শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৫১ অপরাহ্ন

‘যুদ্ধের বাঙ্কারে আমার প্রিয়তমকে বিয়ে করি, যার দুদিন পর সে মারা যায়’

  • Update Time : রবিবার, ৯ জুন, ২০২৪, ৩.৪১ পিএম
আন্দ্রি ও ভ্যালেরিয়ার একসাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন রাশিয়ান অভিযানে নি:শেষ হয়ে গিয়েছে

ডায়ানা কুরিস্কো ও সারাহ সেবায়ার

মারিউপোল তখন এক ধ্বংসস্তুপের নগরী। রাশিয়ার একটানা বোমাবর্ষণ এর রাস্তাঘাটকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে আর উঠানগুলো যেন কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু দক্ষিণ-পূর্বের এই ইউক্রেনিয়ান শহরের কয়েক মিটার মাটির নিচেই একটা রোমান্সের জন্ম নিচ্ছে তখন।

২০২২ সালের বসন্তে শহরটি যখন ঘিরে নেয় রাশিয়ান সেনারা, তখন থেকে এর একমাত্র শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ হিসেবে টিকে থাকা আজোভস্তাল স্টিলওয়ার্কে আশ্রয় নিয়ে আছেন ৩৩ বছর বয়সী ভ্যালোরিয়া সুবোতিনা।

এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লান্টের নিচে থাকা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য সোভিয়েত আমলের তৈরি অসংখ্য বোমা শেল্টারের একটিতে অবস্থান নেন তিনি।

“আপনি একটি প্রায় ধ্বংস হওয়া সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবেন, কয়েকটি টানেল ও অলিগলি ঘুরে আরও অনেক নিচে যেতে থাকবেন এবং অবশেষে আপনি একটা কংক্রিটের ঘরে পৌঁছাবেন,” বলছিলেন ভ্যালেরিয়া।

বাঙ্কারে বিভিন্ন সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের সাথে ভ্যালেরিয়া সেনাবাহিনীর আজভ ব্রিগেডের প্রেস অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন। রাশিয়ার দীর্ঘ দিন ধরে চলা অভিযানের ফলে যে ভয়াবহ দুর্ভোগ নেমে এসেছে সেটাই বিশ্ব গণমাধ্যমকে জানাচ্ছিলেন তিনি।

সেখানেই ছিল তার বাগদত্তা ৩৪ বছর বয়সী আন্দ্রি সুবোতিন। ইউক্রেনের এই সেনা অফিসার প্ল্যান্টটিকে রক্ষায় লড়ে যাচ্ছিলেন।

            (এরকম তিনশোটিরও বেশি সোভিয়েত আমলের বাঙ্কার আছে আজোভস্তাল প্ল্যান্টের নিচে)

তিন বছর আগে রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার আগেই এই জুটির দেখা হয় মারিউপোল বর্ডার গার্ড এজেন্সিতে কাজ করতে গিয়ে।

আন্দ্রি ভ্যালেরিয়াকে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যান।

“সে ছিল বিশেষ একজন মানুষ, তার পাশে থাকলেই এত শান্তি হতো,” ভ্যালেরিয়া বলেন, “সে ছিল খুবই পরোপকারী এবং কেউ সাহায্য চাইলে কখনোই না করতো না।”

তার ভাষায়, আন্দ্রি ছিলো আশাবাদী ধরনের মানুষ। সে জানতো কীভাবে সুখে থাকতে হয় এবং খুব সামান্য কিছুতেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়: যেমন রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গ, হাসি ঠাট্টা এসব।

“যখন আমি প্রথম তাকে দেখি, তখনই বুঝে যাই আন্দ্রি অন্যদের থেকে আলাদা।”

এর পরের তিন মাসের ভেতর তারা একসাথে থাকতে শুরু করেন। মারিউপোলে বাগানসহ একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি করেন এবং একসাথে জীবন শুরু করেন এই জুটি।

“আমরা একসাথে অনেক ঘুরতাম, পাহাড়ে, বন্ধুদের সাথে,” বলেন ভ্যালেরিয়া।

“আমরা একসাথে মাছ ধরেছি, বাইরে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমরা থিয়েটারে যেতাম, কনসার্টে, বিভিন্ন প্রদর্শনীতে, আমাদের জীবন ছিল ভরপুর।”

তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে একটি বড় গির্জায় গিয়ে বিয়ের স্বপ্ন দেখে তারা। এমনকি বিয়ের আংটিও চূড়ান্ত করে ফেলে তারা।

ভ্যালেরিয়া তার চাকরি ছেড়ে নিজের সৃষ্টিশীল কাজের দিকে মনোযোগ দেন। মারিউপোলে রাশিয়ার সাথে তীব্র যুদ্ধের শুরুর দিনগুলি সম্পর্কে কবিতা লিখে তা প্রকাশ করা শুরু করেন তিনি।

“রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর আগের কয়েক বছর ধরে, আমি সত্যিই সুখী ছিলাম,” তিনি স্মৃতিচারণ করেন।

কিন্তু সবকিছু বদলে যায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে।

               (ভ্যালেরিয়া সুবোতিনা বলেন তিনি এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে আন্দ্রির সাথে কথা বলেন।)

একসময় বসন্তের রোদ চলে আসে ভ্যালেরিয়া এবং আন্দ্রির বাগানেও এবং সেখানে প্রথম ফুল ফুটতে শুরু করে।

“আমি বসন্ত উপভোগ করতে শুরু করেছিলাম,” বলেন ভ্যালেরিয়া। “আমরা পুতিনের হুমকি সম্পর্কে জানতাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম যে যুদ্ধ হবে, কিন্তু আমি এটি নিয়ে ভাবতে চাইনি।”

২৪শে ফেব্রুয়ারি, পুরোমাত্রার সামরিক অভিযান শুরুও কয়েকদিন আগে, আন্দ্রি ভ্যালেরিয়াকে শহর ছাড়ার জন্য তাগিদ দেন। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হন না।

“আমি জানতাম যে যা-ই হোক না কেন, আমাকে মারিউপোলে থাকতে হবে, আমার শহর রক্ষা করতে হবে।”

কয়েক সপ্তাহ পর, তাদের দুজনেরই আশ্রয় নিতে হয় আজভস্টাল বাঙ্কারে।

এরপর তারা খুব কালেভদ্রে একে অপরকে দেখতে পেত, তবে যখন তারা দেখত তখন সেগুলি ছিল “খাঁটি আনন্দের” মুহূর্ত।

এক পর্যায়ে, মারিউপোল মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগুতে থাকে।

বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হওয়ার কারণে শহরের কিছু অংশে পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, খাবারের সংকটও দেখা দিতে থাকে। বেসামরিক বাড়িঘর এবং ভবনও ধ্বংস হয়ে যায়।

১৫ এপ্রিল, একটি বড় বোমা কারখানায় ফেলা হয়। ভ্যালেরিয়া অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

“আমাকে মৃতদেহগুলির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল, আমিই ছিলাম একমাত্র জীবিত। একদিকে, এটি একটি অলৌকিক ঘটনা ছিল, কিন্তু অন্যদিকে, এটি ছিল একটি ভয়ানক ট্র্যাজেডি।”

মাটির নিচে অবস্থিত একটি হাসপাতালের বাঙ্কারে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে তাকে প্রায় আট দিন কাটাতে হয়।

“সর্বত্র রক্ত এবং পচা গন্ধ ছিল,” তিনি বলেন।

“সেটা ছিল একটি ভয়ঙ্কর জায়গা, যেখানে আমাদের আহত সঙ্গীরা, কাটা হাত-পা নিয়ে শুয়ে ছিল। তারা যথাযথ চিকিৎসাও পাচ্ছিল না কারণ মেডিকেল সাপ্লাই খুবই কম ছিল।”

ভ্যালেরিয়ার আঘাতের পরে আন্দ্রি তার জন্য গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এবং ঠিক সেখানেই, বাঙ্কারে নিজেদের বিয়ের পরিকল্পনা শুরু করেন।

“এটি এমন ছিল যে সে যেন তাড়াহুড়ো করছে, যেন আমাদের হাতে আর সময় থাকবে না,” ভ্যালেরিয়া বলেন।

“সে নিজের হাতে টিন ফয়েল দিয়ে দুটি বিয়ের আংটি তৈরি করে এবং আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অবশ্যই, আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। সে ছিল আমার জীবনের ভালোবাসা। আর আমাদের টিন ফয়েল দিয়ে তৈরি আংটিগুলি – সেগুলি ছিল একেবারে নিখুঁত।”

                        (বাঙ্কারের ভেতরে টিনের ফয়েলের তৈরি আংটিতে বিয়ে হয় তাদের।)

৫ই মে, এই জুটির বিয়ে পড়ান প্ল্যান্টে দায়িত্বরত একজন কমান্ডার। তারা বাঙ্কারেই একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করেন এবং তাদের বিয়ের পোশাক ছিল তাদের ইউনিফর্ম।

আন্দ্রি তার স্ত্রীকে কথা দেন যে তারা বাড়িতে ফিরে একটি আয়োজন করে বিয়ে করবেন, যেখানে সত্যিকারের আংটি থাকবে এবং সে সাদা পোশাক পড়বে।

দুই দিন পরে, ৭ই মে, তিনি রাশিয়ান বোমার আঘাতে স্টিল প্ল্যান্টে নিহত হন।

ভ্যালেরিয়া তাৎক্ষণিকভাবে তা জানতে পারেননি।

“মানুষ প্রায়ই বলে যে প্রিয়জন মারা গেলে ভিতরে কিছু অনুভব হয়। কিন্তু আমি, বিপরীতে, ভালো মেজাজে ছিলাম। আমি বিবাহিত এবং প্রেমে ছিলাম।”

আজভস্তালে শহর প্রতিরক্ষার সময় সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল নিজের ভেতরে কোন কষ্ট ধরে রাখা, কারণ ভ্যালেরিয়াকে তখন সঙ্গী সহযোদ্ধাদের নিয়ে শহর রক্ষার কাজ করতে হচ্ছিল।

“আমি একজন নববধূ ছিলাম, একজন স্ত্রী, আর এখন আমি একজন বিধবা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শব্দ,” তিনি বলেন।

“আমি তখন যেভাবে চাইছিলাম সেভাবে নিজের প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করতে পারছিলাম না।”

“আমার সঙ্গীরা সবসময় আমার পাশে ছিল। তারা আমার সাথে বসতো, আমার পাশে ঘুমাতো, আমাকে খাবার এনে দিতো এবং আমাকে সবরকম সহায়তা করতো, আর তারা যখন থাকতো না তখনই আমি কেবল কাঁদতে পারতাম,” বলেন ভ্যালেরিয়া।

                                     (আন্দ্রি ও ভ্যালেরিয়ার বিবাহিত জীবন স্থায়ী হয় মাত্র দুদিন।)

এক পর্যায়ে মনে হতে হচ্ছিল, আমার যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার ভয় শোকের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

“আমি আর কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতাম না… যদি এরপর আরেকটা অন্য পৃথিবী থেকে থাকে, তাহলে সেখানে এখন আমার পাশে থাকা মানুষের চেয়ে আরও অনেক বেশি মানুষ অপেক্ষা করে আছে।”

আজভস্টালে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা অবশেষে ২০ মে আত্মসমর্পণ করে। ভ্যালেরিয়া মারিউপোল থেকে জোরপূর্বক রুশ সামরিক বাহিনীর নিয়ে যাওয়া ৯০০ যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ছিলেন।

“আমরা বাসের জানালা দিয়ে এই ভবন গুলোর দিকে থাকিয়ে ছিলাম যেগুলোকে আমরা ভালোবাসতাম, এসব রাস্তাগুলো দেখছিলাম যেগুলো ছিল আমাদের ভীষণ চেনা। আমরা যা যা ভালোবাসতাম – আমার শহর, আমার বন্ধু এবং আমার স্বামী, তারা সবকিছু ধ্বংস করেছে এবং সবাইকে হত্যা করেছে।”

ভ্যালেরিয়া ১১ মাসের রুশ বন্দিত্ব থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন। তিনি তার উপর হওয়া অত্যাচার এবং নির্যাতনের বর্ণনা দেন। এ সময় আন্দ্রি প্রায়ই তার স্বপ্নে আসতো।

গত বছরের এপ্রিলে, তিনি একটি বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে মুক্তি পান এবং এখন ইউক্রেনে ফিরে এসেছেন।

এটা এখনো বলা কঠিন যে মারিউপোলে রাশিয়ান বোমা বর্ষণের ফলে ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে সংখ্যাটা ২০ হাজারের বেশি হবে।

জাতিসংঘের হিসেবে, ৯০% আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে এবং ধ্বংসস্তূপে এখনও মৃতদেহ রয়েছে।

ভ্যালেরিয়ার জানা মতে, তার স্বামীর মৃতদেহ এখনো দখল হওয়া শহরের আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্টে রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, মাঝে মাঝে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলেন।

বিবিসি ইউক্রেন ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024