নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অধিকার রক্ষায় আইন সংশোধন, প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচীসমূহের সঠিক বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন বক্তারা।

বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রকল্পের আওতায় আটটি জেলায় চারটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী; দলিত, সমতল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, লিঙ্গ বৈচিত্রপূর্ণ (হিজরা এবং ট্রান্সজেন্ডার) জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে আয়োজিত পরামর্শ সভা হতে প্রাপ্ত প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের অবহিত করা লক্ষ্যে  গত (১২ জুন) ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক ইন এর অডিটোরিয়ামে “প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনগত ও সামাজিক সুরক্ষায় করণীয়” বিষয়ক মতবিনিময় সভা আয়োজিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ক্রিশ্চিয়ান এইড, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, নাগরিক উদ্যোগ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়য়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আ.ফ.ম রুহুল হক, এমপি তার বক্তব্যে বলেন, যাদের কথা বলতে আজ এখানে আসা তাদের সংগঠিত করতে পারা জরুরী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য যেসকল উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা অনন্য এবং বিরল। দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানোর জন্য যেখানে পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা দরকার সেখানে তা অবশ্যই করা হবে বলে তিনি জানান। শতভাগ জনগণকে শিক্ষিত করা সম্ভব হলে তারা নিজেরাই নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের সবাইকে সাধুবাদ জানান এবং অনুরোধ করেন তারা যেন এই ধরনের কাজ অব্যাহত রাখেন।

সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন সম্মানিত অতিথি হিসেবে তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের হাতে বিস্তৃত কর্মসূচী রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মসূচীগুলোকে সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে যে অধ্যায়টি আছে তা সরিয়ে দেয়া হলে এই জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতিকে অস্বীকার করা হবে, তাই আমি মনে করি উক্ত অধ্যায়টি অবশ্যই বাদ দেয়া সমীচীন হবে না বরং পরিমার্জন করা যেতে পারে। দলিত জনগোষ্টীর উচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি বলেন, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা কোনভাবেই উচিৎ নয়।

বিশেষ অতিথি হিসেবে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা তার বক্তব্যে বলেন, অশিক্ষা একটি মূল সমস্যা হিসেবে সবগুলো জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান। শিক্ষা দিয়ে যেকোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ পরিচালক এম রবিউল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় ক্ষমতায়ন হয়েছে এমন কাউকে বা সংগঠিত গ্রুপের কারও বক্তব্য শুনতে পেলে ভাল হত, তবে এই প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর প্রকল্পের অর্জনগুলো যাতে টেকসই হয় সেই বিষয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণের উদ্দেশ্যে সরকারের কার্যক্রম প্রসঙ্গে বক্তব্য প্রদান করেন সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক এম এম মাহমুদুল্লাহ। তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের মধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলোকপাত করেন। হিজড়া চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে ভাতা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন বর্তমানে হিজড়া ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের জন্য সরকারী বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা আছে। তিনি জানান, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার বৃদ্ধি করেছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সকল প্রতিবন্ধীই ভাতা কার্যক্রমের আওতায় আসবে।

প্রান্তিক ও দলিত সম্প্রদায়ের অধিকারসমূহ নিয়ে আলোচনায় নাগরিক উদ্যোগ এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের এই নীতিকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে কারা পিছিয়ে আছে তাদের প্রথমে সনাক্ত করা ও স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রয়োজন এবং সেইসাথে প্রস্তাবিত বৈষম্য বিলোপ আইন দ্রুত পাস করা প্রয়োজন এবং ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা দরকার।

সভায় আগত সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের প্রতিনিধি তৌফিকুল ইসলাম খান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের সাথে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে সামঞ্জস্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য স্থানীয় সরকারের সংযুক্ত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সকল পর্যায়ের সকল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান তিনি।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যমান বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা মূলক গবেষণা ও তৃণমূল পর্যায়ে আয়োজিত পরামর্শ সভা হতে প্রাপ্ত ফলাফল উপস্থাপন করেন আহমেদ ইব্রাহিম, উপদেষ্টা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তি, ব্লাস্ট।

হিজরা জনগোষ্ঠীর পরিচয় আইন বা নীতির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন বলে মত দেন ব্লাস্টের এসোসিয়েট আউটরিচ অফিসার শোভা সরকার। প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সভাপতি শিরিন আকতার বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির এই সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতার পরিমাণ খুবই নগণ্য যা পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

“প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনগত ও সামাজিক সুরক্ষায় করণীয়” বিষয়ক মতবিনিময় সভার সার্বিক পরিচালনা ও সঞ্চালনার ভূমিকায় উপস্থিত ছিলেন সাইমী ওয়াদুদ, প্রভাষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মতবিনিময় সভায় সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তাহমিনা রহমান।