শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০২:০৪ অপরাহ্ন

অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক ভোট

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪, ৩.০০ পিএম

সুমন চট্টোপাধ্যায়

প্রশান্ত কিশোর জীবনে কখনও ভোট বিশেষজ্ঞ ছিলেননা, একটি বিশেষ দলের হয়ে একটি বিশেষ নির্বাচনে তিনি ‘পলিটিকাল স্ট্রাটেজিস্ট’-এর দায়িত্ব পালন করেছেন চোখ-ধাঁধানো সাফল্যের সঙ্গে। ২০১৪-র লোকসভায় নরেন্দ্র মোদীকে সাহায্য করা ছাড়া প্রশান্ত আর কোনও লোকসভা ভোটে কোনও দলের হয়ে কৌশল নির্ধারণের কাজ করেননি, বাকি সবটাই রাজ্যস্তরে কোনও না কোনও দলের হয়ে। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশে জগন রেড্ডি, তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিন, পাঞ্জাবে অমরিন্দর সিং, দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীওয়াল, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের পরে সেই কাজেও তিনি ইতি টেনেছেন।

যোগেন্দ্র কিন্তু সর্বার্থেই ভোট-পন্ডিত, কেতাবী পরিভাষায় যাঁকে বলা হয় ‘সেফোলজিস্ট’। সেই ১৯৯৬ সাল থেকেই। একদা প্রণয় রায়ের সঙ্গে তাঁর ভোট বিশ্লেষণের যুগলবন্দী দর্শক টানত হু হু করে। সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস (সি এস ডি এস)-এর প্রাক্তনী যোগেন্দ্র অত্যন্ত বিনয়ী, মিতভাষী, প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত তার্কিক, তত্ত্বের সঙ্গে গণিতের মেলবন্ধন করতে পারেন সহজিয়া বিশ্লেষণে। প্রশান্ত কিশোরের মতো তিনিও কিছুকাল হোল পেশাদারি স্তরে ভোট বিশ্লেষণের কাজে ইতি টেনে নিজের দল গঠন করে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পরে কংগ্রেসের মৃত্যু কামনা করলেও এখন তিনি সেই অবস্থান থেকে অনেক দূর সরে এসেছেন। কংগ্রেসের সদস্য না হলেও তিনি অধুনা রাহুল গান্ধির ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম, তাঁর সঙ্গে প্রথম দফার ভারত জোড়ো যাত্রায় পা মিলিয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত।

এবার লোকসভা ভোটের ভেরি-ঘোষ বেজে ওঠার আগে যোগেন্দ্র- পন্ডিত ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যত সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন যদিও কখনওই আশা ছাড়েননি। ভোট শুরুর অব্যবহিত আগেও তিনি বলেছিলেন ‘দ্য গেম ইজ স্টিল অন।’ তারপর ভোটের প্রথম পর্ব সমাধা হওয়ার পর থেকেই তিনি পুরোদস্তুর নিজের তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করতে করতে শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে বিজেপি এবারও বৃহত্তম দল হবে তবে এককভাবে গরিষ্ঠতা পাবেনা। তাঁর সর্বশেষ হিসাব হোল ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপি এবার কম করেও অন্তত ৫০টি আসন কম পাবে। তার অর্থ দাঁড়ায় দু’চারটে কম-বেশি আড়াইশটি আসন। অবশ্য বিজেপির শরিক দলগুলি ৪০-৪৫টি আসনে জিতে এন ডি এ সরকার গঠন করবে। তবে বিজেপি বিরোধী অসন্তোষের চোরা স্রোেত যদি তাঁর আন্দাজের বাইরে আরও খরস্রোতা হয় সেক্ষেত্রে বিজেপির আসন সংখ্যা আরও নীচে নামবে, হয়ত এন ডি এ-র পক্ষে সরকার গড়া সম্ভব হবেনা। তবে যোগেন্দ্রর মতে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি বাস্তবায়িত হওয়ার অবকাশ কম। মোদ্দা কথায় যোগেন্দ্র পন্ডিতের মূল্যায়নের সারকথা এবার বিজেপির নেতৃত্বে এন ডি এ কোয়ালিশন সরকার দিল্লি দখল করতে পারে যার রাজনৈতিক ফল হবে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রশান্ত এবং যোগেন্দ্র দু’জনেই কবুল করছেন তাঁদের হাতে কোনও প্রাইমারি ডাটা নেই। প্রশান্তর সিদ্ধান্ত কয়েকটি সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি ‘ম্যাক্রো পিকচার’ অথবা সামগ্রিক চিত্র মাত্র। যোগেন্দ্র নির্ভর করছেন তাঁর ব্যক্তিগত নির্বাচনী সফরের অভিজ্ঞতা আর তাঁর নিজস্ব লোকজনের পাঠানো ইনপুটের ওপরে। এদিক থেকে দেখলে দু’জনের কারও ভবিষ্যদ্বানীকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় কেননা তাদের ব্যাখ্যার গাণিতিক ভিত্তি নেই। তবু তাঁদের বাকযুদ্ধ প্রাপ্যের অতিরিক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে দুটি কারণে। এক) নাম দু’টি ভারী তাই অবজ্ঞা করা যায়না। দুই) নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে-বিপক্ষে জনমত এতটাই মেরুকৃত যে উভয় শিবিরই একজন বিশ্বাসযোগ্য মুখপাত্র হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। ইউ টিউবের বিশ্বে এঁরা দু’জনেই এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম, এঁদের চ্যালা-চামুন্ডারাও দিব্যি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সমর্থকদের মতো ডিজিটাল গ্যালারি কাঁপাচ্ছেন।

যোগেন্দ্রর আঁকের খাতায় বিজেপির আসন কমবে দক্ষিণে কর্ণাটকে, পশ্চিমে মহারাষ্ট্রে, উত্তরে উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থানে এবং পূবে বিহার ও ঝাড়খন্ডে। বাড়বে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরলে। বিজেপির শরিক দল যেমন বিহারে জনতা দল, মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের শিবসেনা, অজিত পাওয়ারের এন সি পি-র ভরাডুবি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সব মিলিয়ে কাটাকুটি করে বিজেপির কমবে রক্ষণশীল হিসেব অনুসারে অন্তত ৫০ টি আসন।

যোগেন্দ্রর মূল্যায়নের প্রতিপাদ্য প্রশান্ত কিশোরের ঠিক বিপরীত। সংক্ষেপে তাঁর যুক্তি এই রকম। এক) এবারের ভোটে মোদী ম্যাজিক অনুপস্থিত, কোনও জাতীয় ইস্যুই নেই। যে অসুবিধা আগের দু’টি নির্বাচনে বিজেপির ছিলনা, ২০১৪ সালে ছিল মনমোহন সরকার সম্পর্কে দেশব্যাপী ক্ষোভ, পাঁচ বছর পরে পুলওয়ামার বদলায় বালাকোট। জাতীয় ইস্যুর অনুপস্থিতিতে এবারের ভোট আর নেতৃত্বের প্রশ্নে গণভোটের চেহারা নিতে পারেনি। ফলে একা নরেন্দ্র মোদী ভোট-বৈতরণী পার করে দেবেন সে গুড়ে বালি। মোদী এখনও দেশের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয় নেতা সন্দেহ নেই। কিন্তু ভোট এবার তাঁর নামে হচ্ছেনা।

২) এর পরিণতি স্বরূপ মোদীকে এবার রাজ্যে রাজ্যে স্থানীয় বিরোধী নেতাদের সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে। যেমন বিহারে হচ্ছে মোদী বনাম তেজস্বী, পশ্চিমবঙ্গে মোদী বনাম মমতা কিংবা মহারাষ্ট্রে উদ্ধব- শারদ বনাম মোদী। জাতীয় ইস্যুগুলি গুরুত্ব হারানোয় তাই এবার রাজ্যস্তরের ইস্যুগুলি চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। মোদীর গ্যারান্টি ভোটারের কানের ভিতর দিয়ে মরমে তেমনভাবে প্রবেশ করছেনা। অস্যার্থ সাধারণ নির্বাচনের মোড়কে আসলে দেশের সাতাশটি রাজো হচ্ছে সাতাশ ধরনের বিধানসভা নির্বাচন, যেখানে জাত-পাতের অঙ্ক, প্রার্থীর সুনাম-দুর্নাম, স্থানীয় জাতি-

বিন্যাস, স্থানীয় সমস্যা নির্নায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যোগেন পন্ডিত একে আখ্যা দিয়েছেন, ‘নর্মাল ইলেকশন ইন অ্যাবনর্মাল টাইমস।’

পন্ডিতের মূর্খামির কথা অনেক হোল। আগামী কাল দেখাব মূর্খের পান্ডিত্যের কিছু ঝলক। (চলবে)

 

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024