিয়ে মানুষকে নিয়ে আমরা বিজয় নিয়ে আসি। এখানে জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটেছে। যারা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নেই বলছে তারাই ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিলো।”
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হামলা ও যুদ্ধের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত কিছুদিন ধরেই তুমুল বিক্ষোভ চলছিলো। মঙ্গলবার রাতে মার্কিন পুলিশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভ বন্ধ করেছে।
শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন ফিলিস্তিনে যেভাবে গণহত্যা চলছে তা অমানবিক এবং এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করায় আমেরিকায় ৯০০ ছাত্র শিক্ষক গ্রেফতার করা হয়েছে।
“এটা নাকি গণতন্ত্রের অংশ। এটাও শুনতে হয়। যেভাবে একজন প্রফেসরকে মাটিতে ফেলে হ্যান্ডকাপ পড়ানো হলো। ২০০১ সালে বিএনপি সন্ত্রাসী ও পুলিশ যেভাবে অত্যাচার করেছিলো সেটাই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য তাদের কাছেই মানবাধিকারের সবক নিতে হয়, এটা দুর্ভাগ্য,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, “মার্কিন পুলিশ যেভাবে আন্দোলন থামায় আমরা সেটা করতে পারি। আমাদের পুলিশ মনে হয় এখন আমেরিকার পুলিশকে অনুসরণ করতে পারে। আমেরিকান স্টাইলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে”।
আমেরিকায় দুজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার বিষয়ে একজন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমেরিকায় স্কুল রেস্তোরায় বিভিন্ন সময়ে হামলা কিংবা গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটছে।
“স্কুল রেস্তোরাঁয় অনবরত গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে। এমন কোনো দিন নেই যে এগুলো ঘটছে না। তাদের সেটা দেখা উচিত। প্রতিনিয়ত সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে”।
শেখ হাসিনা বলেন তার সরকার ফিলিস্তিনদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং দুবার সহযোগিতা পাঠানো হয়েছে। আরও পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
ইসরায়েলকে আমেরিকার অস্ত্র সহযোগিতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “এক জায়গায় টাকা ও অস্ত্র দেয়া হয়। আরেক জায়গায় ভিন্ন নীতি। এখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো চুপ কেনো। বাংলাদেশে কিছু হলে তো তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এখন কেন চুপ। তবে ফিলিস্তিনের বিষয়ে বিশ্ব জাগ্রত হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, আসলে অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রি করাই হলো মূল বিষয়।
“আমি বলেছি অস্ত্র প্রতিযোগিতা না করে সেই টাকা জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে দিন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমি আগেও বলেছি এবং সামনেও বলবো,” যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহযোগিতা পাওয়ার ও সার্বিক উন্নয়নের একটা নতুন দুয়ার খুলে গেলো এবং একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
“আমরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়কে গুরুত্ব দিচ্ছি। বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ড পড়শি দেশ। বন্ধুত্ব আরও অনেক সুযোগ করে দেবে। থাইল্যান্ডের খাদ্য ফসল ও ফল উৎপাদনে উৎকর্ষতা আছে। এসব নিয়ে মত বিনিময় করছি। কীভাবে অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারি।”
এ সফরের অর্জন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন চট্টগ্রাম থেকে থাইল্যান্ডে সরাসরি কার্গো নেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এবং অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা এখন সহজে যেতে পারবে।
“পণ্য আনা নেয়ায় সুবিধা হবে। পর্যটনে তারা অগ্রগামী, তাদের অভিজ্ঞতা নিতে পারি। তাদের বিনিয়োগ করতে বলেছি। সমুদ্র সৈকতে পর্যটনে জায়গা চাইলে দিতে পারবো। তারা উন্নত করতে পারবে। ব্যবসা বাণিজ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। সব মিলিয়ে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যে অবস্থা তাতে প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা ও মত বিনিময়ে মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিই আমাদের লক্ষ্য,” সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন শেখ হাসিনা।
মিয়ানমারের উপর থাইল্যান্ডের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে মিয়ানমারের চলমান সংকট ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছি কি না এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তার সফরে শরণার্থী প্রত্যাবাসন ইস্যুটি আলোচনায় এসেছে।
“থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি গভীরভাবে দেখবেন, যতটা সহযোগিতা করার করবেন। এ কথা তিনি দিয়েছেন।”
আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন সদস্য হতে পারলে ভালো, তবে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন নয়, পর্যবেক্ষক হিসেব আছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন যে ‘অতি বাম ও ডানরা মিলে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছে’। এ বিষয়ে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বামরা নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেলে তো কিছু করার নেই।
“তারা আমাকে উৎখাত করবে। কিন্তু পরবর্তীতে কে আসবে। সেটা কি ঠিক করেছে? কাকে তারা আনতে চায়। সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। আর সেটা স্পষ্ট নয় বলে তারা জনগণের সাড়া পাচ্ছে না,” বলেছেন তিনি।
চলমান উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী এমপিদের স্বজনদের নির্বাচনে অংশ না নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনেকে মানছেন না- একজন সাংবাদিক এমন তথ্য দিলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি বলেছি ইলেকশনটা যেন প্রভাবমুক্ত হয়। মানুষ যেন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে। আমি বলতে চেয়েছি কর্মীদের মূল্যায়ন করা উচিত। সেটাই বলতে চেয়েছি”।
তিনি বলেন নির্বাচনকে অর্থবহ করাই লক্ষ্য। কেউ কেউ বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছে। যারা বর্জন করে নির্বাচন করার সক্ষমতাই তাদের নেই। কারণ সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে তো পাবলিক গ্রহণ করবে না”।
“আমাদের চেষ্টা হলো নির্বাচন আরও গণমুখী ও স্বচ্ছ করা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্ত করে নির্বাচন কমিশনকে আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রেখে অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হোক সেটাই চেয়েছি। মানুষ যাকে চাইবে তাকেই ভোট দিবে।”
১৪ দল থাকবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন চৌদ্দ দলীয় জোট আছে ও থাকবে।
“আমি তাদের সাথে শিগগিরই বৈঠক করবো। আমার নিজেরও যোগাযোগ আছে। দলের সাধারণ সম্পাদকও যোগাযোগ রাখেন। ১৪ দল গত নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। জেতা না জেতা ভিন্ন কথা। কিন্তু জোট আছে, থাকবে।”
দ্রব্যমূল্য বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন মানুষ এখন গরুর মাংস, মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়লো কেন সেই প্রশ্ন করে। তার মানে সেই পর্যায়ে মানুষ এসেছে। তবে দাম বাড়াটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়।
“যদিও অনেক সময় দেখা যাচ্ছে সরবরাহ ঠিক থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ছে। কিছু লোক কারসাজি করে এটাও ঠিক। তারা মজুদ রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। নানা কারণে আমদানি যেগুলো করতে হয় সেগুলোর দাম বাড়ে। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আন্দোলনের নামে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে চক্রান্তই হয়। তবুও বাজারের ওপর নজরদারি আছে ও থাকবে। আর মূল্যস্ফীতি বিশ্বব্যাপী, কোথায় নেই? তবে আমরা জানি যে সুনির্দিষ্ট বেতনে যারা চলে তারা একটু কষ্টে আছে। এজন্য কার্ড করে দেয়া হয়েছে যাতে স্বল্পমূল্যে পণ্য পায়। এতে একটু হলেও তারা স্বস্তি পাচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী জানান আগামী মাসেই দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদযাপন করবে তার দল।
“বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই দেখবো কাদের আমন্ত্রণ (বিদেশি) জানাতে পারি। কর্মসূচি তৈরি হচ্ছে। উপমহাদেশে একটা দল ৭৫ বছর উদযাপন করছি- এটা কম কথা নয়।”
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ভুটান থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত সড়ক হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার তা নাকচ করে দিয়েছিলো। আমরা বলেছি আমরা এতে যুক্ত থাকতে চাই।
“এছাড়া মিয়ানমারের গ্যাসে কয়েকটি দেশ বিনিয়োগ করে। ভারত নিলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নিতে হবে। আমরা আগে বলেছিলাম যে দিবো কিন্তু আমাদের একটা অংশ দিতে হবে। এটা হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সংকট হতো না। কিন্তু খালেদা জিয়া পরে এসে রাজি হয়নি। ফলে সব এখন চীন একাই নিয়ে নিচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply