সারাক্ষণ ডেস্ক
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবার ৪০০ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নির্বাচনী প্রচার থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত ‘আবকি বার ৪০০ পার’ স্লোগান তুলেছিল মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) । কিন্তু ব্যর্থ পুরাটাই। মোদী টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে পারলেও ভোটের অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলে বিস্ময়কর ধাক্কা খেয়েছে পরপর দুইবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ লাভ করা বিজেপি।
গত ছয় সপ্তাহ ধরে চলা নির্বাচনে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক পন্ডিতগণ ভেবেছিলেন মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি একাই নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে।
কিন্তু মঙ্গলবারের ফলাফল দেখে রীতিমতো আৎকে উঠেন অনেকটাই। একদশক ধরে চলমান শাসক দলটি এবার তাদের একক সংখ্যাগরিষ্টতা ধরে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল। মাত্র ২৪০ টি আসন লাভের ফলে তারা ৫৪৩ আসনের সংসদে ৩০ টি আসন কম পেয়ে জোটে যেতে বাধ্য হলো।
দিল্লির সিংহাসনে যেতে অবশ্যই উত্তরপ্রদেশের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল রাজ্যে জয়লাভ করা একটি মূখ্য বিষয় । কেননা এই রাজ্যেই রয়েছে সর্বাধিক ৮০ টি আসন যা সমগ্র ভারতের আসনের ১৫ শতাংশ।
২০১৯ সালের নির্বাচনে রাজ্যের ৮০ টি আসনের মধ্যে ৬২ টিতে জয়লাভ করেছিল কিন্তু এইবার তারা বিজেপি মাত্র ৩৩ টি আসন পেয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু সম্পর্কে তার মন্তব্যের জন্য মোদি এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ব্যপকভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল।
জানুয়ারী মাসে একটি মন্দির উদ্ভোধনে তার ব্যপক সমর্থন হ্রাস পায় বলে অনেকেই ধারণা করছেন। উত্তরপ্রদেশের ৩৮ মিলিয়ন মুসলমানদের মধ্যে ভোটাররা মোদি বিরোধী দলকে ভোট দিয়েছেন। যাকে অনেকটাই কৌশলগত প্রতিশোধ বলে হচ্ছে।
ভিএস চন্দ্রশেকর, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া সংবাদ সংস্থার প্রাক্তন নির্বাহী সম্পাদক বলেছেন , এই ফলাফলটি “বিজেপির জন্য একেবারে ধাক্কার মতো লেগেছে।” তিনি আরো যোগ করেন, “বিজেপি কখনও স্বপ্নে বা কল্পনাও করেনি যে তারা উত্তরপ্রদেশে এমন একটি খারাপ রায় পাবে। কারন এটি হলো তাদের শক্ত ঘাঁটি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটি পরীক্ষাগার।”
মোদির নিজের নির্বাচনী এলাকায় যে প্রার্থী দিয়েছেন তাকে স্থানীয়রা তেমন পছন্দ করেননি, এমনটাও হতে পারে। ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব কে শর্মা বলেন, “বিজেপি স্থানীয় প্রার্থীদের উপেক্ষা করে কিছু জায়গায় বহিরাগতদের এনে প্রার্থীতা দিয়েছিল সেটি তাদের জন্যে নেগেটিভ ফলাফল বয়ে এনেছে।”
ফেব্রুয়ারিতে, কৃষকরা ফসলের ভালো দাম, ঋণমুক্তি এবং কৃষি শ্রমিকদের পেনশনের দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ করেছিল। কিন্তু সামপ্রতিক বছরগুলিতে এই ভোটিং ব্লক ক্রমবর্ধমান মতবিরোধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এটি একটি বোট হারানোর জন্যে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে।
দারিদ্র্যপীড়িত অনেক কৃষক এবং বিজেপি পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থান সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে যেখানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সেখানে আসন লাভে ব্যর্থ হয়েছে।পাশাপাশি, অন্যতম দরিদ্র রাজ্য উত্তর-পূর্ব বিহারেও আসন হারিয়েছে বিজেপি।
চন্দ্রশেখর বলেন, উত্তর প্রদেশে ‘দলিত‘ নামে পরিচিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অনেকটা ভয়েই বিরোধীদের ভোট দিয়েছেন কারন তারা ভেবেছিলেন যে, বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তাদের শিক্ষা এবং সরকারি চাকরি নিশ্চিতে প্রবেশাধিকার নাও দিতে পারে।
প্রতিটি নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রধান চাহিদার তালিকায় থাকা জিনিষগুলির মধ্যে অন্যতম হলো কর্মসংস্থান বাড়ানো। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান কর্মকান্ডে বেশীরভাগ ভোটারই অসন্তুষ্ট। অনেক ভোটারের জন্য বেকারত্ব, আয় কমে যাওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতি ছিল মূল উদ্বেগ। ব্যক্তিগত জরিপে দেখো গেছে, এই এপ্রিলেই বেকারত্বের হার প্রত্যক্ষভাবেই দেখা গেছে ৮.১% এ দাঁড়িয়েছে যা মার্চ মাসে ছিল ৭.৪% । ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারদের প্রায় ৮৩% যুবকশ্রেণী।
বিজেপির সনাতন হিন্দু সমর্থকদের মধ্যে আত্মতুষ্টি আরেকটি কারণ ছিল, তারা ভেবেছিল ৪০০ টিরও বেশি আসন লাভ করবে বলে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী দলটির অনেক সমর্থক ধরেই নিয়েছিল যে তারা ভোট দিক না দিক তাদের পছন্দের দল পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে।
প্রধান বিরোধী কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে একটি জোট নির্বাচনের আগে বিশৃঙ্খলা করেছিল ফলে এর দুই নেতা গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছিলেন যে আপাতদৃষ্টিতে মোদির বিজয় ঠেকানোর কোন রাস্তা থাকলোনা বিরোধীদের।
সব বিরোধীরা মিলে ২৩০ টিরও বেশি আসন পেলো যেখানে একা কংগ্রেস তার ২০১৯ সালে তার পাওয়া মাত্র ৫২ আসন থেকে একলাফে প্রায় দ্বিগুণ ৯৯ টি আসন লাভ করে।
এবারের নির্বাচনে বিরোধীদের এতটা ভাল করার পিছনে অনেক কারনের মধ্যে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর নিজস্ব টেকনিক অনেকটাই কাজে লেগেছে। তিনি নির্বাচনের ১৮ মাস আগে ভোটারদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য দু’বার কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ লংমার্চ করেছিলেন। কংগ্রেস এবং তার মিত্ররা বেকারত্ব, সবকিছুর ক্রমবর্ধমান দামকে সামনে এনে সরকারের ব্যর্থতাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি, সরকারকে বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের সাথে সুসম্পর্কের ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব হিসেবেও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খারগে ভোট গণনার শেষে বলেন, ” ভোট হলো ভারতের সংবিধানের প্রতিরক্ষা এবং মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পাশাপাশি গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য একটি ম জনগনের ম্যান্ডেট।”
এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানে দলীয় সমীকরণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে কি না, সেটাও বিজেপিকে খতিয়ে দেখতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তাছাড়া বিরোধীরা যখন প্রচার করছিল তৃতীয়বার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে নরেন্দ্র মোদি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে কোণঠাসা করে দেবেন, শীর্ষ নেতারা একবারও সেই প্রচার খণ্ডন করেননি। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ কিংবা জে পি নাড্ডা কেউই সেই ‘অপপ্রচারের’ বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
এবারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো মোদির প্রতিশ্রুত ‘সংস্কার এজেন্ডা’ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কারণ সবসময় তাকে মিত্রদের মন জয় করে চলতে হবে। মোদির প্রতিশ্রুতিকে জোটের সাবাই পছন্দ নাও করতে পারেন।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এশিয়ার সিনিয়র বিশ্লেষক সুমেধা দাশগুপ্ত বুধবার একটি নোটে লিখেছেন, “বিজেপির নিম্ন সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার সংস্কার করার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে।”
“এতে জমি অধিগ্রহণ সহজীকরণ, রাজ্য জুড়ে শ্রম আইনের অভিন্ন গ্রহণ, প্রযুক্তি বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বেসরকারীকরণ, নগদীকরণ ইত্যাদির মতো উদীয়মান ক্ষেত্রগুলির জন্য শাসন আইন গঠনের সাথে সম্পর্কিত ব্যবসা-ভিত্তিক সংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জড়িত থাকবে।”
দাশগুপ্ত আরো যোগ করেন যে এই ধরনের অনিশ্চয়তা “ভারতের শক্তিশালী বৃদ্ধি এবং বিশাল বাজার থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়িক আস্থার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।”
ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব কে শর্মা বলেন, “আরেকটি প্রশ্ন হল মোদি কীভাবে তাদের আনুগত্যের জন্য পরিচিত নয় এমন দুটি প্রধান মিত্রের সমর্থনের উপর নির্ভর করে জোট চালাবেন”।
তিনি আরো বলেন, “বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, জোটের দুই নেতা ও দলের কারও সাথে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব বজায় রাখার রেকর্ড নেই,” তাই বিজেপিকে “অনেক রাজনৈতিক সমঝোতা করে চলতে হবে, এবং একটি স্থিতিশীল, সংস্কারমুখী সরকার চালানোর জন্যে চ্যালেন্জের মুখোমুখি হতে হবে”।
Leave a Reply