মুকিমুল আহসান
দীর্ঘদিন থেকে আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতি রেখে বাজেট দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। তবুও প্রতি বছরই বাড়ছে বাজেটের আকার। যার প্রভাব পড়ছে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। কেননা বাজেটের বড় একটা অংশ আসে নাগরিকদের দেয়া কর থেকে।
আগামী বৃহস্পতিবার ঘোষণা হবে বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর বাজেটের প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশের নতুন বাজেট ঘোষণার দু’দিন আগে সোমবার পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে দেশের চলতি বছরের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়লেও মানুষের বেতন সে অনুপাতে বাড়ছে না। কিন্তু হিসাবনিকাশ বলছে নতুন বাজেটে সাধারণ মানুষের উপর আবারো বাড়তে পারে করের বোঝা।
মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির ফলে নতুন করে দারিদ্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আব্দুল বায়েস বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যারা গরীব তাদের জন্য এটা কষ্টদায়ক। মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে হতদরিদ্রদের ওপর।”
মূল্যস্ফীতি বাড়লেও বিপরীতে কমছে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। এর প্রভাব নতুন বাজেটে পড়তে পারে বলে ধারণা দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
“অর্থনীতির এই জটিল হিসাবনিকাশ সাধারণ মানুষরা বোঝেন না। তারা বোঝেন প্রতি বার বাজেট মানেই ব্যয়ের নতুন নতুন খাত তৈরি হওয়া,” বলেন মি. বায়েস।
বাজেটের আগে বিবিসি বাংলার কাছে এমন এক আতঙ্কের কথা বলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী আব্দুল আলীম।
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে বাজেট মানেই এক দফায় দাম বৃদ্ধি। বাজেট আসলেই আমাদের চিন্তা করতে হয় কোন খরচ বাদ দিয়ে কোন খরচ মেটাবো।”
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আমলা কিংবা প্রভাবশালীদের প্রভাব বেশি থাকায় অনেক সময় সাধারণ মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখেন না বলে মনে করছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতিবিদ ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জনগণের প্রতিনিধিদের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। যে কারণে তাদের চাহিদার তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না বাজেটে।”
তবে কর আরোপ, কর্মসংস্থান, করমুক্ত আয়সীমা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মতো বিষয়গুলোর কারণে বাজেটে নজর থাকে সাধারণ মানুষের।
বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়।
একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
সাধারণত একজন মানুষকেও কিন্তু আয় ও ব্যয়ের হিসাব করে জীবন জীবিকা চালাতে হয়। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সাধারণত ব্যক্তি আগে আয় কত হবে, সেটি ঠিক করেন, তারপর ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রের নীতি উল্টো। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে তার কোন কোন খাত থেকে আয় করা যায় সেটি ঠিক করে থাকে।
অর্থনীতিবিদ মি. মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেন “সাধারণ মানুষের চাহিদাগুলো যদি জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ফুটে উঠতো তাহলে তাদের চাহিদাগুলোর প্রতিফলন ঘটতো। কিন্তু আমাদের দেশে আমলা আর প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোই বাজেটে প্রভাব রাখে।”
গত কয়েক বছর আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতির চক্র নিয়েই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। বাজেটের আকার প্রতি অর্থবছরেই যখন বাড়ছে, তখন ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্যও থাকছে না। যে কারণে বাড়ছে ঋণ নির্ভরতা, যার সুদ দিতে আবার চাপে পড়ছে অর্থনীতি।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সম্প্রতি বাজেট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি জরিপ চালায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি। ওই জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই বলেছেন আগামী বাজেট নিয়ে তারা নতুন কিছু প্রত্যাশা করেন না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন,বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। যে কারণে তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায় না।
এত ঘটা করে বাজেট প্রকাশ করা হচ্ছে, তারপরও কেন সাধারণ মানুষ কেন এটি নিয়ে আগ্রহ পাচ্ছে না এ প্রশ্ন ছিল অর্থনীতিবিদদের কাছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক বয়েস বলেন, প্রতি বছর মানুষ কর দিচ্ছে। করের টাকায় সরকারের ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা যখন সুফল পাচ্ছে না, তখন বাজেট আসলেও তারা খুব একটা আগ্রহ দেখান না।”
তবে জরিপে মতামত দানকারীরা কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সমাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছিলেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে সরকারের মূল লক্ষ্য থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হবে? কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে।
কিন্তু সেটি কতখানি সম্ভব হয়?
মি. মোয়াজ্জেম বলছেন, “বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রতিফলন না থাকলেও প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবের কারণে কর আরোপ করা, তাদের শুল্ক ছাড় দেয়াসহ এই ধরনের বিষয়গুলো আসে। এই বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের নজর এড়ায় না।”
সুমাইয়া আক্তার থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। তার স্বামী চাকরি করেন একটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে। পাঁচ জনের পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “হাজবেন্ডের বেতন ছাড়া আমাদের আয়ের আর কোনো উৎস নেই। বেতন পাওয়ার পর বাসা ভাড়ায় চলে যায় অর্ধেক খরচ। দুই বাচ্চার স্কুল ও পড়ালেখার খরচ মেটানোর পর বাজারের হিসাব মেলাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।”
তিনি জানান, প্রতি বছর বাজেটের পরই বাচ্চাদের খাবার কিংবা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা খাবারের দাম এক দফা বাড়ে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত অন্যান্য খরচ বেড়েই চলছে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতি বছর বাজেটের পরই জিনিসপত্রের দাম বাড়লে বেশি চাপে পড়েন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। আসছে বাজেটের পর নতুন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে।
“নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমলে বাজারে এই ধরনের পণ্যের দাম কমতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, করের শুল্ক সরকার কমালেও অনেক সময় খুচরা পর্যায়ে তার প্রভাব দেখা যায় না নানা কারণে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মোয়াজ্জেম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের সঠিক তদারকি না থাকার কারণে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যে কারণে বাজেটে কম আয়ের মানুষের আয় ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে আসায় শুল্ক খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে এসেছে অনেকটাই। প্রত্যাশার চেয়ে আয় কমে আসায় আয়কর বা করের খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, এবারের বাজেটে শুধু আয়কর থেকেই অন্তত ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা করছে এনবিআর।
সরকারের এই বিশাল টার্গেট পূরণে কোন কোন খাতে নতুন করে কর আরোপ করা হবে, কোন কোন খাতের কর অবকাশ তুলে দেয়া হবে, তাতে কী প্রভাব পড়বে সেটি নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ।
প্রতিবার বাজেট ঘিরে করের দিকেই বেশি নজর থাকে সাধারণ মানুষের। কেননা যা ব্যক্তি পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে।
এমন পরিস্থিতিতে কর আরোপে সরকারকে আরও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
অধ্যাপক বায়েস বলছেন, “শিল্প কারখানা যারা কর কম দিয়েছে তাদেরকে করের আওতায় আনা যায়। আর যে যে খাতে আগে থেকে কর আছে সেগুলোকে দক্ষতার সাথে সংগ্রহ করতে হবে। তাহলে একদিকে রাজস্ব আহরণ বাড়বে অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরও কষ্ট কম হবে।”
প্রশ্ন আছে অনেক খাতে কর দেওয়া হলেও তার প্রকৃত সুফল পায় না সাধারণ মানুষ।
অর্থনীতিবিদ মি. মোয়াজ্জেম বলেন, “বাজেটে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন রকমের প্রভাব থাকে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবের কারণে কর আরোপ করা কিংবা শুল্ক ছাড় দেয়ার মতো বিষয়গুলো আসে। যে কারণে কষ্ট কমে না নিম্নবিত্ত মানুষের।”
সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নিলেও তা উল্টো বেড়েই চলছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আরও বেশি।
সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, মে মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির সূচকগুলোকে টেনে ধরছে। তাতে কষ্ট বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
যে কারণে নতুন বাজেটে সাধারণ মানুষের নজর থাকবে মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের উদ্যোগের দিকে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক বায়েস বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ধনী লোকের জন্য মূল্যস্ফীতি কিছু না। কিন্ত যারা গরীব তাদের জন্য এটা কষ্টদায়ক। মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে হতদরিদ্রদের ওপর।”
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ে না। যে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়লে সাধারণ মানুষ বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply