শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:১১ অপরাহ্ন

তৃতীয় প্রজম্মের রিফিউজি ও আরেক বুদ্ধ

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায়

রিফিউজি। সারা পৃথিবীতে একটি পরিচিত শব্দ। প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্ত থেকে কেউ না কেউ রিফিউজি হচ্ছে। কেউবা স্বেচ্ছায়, কেউবা বাধ্য হয়ে। পৃথিবীর হাজারটি সমস্যার, সভ্যতার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ কোটি সমস্যার মধ্য একটি সমস্যা এই রিফিউজি সমস্যা। সমাজ বিজ্ঞানের কোন সমস্যার যেমন পার্মানেন্ট সমাধান নেই, এ রিফিউজি সমস্যারও তেমনি এখনও কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি। হওয়াও দূর অস্ত।

পৃথিবীর নানান প্রান্তের রিফিউজিদেরকে বার বার দেখার সুযোগ হয়নি। মিডলইস্টের রিফিউজিদের কয়েক জনকে জানার সুযোগ পেয়েছি ইউরোপে। আফগান কয়েক রিফিউজিকে জানার সুযোগ হয় আমেরিকাতে ও ভারতে। মালয়েশিয়ার কিছু রিফিউজিকেও জানার সুযোগ হয়েছে। থাইলান্ড বা সিঙ্গাপুরের কয়েক জেনারেশানের ভারতীয় রিফিউজিদের ও বার্মার রিফিউজিদের সঙ্গে অল্প কিছু ইন্টারেকশানের সুযোগ হয়েছে।

তবে সব থেকে বেশি সুযোগ হয়েছে, পূর্ববাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ভারতে যারা রিফিউজি হয়েছে তাদেরকে জানার। এবং ভারত থেকে যারা পূর্ববাংলায় রিফিউজি হয়ে আসে তাদেরকে জানার।

এই দুই শ্রেনীর রিফিউজিদের এখন তৃতীয় প্রজম্ম চলছে। সুযোগ হয়েছে এদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজম্মকে দেখার। এখন তৃতীয় প্রজম্মকেও দেখার সুযোগ হচ্ছে। এছাড়া আরো একটি রিফিউজি শ্রেনীর দ্বিতীয় প্রজম্মকে দেখার সুযোগ হচ্ছে, সত্তরের দশকে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিলো তাদের দ্বিতীয় প্রজম্মকে।

 

রিফিউজি ক্যাম্প ১৯৪৭

ভারত থেকে যারা পূর্ববঙ্গে এসেছিলো, এদের প্রথম প্রজম্মের বড় অংশের গেছে নিজ মাটির স্মৃতি নিয়ে। তাদের সারাক্ষণ কথা ছিলো তাদের “মাকান” নিয়ে। আর পূর্ববাংলা থেকে যারা ভারতে গিয়েছিলো তাদের সারাক্ষণ কথা ছিলো তাদের “ মাটি” নিয়ে।

ভারত থেকে পূর্ববঙ্গে এসেছিলো কম সংখ্যক। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে গিয়েছিলো বেশি সংখ্যক। তাই ১৯৪৭ এর পর থেকে ষাটের দশক অবধি যারা ভারত থেকে পূর্ববঙ্গে এসেছিলো- পূর্ববঙ্গের বা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহযোগীতা করার সুযোগটি তুলনামূলক বেশি ছিলো, পূর্ববাংলা থেকে যারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ অনান্য রাজ্যে প্রবেশ করে তাদের তুলনায়।

পূ্র্ববঙ্গ থেকে বেশি মানুষ চলে যাবার ফলে এখানে বাড়ি ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি খালি পড়ে থাকে। যে কারণে ভারত থেকে যারা সর্বস্ব হারিয়ে এখানে এসে প্রথমে ক্যাম্পে উঠেছিলো তাদেরকে দ্রুত ভালোভাবে পুর্ণবাসন করা হয়।

কমরেড তোয়াহার আত্মজীবনীতে দেখা যাচ্ছে, সরকারের নীতি ছিলো তখন, যারা একটা বাড়ি ফেলে এসেছে তারা শুধু একটা বাড়ি ফেলে আসেনি, সঙ্গে সম্পদও ফেলে এসেছে।  তাই একটি বাড়ির বদলে দুটি বাড়ি তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিলো। আবার যারা একটি দোকান ফেলে এসেছিলো তাদের জন্যে দুটো দোকান বরাদ্দ হয়েছিলো। কমরেড তোহায়া লিখছেন, এক পর্যায়ে কেউ কেউ এখানে বাড়তি সুযোগও নেয়। তারা ওখানে একটি দোকানের মালিক থাকলেও এখানে এসে বলে তাদের দুটি দোকান ছিলো। তাতে তারা চারটি দোকান পায়।

কিন্তু তাদের এই সৌভাগ্য বেশিদিন থাকেনি। কারণ, যেহেতু তাদের জীবনের প্রতিটি অঙ্গে মাখানো ছিলো দাঙ্গার রক্ত আর আপন মাকান ফেলে আসার স্মৃতি। তাই তারা এই স্মৃতির বিপরীতে পাকিস্তানকে তাদের আপন মনে করেছিলো। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রক্ষার নামে তাদের অনেককে দিয়ে অনেক নৃশংস কাজও করানো হয়।

যার মূল্য তাদেরকে আরো কঠিনভাবে দিতে হয়। অর্থাত্‌ তাদের বড় অংশকে আবার রিফিউজি ক্যাম্পে যেতে হয়। যে ক্যাম্প জেনেভা ক্যাম্প নামে পরিচিত হয়। আর তাদের নামের ব্রান্ড তখন রিফিউজি থেকে আটকে পড়া পাকিস্তানি হয়ে যায়। সাংবাদিক হিসেবে, পরিচিত জন হিসেবে ও উর্দু সাহিত্যকে জানার আগ্রহ থেকে- এই আটকে পড়া পাকিস্তানিদের জীবন খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। যা এক অন্য ধরনের উপন্যাস। যে উপন্যাসকে তুলে আনতে হলে, বঙ্কিমের মত শক্তিশালী ঔপন্যাসিক ছাড়া সম্ভব কি? যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সত্যি অর্থে সাহিত্য হবে যখন একটা মহাকাব্য লেখা হবে তখনই। কারণ, এই ঘটনার ভিতর দিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষ এ মহাকাব্যের চরিত্র হয়ে গেছে। আর মুজতবা আলীর মতে সে মহাকাব্য লেখার জন্যে আরেকজন মাইকেলের জম্ম অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

ভারত থেকে পূর্ববঙ্গে আসার বিপরীতে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিণ্ণ প্রদেশে অর্থাত্‌ আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে রিফিউজি প্রবেশ করে বেশি। এবং এর সিংহভাগ প্রবশে করে পশ্চিমবঙ্গে।

Geneva Camp



পশ্চিমবঙ্গে এদেরকে দেবার মতো ওইভাবে কোন খালি বাড়ি ঘর বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাই স্বাভাবিকভাবে এদের একটি বড় অংশের জীবন নেমে যায় মানবেতর জীবনে। স্কুল শিক্ষক থালা হাতে ভিক্ষাবৃত্তিকেও গ্রহন করেন।

তবে ভারত থেকে যারা পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন, তাদের তুলনায় পূর্ববঙ্গ থেকে যারা ভারতে গিয়েছিলেন, তাদের একটা অংশের অন্য একটি বড় সম্পদ ছিলো। যা শিক্ষা। এই শিক্ষা সম্পদের অধিকারী বেশি ছিলো উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। যে শিক্ষার জোরে দেখা যায়, দ্বিতীয় প্রজম্ম আসতে আসতে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ওই রিফিউজিরা মোটামুটি দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দক্ষিণ ভারত আর সর্বোপরি কোলকাতাতে তাদের বড় অংশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

হয়তো সার্বিক রিফিউজিও সেদিন পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আরো ভালোভাবে সম্ভব হতো, যদি ওই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার নিয়ে একটি প্রদেশ গঠনটি বামপন্থীদের আন্দোলনের মুখে ব্যর্থ না হয়ে যেতো। এখানে বামপন্থীদের দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। কারণ এই উপমহাদেশে যারা বামপন্থী রাজনীতি করেছে, ইতিহাস অন্তত তাদেরকে একটি পুরস্কার ঠিকই দেবে যে তারা কখনও কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি।

যাহোক, ও বিষয়ে বলতে গেলে লেখা অন্য দিকে চলে যাবে। তবে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া রিফিউজিদের ব্যবস্থাপনার নথি পত্র যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, উত্তর ভারতীয় রাজনীতিক আধিপত্যের ভারতে এই উত্তর পূর্ব ভারতের রিফিউজিদের সমস্যা বোঝা সম্ভব হয়নি। যতটুকু যা হয়েছিলো তা বিধান রায়ের অনেকটা একক চেষ্টায়। তাই পাঞ্জাবের রিফিউজিদের, সিন্ধুর রিফিউজিদের নিয়ে ভারত সরকার যতটা সফল ছিলো সে তুলনায় বাঙালি রিফিউজিদের নিয়ে নয়। যারফলে বাঙালি রিফিউজিদের নিম্ম বর্ণের মানুষগুলো পড়ে আরো বেশি বিপাকে। কারণ এই নিম্মবর্নের মানুষগুলো নদী বা সমুদ্র কূলের মানুষ। তাদের যারা নদী বা জমি’র কাজের সঙ্গে জড়িত তারা ওইভাবে অন্য কোথাও নিজেদেরকে মানাতে পারছিলো না। আর আন্দামান দ্বীপকে তারা মনে করেছিলো কালাপানি পার। বা ভয়বহ এক মৃত্যুযাত্রা।

তাই বাংলাদেশের আটকে পড়া পাকিস্তানিদের মতো পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে যাওয়া নিম্ম বর্ণের হিন্দু রিফিউজিদের জীবন আরেক ভয়াবহ উপন্যাস। যার জন্যেও বঙ্কিমকে আবার জম্মাতে হবে। তারপরে এই রিফিউজি ধারা বহমান। শেষ হচ্ছে না।

কেন শেষ হচ্ছে না তা লিখতে গেলেও এ লেখা অন্যদিকে চলে যাবে। এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের মনস্তাত্বিক দিক বা ভারতে যাওয়া নিম্ম বর্নের হিন্দু রিফিউজিদের মনস্তাত্ত্বিক দিক ও দুর্দশ এগুলো নিয়ে বই লেখা যায়, কোন কলামে এর প্রকাশ সম্ভব নয়।

তবে সত্য হলো, সময়ের বিবর্তনে এসব এখন আড়ালে চলে গেছে। আরো আড়ালে চলে যাবে। আর এটাই সময়ের নিয়ম। হয়তো শত শত বছর পরে এখন যেমন আমেরিকাতে আফ্রিকান আমেরিকানদের আর্টগুলো অর্থাত  নাচ, সুর, ছবি এগুলো মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয় ওরা আমেরিকান হলেও আফ্রিকান আমেরিকান। তেমনি শত শত বছর পরে পূর্ববাংলার ভাটিয়ালি বা ভাওইয়া বা কী‍র্তনের কোন সূর যখন উত্তর ভারতীয় বা দক্ষিন ভারতীয় সুরের সঙ্গে মিশে একটা নতুন কিছু তৈরি করবে- তখন হয়তো কারো মনে পড়বে এটা পূর্ববঙ্গীয়।

তাছাড়া পৃথিবীর চলমান বাস্তবতার স্রোত এতটাই নির্মম যে দ্বিতীয় প্রজম্মের পরে তৃতীয় প্রজম্মে এসে নদী প্রায় পরিপূর্ন বাঁক নেয়। সে বাঁকের খোঁজ মেলে তিস্তার বাঁকে।

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা বালুর দ্বীপ

ভারতের তিস্তা ব্যারেজের দুটি গেট দিয়ে ক্ষীন আকারে ঘোলা জল বাংলাদেশের দিকে বড় একটা চড়া ঠেলে এঁকে বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর বালুর চড়াটি এখন বিকেলে বেড়ানোর একটি দ্বীপের মতো হয়ে আছে। যে কারণে নদীর বাধের ওপর ও পাশে বসেছে সমুদ্র অবকাশের চড়ার মত  বড় বড় ছাতার নিচে টেবিল। আর তার সঙ্গে মেক শিফট রেস্তোরা। যেখানে বিকেলে শিলিগুড়ি থেকে আনন্দময় বিকেল কাটাতে আসে অনেক মানুষ।

দূরন্ত গ্রীষ্মের গনগনে রোদ মাথায় করে নিয়ে সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, সব ফাকা পড়ে আছে। ব্যারেজ থেকে বের হওয়া তিস্তার ঘোলা জল এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের তিস্তা নদীর পথে। আর দূরে সীমান্ত রেখার মতো বাংলাদেশের সবুজ বনানী। এক দিকে মৃত প্রায় তিস্তা। আর তার ওপরে দৈত্য’র মতো ব্যারেজ। সামনে ভ্রমন পিপাসুদের বৈকালিক ক্ষেত্র তিস্তার বুকের চড়া। এর সঙ্গে আর যা আছে সে কথাও এখানে নয়। চিন্তাক্লিষ্ট মনে যখন এসব দেখছি আর ভবিষ্যতের রেখা আকার চিন্তা করছি এ সময়ে একটি মিষ্টি গলায় চমকে উঠি। নদীর বাঁধের ঝোপের ছায়ায় বসা একটি তের চৌদ্দ বছরের ছেলে এগিয়ে এসে বলে, চড়ায় যাবেন?

তিস্তা ব্যারেজ

কীভাবে যাব?

ওই যে আমার নৌকা আছে, নৌকা নিয়ে আসি।

নদীতে অত ছোট নৌকা ডুবে যাবে নাতো?

এক গাল হাসি ছড়িয়ে বলে, ডুববে কীভাবে নদীতে জল নেই তো নৌকা ডোবার।

এতবড় নদীতে নৌকা ডোবার জল নেই!

চলেন না আমার সঙ্গে। দেখবেন লগি দিয়ে দেখিয়ে দেব কতটুকু মাত্র জল আছে।

এত ছোট নৌকায় উঠতে ভয় করে।

আমি হাত ধরে তুলবো। ভয় করবেন না। আপনি দাঁড়ান আমি নৌকা নিয়ে আসি।

হাত ধরেই সে নৌকায় তোলে। দূপুরের তীব্র রোদ আর ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মাথায় নিয়ে সে চড়ায় গিয়ে নামি। যদিও চড়া পাড়ে দাঁড়িয়েই পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো। তবে সেই যেন কপালকুন্ডলার মতো কোন একটা ঘোরে ফেলে নিয়ে গেলো ওই চড়ায়।

চড়া থেকে ফিরে আবার তার হাত ধরে নৌকা থেকে নামার পরে তার কাছে জানতে চাই,  তাদের বাড়ি কোথায়?  সে আঙুল দিয়ে নদীর পাশে রাস্তা ঘেষা একটি ভাঙা চোরা ঘর আর তা কয়েকটি গাছে ঘিরে আছে- সেটাই দেখিয়ে বলে, ওই তাদের বাড়ি।

জানতে পারি সে স্থানীয় একটা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। সকালে বিকেলে আর ছুটির দিকে এ কাজ করে।

 

বুদ্বদেব সরকার

বাবা কি করে জানতে চাইলে আবার তিস্তার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, এই নদীতে মাছ ধরে।

কেমন মাছ পায়?

একটু মাথা নীচু করে বলে, এবার বন্যায় সিকিম থেকে বালু বেশি আসায় ফসলও যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি মাছও কমে গেছে।

এই নদীর ওই দিকে ওই যে সবুজ রেখা দেখা যাচ্ছে ওখানে কোন দেশ জানো?

সে মাথা নেড়ে উত্তর  দেয়। না, জানিনা।

বাংলাদেশের নাম শুনেছ।

বলে, হ্যা, শুনেছি, আমার ঠাকুরদা বলেছিলেন, তার বাড়ি বাংলাদেশে ছিলো।

বাংলাদেশে কোথায় ছিলো?

ঠাকুরদা মারা যাবার পরে এখন কেউ জানে না।

তোমার জানতে ইচ্ছে করে না।

কোন উত্তর নেই।বরং তার মুখের অভিব্যক্তি বলে দেয়। সে আর প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না। হয়তো কিশোর মনের খেয়াল।

তুমি বাংলাদেশের আর কিছু জানো।

মাথা নেড়ে বলে, না।

এবার আগ বাড়িয়ে বলি, আমি বাংলাদেশী। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

না, এ নিয়ে তার মধ্যে কোন আগ্রহ দেখতে পাই না।মুখে কোন পরিবর্তন নেই। অথচ ষাটের দশকের মধ্য প্রদেশে প্রথম প্রজম্মের রিফিউজিরা যখনই শুনেছে, পূ্‍র্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি। তারা ঘিরে ধরেছে। তাদরে তাবুতে নিয়ে গেছে। যা ছিলো তাই খাইয়েছে। সে স্মৃতি মনে করে আবার তার দিকে তাকিয়ে  তাকে প্রশ্ন করি, তোমার নাম কি?

অতি নিরুত্তাপ গলায় বলে, বুদ্ধদেব সরকার।

তোমাদের বাড়ির থেকে দূরে ওই বাড়িটা কাদের?

আবার বিরক্তিতে উত্তর, ঠিক জানিনা।

এর ভেতর বুদ্ধদেবের কয়েকটি ছবি আমার নেয়া হয়ে গেছে।

তাই তার নৌকা ভাড়া মিটিয়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবি,  তৃতীয় প্রজম্মে এসে পূর্ববাংলার নির্ম্মবর্ণের হিন্দু রিফিউজিরাও তাদের পুর্ব পুরুষের মাটি ভুলে গেছে।

কিন্তু তারপরেও তাকে রিফিউজি মনে হতে থাকে। পৃথিবীর সকল রিফিউজির মতো সেও অনেকটা সঙ্গীহীন। দূরের বাড়িটা কার তাও জানে না। আগ্রহ নেই।

অর্থাৎ এ প্রজম্মে এসে  সে তার পূর্ব পুরুষের মাটি পরিপুর্ণভাবে ভুলে গেলেও রিফিউজির অনেক স্বাভাবিক উপসর্গ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। তার সঙ্গী কম হবেই। আর এই নিঃসঙ্গতা তার আর কিছু না করুক আয়ু কমিয়ে দেবে। প্রথম প্রজম্মের থেকে হয়তো বেশিদিন বাঁচবে। তবে তারপরেও সে দেশের গড় আয়ুর থেকে তার আয়ূ কম হবে। সারা পৃথিবীর রিফিউজি বা অভিবাসীদের মতো। যদিও বলা হয়, এই গড় আয়ু কম থাকে প্রথম প্রজম্মে। কিন্তু বাস্তবতা আরো নিষ্ঠুর।

এ সব ভাবতে ভাবতে আবার তার দিকে ফিরে তাকাই- কেন যেন মনে হয়, ওর মুখে একটা সব কিছু মেনে নেয়ার চরিত্রের ছায়া। অর্থাৎ সেও আরেক সর্বংসহা বুদ্ধ।

লেখক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.  

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024