যে কোনো দেশের মুদ্রার মানের উল্লেখযোগ্য হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, বাজারের চাহিদা এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর। এই সূচকগুলোর পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে দেশটিতে সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এভাবে সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কখনও মুদ্রা দর পতন ঘটে কখনও বা তা বেড়ে যায়। অত্যধিক হারে বেড়ে যাওয়া মুদ্রামান বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক লেনদেনে সেই মুদ্রার একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। চলুন, ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত কোন ১০টি মুদ্রা সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে তা জেনে নেওয়া যাক।
এক দেশের মুদ্রা থেকে অন্য দেশের মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তন মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
মুক্ত বাজারে মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার বর্তমান অবস্থা ঠিক করে দেয় মুদ্রার ফ্লোটিং রেট। যখন একটি মুদ্রার চাহিদা বাড়লে এর দাম বাড়ে, একইভাবে চাহিদা কমলে দামটাও কমে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির নেপথ্যে কাজ করে বিনিময় হার সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ধারণা। বিনিময় হারের এই বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন হতে থাকে মানুষের চাহিদা এবং বাজারে মুদ্রার সরবরাহ।
যেমন ইউরোর তুলনায় মার্কিন ডলারের (ইউএস ডলার) চাহিদা বৃদ্ধি মানে ইউরোর দাম মার্কিন ডলারের দাম থেকে কমে যাওয়া। চাহিদা বৃদ্ধির মূলে থাকে বেকারত্বের হার, মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হারের পরিবর্তনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা।
একটি বিদেশি মুদ্রার সঙ্গে বিনিময়ের জন্য একটি দেশের সরকার সেই দেশের মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট হার বেধে দেয়। মুদ্রার মূল্য নির্ধারণীটি করা হয়ে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে। অতঃপর সেই বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে সরকার কর্তৃক দেশীয় মুদ্রা লেনদেন করা হয়, যার মাধ্যমে নির্ধারিত হারটি বজায় থাকে।
বাজারে স্বল্পমেয়াদে ফ্লোটিং রেট যখন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, তখন এর নেতিবাচক প্রভাব করে দৈনন্দিন সরবরাহ ও চাহিদায়। এ সময় মুদ্রার দাম একদম পড়ে গেলে অথবা আকাশচুম্বী হয়ে যায়। এই অস্থিতিশীলতাটি দেশের বাণিজ্য, ঋণ পরিশোধসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। তাই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ফিক্স্ড রেটের আশ্রয় নেয়।
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হলো কুয়েতি দিনার, যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএসএ) মুদ্রায় যার বিনিময় হার ৩ দশমিক ২৬ মার্কিন ডলার। এর পেছনে প্রথম কারণ হচ্ছে তেল রপ্তানিতে বিশ্বে কুয়েতের অবস্থান। এই প্রেক্ষাপটটি দেশটিকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কুয়েতি দিনারে মার্কিন ডলার, ইউরো এবং জাপানি ইয়েনের মতো বিশ্বখ্যাত তিনটি মুদ্রার বিপরীতে ফিক্স্ড রেট আরোপ করা হয়েছে। তাই বৈশ্বিক মুদ্রা বাজার পরিবর্তন এই দিনারের মানকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না।
তৃতীয়ত, কুয়েত একটি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল দেশ। এতে করে কুয়েত বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ পায়।
তাছাড়া, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এই মুদ্রা সরবরাহের উপর। ফলে মুদ্রার দর একটি নির্দিষ্ট হার বজায় রাখতে পারে।
বিশ্বের দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ দামি মুদ্রা হলো বাহরাইন দিনার, যার একক মুদ্রার হার ২ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলারের সমান। এর পেছনে প্রধান কারণ তেলের পাশাপাশি বাহরাইন গ্যাস রপ্তানিতেও সেরা।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে এই দিনারের বিনিময় হার সুনির্দিষ্ট করায় এর দামে খুব বেশি তারতাম্য থাকে না। এমনকি দেশটির নিম্ন মূল্যস্ফীতির হার মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
বিশ্বের তৃতীয় দামি মুদ্রাটির নাম ওমানি রিয়াল, যার একক মুদ্রা দিয়ে ২ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলার কেনা যায়। কারণ বাহরাইনের মতো ওমানও বিশ্বখ্যাত তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের এই দেশটির অর্থনীতির বেশিরভাগই নির্ভর করে তাদের কাছে থাকা তেলের মজুদের উপর।
এই রিয়ালের এক হাজার ভাগের এক ভাগকে ‘বাইসা’ বলা হয়, যা অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ব্যবহার করা হয়। আর ইউএস ডলারের বিপরীতে ওমানের মুদ্রার রেট ফিক্স্ড করা আছে। এছাড়া দেশটির মূল্যস্ফীতির হার তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে মুদ্রার মানের আকস্মিক পরিবর্তন হয় না।
তালিকার চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জর্ডানিয়ান দিনার, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার বিনিময় হার ১ দশমিক ৪১ ডলার। বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের প্রধান বিক্রেতা না হলেও এই অতীব দুটি মূল্যবান সম্পদ জর্ডানের অর্থনীতির মূল শক্তি।
দিনারের ঊর্ধ্বমানের নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক এবং রাজস্ব নীতিতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা। এর ফলে একদিকে আভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রার মূল্য স্থিতিশীল থাকে। অন্যদিকে, বিশ্ব বাজারের উত্থান-পতনের ধাক্কা থেকে জর্ডানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত থাকে।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ দামি মুদ্রাগুলোর শীর্ষ ১০-এর ঠিক মাঝামাঝিতে রয়েছে ব্রিটিশ পাউন্ড। ১ ব্রিটিশ পাউন্ড ১ দশমিক ২৭ মার্কিন ডলারের সমতূল্য। সাম্প্রতিক নানা ধরনের রাজনৈতিক ঝামেলার পরেও পাউন্ড ২০২৪ সালের পঞ্চম শক্তিশালী মুদ্রা। এর পেছনে মূলত দুটি বিষয় দায়ী। এক জিবিপ’র জনপ্রিয়তা এবং দুই, সংগৃহীত মোট রাজস্ব আয়ের দিক থেকে এই দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম দেশগুলোর অন্তর্ভূক্ত।
বিশ্বের ৭ম দামি মুদ্রা জিব্রাল্টার পাউন্ড দিয়ে প্রতি মুদ্রায় ১ দশমিক ২৭ মার্কিন ডলার ক্রয় করা যায়। জিব্রাল্টারের ইতিবাচক অর্থনীতির নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জিবিপির বিপরীতে লেনদেনের জন্য জিআইপির ফিক্স্ড রেট নির্ধারণ করা আছে। শুধু তাই নয়, ১ জিআইপি সমান ১ জিবিপি ধরা হয়।
৬ষ্ঠ মূল্যবান মুদ্রাটি হলো কেম্যান আইল্যান্ড্স বা কেম্যানিয়ান ডলার, যার ১ কেম্যান ডলার ১ দশমিক ২০ মার্কিন ডলারের সমান। ইউএস ডলার কেনার জন্য এই মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার নির্ধারিত রয়েছে। এই ফিক্স্ড রেট এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের নিজস্ব অর্থনীতি কেওয়াই ডলারের স্থিতিশীলতা বজায় থাকার মূল কারণ। এছাড়া সরকারি ঋণ পরিশোধ এবং মোট রাজস্ব আয়ের দিক থেকেও দেশটির অবস্থান বেশ শক্তিশালী।
বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ সুইজারল্যান্ডের সুইস ফ্রাঙ্ক এই তালিকার ৮ম শক্তিশালী মুদ্রা। প্রতি সুইস ফ্রাঙ্কের বিপরীতে ১ দশমিক ০৯ ইউএস ডলার লেনদেন করা যায়।
রাজনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের নির্ভরযোগ্য গন্তব্য সুইজারল্যান্ড। নিম্ন বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতিসহ স্বতন্ত্র অর্থনীতির দৌলতে নিরাপদ মুদ্রায় পরিণত হয়েছে সুইস ফ্রাঙ্ক। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) মুদ্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করে।
মার্কিন ডলারের পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ মুদ্রা এবং দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবসা করা মুদ্রা ইউরো। ১ ইউরোর বিনিময়ে পাওয়া যায় ১ দশমিক ০৮ মার্কিন ডলার।
ইউএস ডলারের পরেই সারা বিশ্ব জুড়ে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) স্বতন্ত্র অর্থনীতিতে ব্যবহৃত এই মুদ্রা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তাই বিনিয়োগকারীরা যে মুদ্রাগুলোয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সেগুলোর মধ্যে ইউরো অন্যতম।
তাছাড়া ইউরো অঞ্চলগুলোতে সুদের হার সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সুদের হারের চেয়ে কম। কিন্তু সরকারি ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বিশ্বের শক্তিশালী মুদ্রার তালিকায় ইউরো ৯ম স্থানে।
বিশ্বের বৃহত্তম রিজার্ভ মুদ্রা এবং সর্বাধিক ব্যবসা করা মুদ্রার নাম মার্কিন ডলার। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক এই ডলারকে প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ধরে রাখে।
কিন্তু বিশ্বের মূল্যবান মুদ্রাগুলোর মধ্যে এর স্থান ১০-এ। কেননা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ডলারের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
দেশটি রপ্তানির চেয়ে আমদানি করে বেশি, বিধায় ডলারের দামের উপর সার্বক্ষণিক একটি নিম্নমুখী চাপ থাকে।
তাছাড়া বিভিন্ন দেশের সুদের হারের চেয়ে ইউএসএ’তে সুদের হার সাধারণত কম। এটি অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের ডলার দ্বিমুখী করে তোলে।
ক্রম | মুদ্রা | মূল্যমান
(মার্কিন ডলার) |
মূল্যমান
(বাংলাদেশি টাকা) |
১ | কুয়েতি দিনার (কেডব্লিউডি) | ৩ দশমিক ২৬ | ৩৮২ দশমিক ০৯ |
২ | বাহরাইনি দিনার (বিএইচডি) | ২ দশমিক ৬৫ | ৩১১ দশমিক ১৯ |
৩ | ওমানি রিয়্যাল (ওএমআর) | ২ দশমিক ৬০ | ৩০৪ দশমিক ৮৩ |
৪ | জর্ডানিয়ান দিনার (জেওডি) | ১ দশমিক ৪১ | ১৬৫ দশমিক ৪৭ |
৫ | ব্রিটিশ পাউন্ড (জিবিপি) | ১ দশমিক ২৭ | ১৪৯ দশমিক ১২ |
৬ | জিব্রাল্টার পাউন্ড (জিআইপি) | ১ দশমিক ২৭ | ১৪৭ দশমিক ৪৯ |
৭ | কেম্যান আইল্যান্ড্স ডলার (কেওয়াইডি) | ১ দশমিক ২০ | ১৪০ দশমিক ৮২ |
৮ | সুইস ফ্র্যাঙ্ক (সিএইচএফ) | ১ দশমিক ০৯ | ১২৮ দশমিক ২০ |
৯ | ইউরো (ইইউআর) | ১ দশমিক ০৮ | ১২৬ দশমিক ৯৩ |
১০ | মার্কিন ডলার (ইউএসডি) | ১ দশমিক ০০ | ১১৭ দশমিক ৩০ |
২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই ১০টি মুদ্রা সমষ্টিগতভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচায়ক। তাছাড়া দেশগুলোর আর্থিক শক্তির এক সুক্ষ্ম তুলনামূলক বিশ্লেষক এই মুদ্রামানগুলো। এই বিশ্লেষণে নিরিখে উন্মুক্ত হয়েছে সরকারি ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো সূচকগুলোর। এগুলোর কারণেই বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি লেনদেন করা মার্কিন ডলার এবং ইউরো থেকে এগিয়ে রয়েছে সুইস ফ্রাঙ্ক, পাউন্ড ও কেম্যান ডলার।
জাতীয় বাজারে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরুণ নিজের মুদ্রার সর্বাধিক মূল্যমান নিশ্চিত করে এসেছে কুয়েত। মুদ্রার দাম বৃদ্ধির এই কারণগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ইউএনবি নিউজ
Leave a Reply