সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
আগুন ধরিয়ে হেরম্ব আনন্দের পাশে এসে দাঁড়াল। বিরাট যজ্ঞানলের মতো ঘৃতসিক্ত কাঠের স্তূপ হুহু করে জ্বলে উঠল। সমস্ত উঠান সোনালী আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘এই না হলে আলো!’
ওদিকের প্রাচীর, এদিকের বাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দ্বি-পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে কতদূরে গিয়ে পৌঁছাল কেউ জানে না। হেরম্ব আনন্দের একটা হাত চেপে ধরল।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আনন্দ বলল, ‘তুমি সি’ড়িতে বসে নাচ দেখ। আমায় ডেকো না, আমার সঙ্গে কথা ব’লো না।’
হেরম্ব সিড়িতে গিয়ে বসল। আনন্দ আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হেরম্বের মনে হল আগুনের সে এত কাছে দাঁড়িয়েছে যে তার চোখের সামনে সে বুঝি বাল্লে পুড়ে যাবে। কিন্তু নৃত্যের বিপুল আয়োজন, আনন্দের উন্মত্ত উল্লাস তাকে মুক করে দিয়েছিল। আগুনের তাপে আনন্দের কষ্ট হচ্ছে বুঝেও সে কাঠের পুতুলের মতো বসে রইল।
খানিকক্ষণ আগুনের সান্নিধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একে একে কাপড়জামা খুলে আনন্দ অর্ঘ্যের মতো আগুনে সমর্পণ করে দিল। তার গলায় সোনার হারে তাবিজ ছিল, বাহুতে তুলসীর মালা ছিল, হাতে ছিল সোনার চুড়ি। একে একে খুলে তাও সে আগুনে ফেলে দিল। নিরাবরণ ও নিরাভরণ হয়ে সে যে কি নৃত্য আজ দেখাবে হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারল না।
আনন্দ ধীরে ধীরে আগুনকে প্রদক্ষিণ করতে আরম্ভ করল। অতি মৃদু তার গতি, কিন্তু চোখের পলকে ছন্দ চোখে পড়ে। এও সেই চন্দ্রকলা নাচেরই ছন্দ। সে নাচে তিল তিল করে আনন্দের দেহে জীবনের সঞ্চার হয়েছিল, আজ তেমনি ক্রমপদ্ধতিতে সে গতি সঞ্চয় করেছে। গতির সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের লীলাচাঞ্চল্যের সমন্বয়, যার জন্ম চোখে পড়ে না, শুধু মনে হয় সমগ্র নৃত্যের রূপ ক্রমে ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে।
প্রথম আনন্দের দু’টি হাত দেহের সঙ্গে মিশে ছিল, হাত দু’টি যখন আগুনের কম্পিত আলোয় তরঙ্গ তুলে তুলে দুই দিগন্তের দিকে প্রসারিত হয়ে গেল, তখন আনন্দের পরিক্রমা অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে। এখন যে তার নৃত্যের পরিপূর্ণ বিকাশ, এই নৃত্যকে যে না চেনে তারও তা বোঝা কঠিন নয়। হেরম্ব বড় আরাম বোধ করল। তার অশান্তি ও উদ্বেগ, শ্রান্তি ও জড়তা মিলিয়ে গিয়ে পরিতৃপ্তিতে সে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আনন্দের প্রথম নৃত্যের শেষে মন্দিরের সামনে সে প্রথম যে অলৌকিক অনুভূতির স্বাদ পেয়েছিল, আবার, তার আবির্ভাবের সম্ভাবনায় হেরম্বের দেহ হাল্কা, মন প্রশান্ত হয়ে গেল।
কিন্তু এবারেও অকস্মাৎ আনন্দের নৃত্য থেমে গেল। আগুনের আরও নিকটে সে থমকে দাঁড়াল। আগুন এখন তার মাথা ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে উঠেছে, আনন্দকেও মনে হচ্ছে আগুনের শিখা। পরক্ষণে আনন্দ কাত হয়ে সেই বিপুল ব্যাপক যজ্ঞানলে ঢলে পড়ল।
হেরম্ব নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু করার নেই। আনন্দ অনেক আগে মারা গেছে। শুধু চিতায় উঠবার শক্তিটুকুই তার বজায় ছিল।
Leave a Reply