মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
একেবারে ওই জগতে তলিয়ে গেছে বলতে পারো। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় রেখে এক একটা পাথরের দিকে তাকিয়ে প্রায় সারারাত কাবার ক’রে ফ্যালে এখন। বলে মানুষের তৈরি জিনিশ নিয়ে অনেকেই তো নাড়াচাড়া করে, এ হচ্ছে প্রকৃতির জিনিশ, স্বয়ং খোদার হাতে তৈরি, এর চেয়ে মহার্ঘ্য আর কি হ’তে পারে। আসলে এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করার নেশা ওকে পেয়ে বসেছে; আর এমনভাবে পেয়ে বসেছে, যে ওটাকেই পেশা ক’রে দিনরাত রুজির ধান্ধায় বুঁদ হ’য়ে আছে।
চাকরিতে ক’টা টাকারই বা সংস্থান হয় বরং এটা একটা স্বাধীন ব্যবসা; বাইরে থেকে ওর এই পেশাটাকে তাই ভীষণ একটা লাভজনক ব্যাপার ব’লে মন হয়। কিন্তু আমি জানি, লাভের কথা ভেবে, অঢেল কামাই করার লোভে ও এ পথে পা বাড়ায়নি। টাকাপয়সার জন্যে মাতলামি ওর স্বভাবে কখনো দেখিনি, বরং উল্টোটাই সবসময় মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে একটু বেশি রকমেরই উদাসীন। অষ্টপ্রহর এই যে, গ্রহরত্ন গ্রহরত্ন ক’রে বুঁদ হ’য়ে আছে মানুষটা সেটা আর কিছু নয়, মদের মতো একটা নেশা। যা একদিন ওর স্বভাবে ছিলো গান গাওয়া, এস্রাজ বাজানো, সেই নেশারই অন্য চেহারা, যেমন একদিন ভালবাসতো আমাকেও।
উৎস একটাই। মন উঠে গেছে ব’লে নিছক আত্মপক্ষ সমর্থন করার ফন্দি এঁটে পেটবানান্তি কথার রাশ মেলে ধরছি, তুমি নিশ্চয়ই এই ধরনের একটা কিছু ভাবছো। বিশ্বাস করো, এসব কথার পিঠে স্রেফ কথা নয়, হঠাৎ কোনো মন কচলানির জেরও নয়। যা কষ্ট দেয়, যা খিচড়ে দেয় আমার মনকে, নষ্ট করে মনের শান্তি, তার মুখোমুখি দাঁড়াতে আমি ভালবাসি: চিরকেলে স্বভাব ওটা আমার। আগেই তো বলেছি, জীবনের জটিলতাকে আমি ঘৃণা করি, মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।
দরকার হ’লে জট ছাড়িয়ে নিই, না পারলে চেষ্টা করি পাশ কাটিয়ে যাবার। পুরানো কথায় ফেরা যাক। নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেই ধ’রে নিতে পারো, শেষ পর্যন্ত স্বামীর সবকিছুর এইভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে হ’লো। যেটা আমার স্বভাব জিগ্যেশ করলাম নিজেকে, স্পষ্ট জবাব চাইলাম নিজের কাছে। উত্তরও পেলাম। গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এসাজ থেকে আমি, শেষে গ্রহরত্ন: আমি ভেবে দেখলাম ও ঠিকই আছে, ওর পিছনের দিকে তাকাবার অবসরই নেই। ওর প্রাণশক্তি আছে, একটা ছেড়ে আরেকটায় যাবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমার?
Leave a Reply