শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫২ অপরাহ্ন

গুলবুলিস্তান (আরব্য উপন্যাসের উপসংহার)

  • Update Time : শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪, ৮.৫৪ পিএম

পরশুরাম 

সম্প্রতি আরবা উপন্যাসের একটি প্রাচীন পূথি উজবেকীস্তানে পাওয়া গেছে। তাতে যে আখ্যান আছে তা প্রচলিত গ্রন্থেরই অনুরূপ, কেবল শেষ অংশ একেবারে অন্যরকম। বিচক্ষণ পণ্ডিতরা বলেন, এই নবাবিষ্কৃত পুথির কাহিনীই অধিকতর প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য, নীতিসংগতও বটে। আপনাদের কৌতূহলনিবৃত্তির জন্যে সেই উজবেকী উপসংহার বিবৃত করছি। কিন্তু তা পড়বার আগে প্রচলিত আখ্যানের আরম্ভ আর শেষ অংশ জানা দরকার। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাই সংক্ষেপে মনে করিয়ে দিচ্ছি।

শাহরিয়ার ছিলেন পারস্য দেশের বাদশাহ, আর তাঁর ছোট ভাই শাহজমান তাতার দেশের শাহ। দৈবযোগে তাঁরা প্রায় একই সময়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁদের বেগমরা মায় সখী আর বাঁদীর দল সকলেই ভ্রষ্টা। তখন দুই ভাই নিজ নিজ অন্তঃপুরের সমস্ত রমণীর মুণ্ডচ্ছেদ করলেন এবং সংসারে বীতরাগ হয়ে একসঙ্গো পর্যটনে নির্গত হলেন।

প্লীচরিত্রের আর একটি নিদর্শন তাঁরা পথে যেতে যেতেই পেলেন। এক ভীষণ দৈত্য তার সুন্দরী প্রণয়িনীকে সিন্দুকে পুরে সাতটা তালা লাগিয়ে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে সে সুন্দরীকে হাওয়া খাওয়াবার জন্যে সিন্দুক থেকে বার করত এবং তার কোলে মাথা রেখে ঘুমুত। সেই অবসরে সুন্দরী নব নব প্রেমিক সংগ্রহ করত। দুই ভ্রাতাও তার প্রেম থেকে নিষ্কৃতি পান নি। শাহরিয়ার তাঁর কনিষ্ঠকে বললেন, ভাই, এই ভীষণ দৈত্য তার প্রণয়িনীকে

সিন্দুকে বন্ধ করে সাতটা তালা লাগিয়েও তাকে আটকাতে পারে নি, আমরা তো কোন ছার। বিবাগী দরবেশ হয়ে লাভ নেই, আমরা আবার বিবাহ করব। কিন্তু প্লীজাতিকে আর বিশ্বাস নেই. এক রাত্রি যাপনের পরেই পত্নীর মুণ্ডচ্ছেদ করে পরদিন আবার একটা বিবাহ করব, তা হলে অসতী-সংসর্গের ভয় থাকবে না। দুই ভ্রাতা একমত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং প্রাত্যহিক বিবাহ আর নিশান্তে মুন্ডচ্ছেদের ব্যবস্থা করে অনাবিল দাম্পত্য সুখ উপভোগ করতে লাগলেন।

শাহরিয়ারের উজিরের দুই কন্যা, শহরজাদী ও দিনারজাদী। শহরজাদীর সনির্বন্ধ অনুরোধে উজির তাঁকে বাদশাহের হচ্ছে সমর্পণ করলেন। রাত্রিকালে শহরজাদী স্বামীকে জানালেন, ভগিনীর জন্যে তাঁর মন কেমন করছে। দিনারজাদীকে তখনই রাজপ্রাসাদে আনা হল। শাহরিয়ার আর শহরজাদীর শয়নগৃহেই দিনারজাদী রাত্রিযাপন করলেন। শেষ রাত্রে তিনি বললেন, দিদি, আর তো দেখা হবে না, বাদশাহ যদি অনুমতি দেন তো একটা গল্প বল।

শাহরিয়ার বললেন, বেশ তো, সকাল না হওয়া পর্যন্ত গল্প বলতে পার। শহরজাদীর গল্প শুনে বাদশাহ মুগ্ধ হলেন, কিন্তু গল্প শেষ হল না। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা, কাল রাত্রিতে বাকীটা শুনব, একদিনের জন্য তোমার মুণ্ডচ্ছেদ মূলতুবী থাকুক। পরের রাত্রিতে শহরজাদী গল্প শেষ করলেন এবং আর একটি আরম্ভ করলেন। তারও শেষ অংশ শোনবার জন্যে বাদশাহের কৌতূহল হল, সুতরাং শহরজাদীর জীবনের মেয়াদ আর একদিন বেড়ে গেল। এইভাবে শহরজাদী এক হাজার একরাত্রি যাবং গল্প চালালেন এবং বে’চেও রইলেন। পরিশেষে শাহরিয়ার খুশী হয়ে বললেন, শহরজাদী, তোমাকে কতল করব না, তুমি আমার মহিষী হয়েই বে’চে থাক। তোমার ভগিনী দিনারজাদীর সঙ্গে আমার ভাই শাহজমানের বিবাহ দেব। অতঃপর শহরজাদীর সঙ্গে শাহরিয়ার এবং দিনারজাদীর সঙ্গে শাহজমান পরম সুখে নিজ নিজ রাজ্যে কালযাপন করতে লাগলেন।

এখন আরব্যরজনীর উজবেকী উপসংহার শুনুন।

হাজার-এক রাত্রি শেষ হলে শাহরিয়ার প্রসন্নমনে বললেন, শহরজাদী, তুমি যেসব অত্যাশ্চর্য গল্প বলেছ তা শুনে আমি অতিশয় তুষ্ট হয়েছি। তোমাকে মরতে হবে না।

শহরজাদী যথোচিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। দিনারজাদী বললেন, জাহাপনা, এতদিন আপনি শুধু দিদির গল্পই শুনলেন, পুরষ্কার স্বরূপ জীবনদানও করলেন। কিন্তু আমার কথা তো কিছুই শুনলেন না। শাহরিয়ার বললেন, তুমিও গল্প জান নাকি? বেশ, শোনাও তোমার গল্প। দিনারজাদী বললেন, আমি যা বলছি তা গল্প নয়, একেবারে খাঁটি সত্য। জাহাপনা, আপনি তো বিস্তর স্ত্রীর সংসর্গে এসেছেন, এমন কাকেও জানেন কি যার তুলনা জগতে নেই?

-কেন, তোমার এই দিদি আর তুমি।

-আমাদের চাইতে শতগুণ শ্রেষ্ঠ নারী আছে, তার বৃত্তান্ত আমার প্রিয়সখী গুলকদনের কাছে শুনেছি। তার দেশ বহু দূরে। ছ মাস আগে একদল হন দস্যু তাকে হরণ করে ইস্পাহানের হাটে নিয়ে এসেছিল, তখন আমার বাবা একশ দিনার দাম দিয়ে তাকে কেনেন। গুলবদনের সঙ্গে একটু, আলাপ করেই আমি বুঝলাম, সে সামান্য ক্রীতদাসী নয়, উচ্চ বংশের মেয়ে, গুলবুলিস্তানের শাহজাদীদের আত্মীয়া।

-গুলবুলিস্তান কোন মূলক? তার নাম তো শুনি নি।

-যে দেশে প্রচুর গোলাপ তার নাম গুলিস্তান। আর যে দেশে যত গোলাপ তত বুলবুল, তার নাম গুলবুলিস্তান। এই দেশ হচ্ছে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে বল্ল্থ উপত্যকায়। জানেন বোধ হয়, অনেক কাল আগে মহাবীর সেকেন্দর শাহ এই পারস্য সাম্রাজ্য আর পূর্বদিকের অনেক দেশ জয় করেছিলেন। দিনকতক তিনি সসৈন্যে গুলবুলিস্তানে বিশ্রাম করেছিলেন, সেই সময়ে তিনি নিজে আর তাঁর দশে সেনাপতি ওখানকার অনেক মেয়েকে বিবাহ করেন। বর্তমান গুলবুলিস্তানীরা তাঁদেরই বংশধর। ওদেশের পুরুষরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, আর মেয়েরা অত্যন্ত রূপবর্তী। তাদের গায়ের রঙ গোলাপী, গাল যেন পাকা আপেল, চোখের তারা নীল, চিবুকের গড়ন গ্রীক দেবীমূর্তির মতন সুগোল। স্বয়ং সেকেন্দর শাহ ওদেশের রাজার পূর্বপুরুষ। এখন রাজা জীবিত নেই, দুই শাহজাদী রাজ্য চালাচ্ছেন, উৎফুলুন্নেসা আর লুৎফুলুন্নেসা।

-ও আবার কিরকম নাম!

-আচ্ছে, গ্রীক ভাষার প্রভাবে অমন হয়েছে। নিকটেই হিন্দ, মূলেকে, তার জন্যেও কিছু, বিগড়েছে। মূলেব, লিস্তান অতি দুর্গম স্থান, অনেক পর্বত নদী মরুভূমি পার হয়ে যেতে হয়। পথে একটি গিরিসংকট আছে, বাব-এল-মৈমুন, অর্থাৎ বানর-তোরণ। দইে খাড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতি সরু পথ, এক লক্ষ সুশিক্ষিত বানর সেখানে পাহারা দেয়, কেউ এলে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলে। শোনা যায় বহুকাল আগে ওদেশের এক রাজা বংগাল মুলুক থেকে এই সব বানর আমদানি করেছিলেন। জাহাপনা, আমি বলি কি, আপনি আর আপনার ভাই শাহজমান সেই গলদুলিস্তান রাজো অভিযান করুন, শাহজাদী উৎফুল আর লুংফলকে বিবাহ করুন। আমার সখী গুলবদন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, আপনাদের সলো গেলে সেও নিরাপদে নিজের দেশে ফিরতে পারবে।

শাহরিয়ার বললেন, আমরা যাকে-তাকে বিবাহ করতে পারি না। সেই দুই শাহজাদী দেখতে কেমন? তাদের চরিত্র কেমন?

-জাহাঁপনা, তাঁদের মতন রূপবর্তী দুনিয়ায় নেই, তেমন ভীষণ সতীও পাবেন না। তাঁদের যেমন রূপ তেমনি ঐশ্বর্য’। আপনারা দুই ভাই যদি সেই দুই শাহ- জাদীকে বিবাহ করেন তবে স্বর্গের হরীর মতন স্ত্রীর সঙ্গে প্রচুর ধনরত্নও পাবেন। -তোমার দিদি কি বলেন?

শহরজাদী বললেন, জাহাপনা, আমার জন্যে ভাববেন না, আপনাকে সুখী কর- বার জন্যে আমি জীবন দিতে পারি।

একটু, চিন্তা করে শাহরিয়ার বললেন, বেশ আমি আর শাহজমান শীঘ্যই গুল- গুলিস্তান যাত্রা করব। সঙ্গে দশ হাজার তীরন্দাজ, দশ হাজার বর্শাধারী ঘোড়- সওয়ার আর ত্রিশ হাজার টাঙ্গিধারী পাইক সৈন্য নেব।

দিনারজাদী বললেন, অমন কাজ করবেন না জাহাপনা, তা হলে গলেবুলিস্তান পৌঁছবার আগেই সসৈন্যে মারা যাবেন। বাব-এল-মৈথুন গিরিসংকটে যে একলক্ষ বানর আছে তারা পাথর ছুড়ে সবাইকে সাবাড় করবে। তা ছাড়া শাহজাদীদের পাঁচ হাজার হাতি আছে, আপনার সৈন্যদের তারা ছত্রভঙ্গা করে দেবে। আমি যা বলি শুনুন। সঙ্গে শুধু পঞ্চাশজন দেহরক্ষী নেবেন, আপনার পচিশ আর ছোট জাহাপনার পচিশ। আপনার যে দুজন জোয়ান সেনাপতি আছেন, শমশের জা আর নওশের জংগ, তাদেরও নেবেন।

-কিন্তু সেই বাঁদরদের ঠেকাব কি করে?

-শুনুন। এখন রমজান চলছে, কিছুদিন পরেই ঈদ-অল-ফিতর। এই সময় দেশের আমির ফকির সকলেই জালা জালা শরবত খায়, তার জন্যে হিন্দুস্তান থেকে রাশি রাশি তখত-ই-খন্ডেসরি অর্থাৎ খাঁড় গুড়ের পাটালি বসরা বন্দরে আমদানি হয়। আপনি সেই পাটালি হাজার বস্তা বাজেয়াপ্ত করুন, সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ব্যব-এল-মৈমুনের কাছে এসে পথের দুই ধারে সেই পাটালি ছড়িয়ে দেবেন। বাঁদরের দল হামড়ি খেয়ে পড়বে আর কাড়াকাড়ি করবে, তখন আপনারা অনায়াসে পার হয়ে যাবেন।

শাহরিয়ার বললেন, বাঃ, তোমার খুব বৃদ্ধি, যদি পুরুষ হতে তো উজির করে দিতাম। যেমন বললে সেই রকমই ব্যবস্থা করব। শাহজমানের কাছে আজই দূত পাঠাচ্ছি। তোমরা, দুই বোন আর তোমাদের সখী গুলবদন যাবার জন্য তৈরী হও।

দিনারজাহীর পরামর্শ অনুসারে খাতার আয়োজন করা হল। কিয়িেদন পরে শাহরিয়ার পাইজভান শহরজাদী দিনারজাদী, দুইে সেনাপতি আর পঞ্চাশ জন অনতর গুলেংসদের প্রদর্শিত পথে নিরাপদে গলেবুলিস্তানে পৌঁছলেন।

চার জন রক্ষীর সলো গলেবদন এগিয়ে গিয়ে শাহরিয়ার ইত্যাদির আগমন, সংবাদ দুইে শাহজাদীকে জানালেন। তাঁরা মহা সমাদরে অতিথিদের সংবর্ধনা কর লেন। বিশ্রাম ও আহারাদির পর বড় শাহজাদী উৎফলে,গ্রোসা বললেন, মহামহিম পারস্যরাজ ও তাতাররাজ, কি উদ্দেশো আপনার এখানে এসেছেন তা প্রকাশ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।

অমাহরিয়ার উত্তর দিলেন, হে গলেকলিস্তানের শ্রেষ্ঠ গোলাপী লেবলে দুই শাহ জাদী, যা শুনেছিলাম তার চাইতে তোমরা ঢেনর বেশী সুন্দরী। আমরা একেবারে বিমোহিত হয়ে গেছি তোমরা দুই ভগিনী আমাদের দুজনের বেগম হও। শাহজাদী উৎফুল বললেন, তা বেশ তো, আমাদের আপত্তি নেই, বিবাহে আমরা সর্বদা প্রসতুত। আপনাদের দলে এই যে দুজন সুন্দরী দেখছি এরা কে?

শাহরিয়ার বললেন, ইনি হচ্ছেন আমার এখনকার বেগম শহরজাদী, আর উনি আমার শালী দিনারজাদী, আমার ভাইএর বাগদত্তা। সপত্নীর সলো থাকতে এ’দের কোনও আপত্তি নেই।

মাথা নেড়ে উৎফুল বললেন, তবে তো আমাদের সলো বিবাহ হতে পারে না। আমাদের নীতিশাস্ত্র কলীলা-ওঅ-দিমুনা অনুসারে পুরুষের এককালে একাধির শ্রী আর স্ত্রীর একাধিক স্বামী নিষিদ্ধ।

-তুমি যে ধর্মবিরুদ্ধ খ্রীস্টানী কথা বলছ শাহজাদী। শ্রীর পক্ষেই একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ, পুরুষের পক্ষে নয়।

-আপনাদের রীতি এখানে চলবে না। আমাদের শরিয়ত অন্য রকম, তা যদি না মানেন তবে আপনাদের সলো আমাদের বিবাহ হবে না।

শাহরিয়ার তাঁর ভাই শাহজমানের সলো তার পর বললেন, বেশ, তোমাদের রীতিই তালাক দিলাম, তুমি আর আমার বেগম নও। কিছুক্ষণ চুপি চুপি পরামর্শ করলেন। মেনে নিচ্ছি। শহরজাদী, তোমাকে তোমার জন্যে সত্যই আমি দুঃখিত। কি করা যায় বল, সবই আল্লার মাঁজ’। তোমার জন্যে আমি স্বামী যোগাড় করে দেব। অন্য একটি ভাল শাহজমান বললেন, দিনারজাদী, আমিও তোমাকে চাই না। বিবাহ ক’রো। তুমি অন্য কাকেও

অনন্তর সানাই ভেপু কাড়া-নাকাড়া আর দামামা বেজে উঠল, সখীর দল নাচতে লাগল, গুলবুলিস্তানের মোল্লার। শাহরিয়ারের সঙ্গে উৎফুলের আর শাহজমানের সলো লৎফুলের বিবাহ যথারীতি সম্পাদন করলেন।

বিকাল বেলা প্রাসাদ-সংলগ্ন মনোরম উদ্যানে ফোয়ারার কাছে বশে শাহরিয়ার বললেন, প্রেয়সী উৎফুল, তোমাদের সখীরা অতি খাসা, অনেকে তোমাদের দুই বোনের চাইতেও খুবসুরত। আমরা দুই ভাই ওদের ভাগাভাগি করে আমাদের হারেমে রাখব।

উৎফুল বললেন, খবরদার প্রাণনাথ, আমাদের সখী বাঁদী ঝাড়ুদারনী বা অন্য কোনও স্ত্রীলোকের দিকে যদি কুদৃষ্টি দাও তো তোমার গরদান যাবে।

অত্যন্ত রেগে গিয়ে শাহরিয়ার বললেন, ইনশাল্লাহ। প্রিয়ে, গরদান নেওয়া আমারও ভাল রকম অভ্যাস আছে। মুখ সামলে কথা বল উৎফুল বললেন, এস আমার সলো, বুঝিয়ে দিচ্ছি। জন মশালচী আর দশজন রক্ষীকে গরদানি মহলে যেতে বল। এই বাঁদী, এখনই চার- দুই শাহজাদী স্বামীদের নিয়ে সুবিশাল গরদানি মহলে প্রবেশ করলেন। মশালের আলোকে দুই ভ্রাতা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলেন, দেওয়ালের গায়ে বিস্তর গোঁজ পোঁতা আছে, তা থেকে সারি সারি নরমুণ্ড খুলেছে। তাদের দাড়ি হরেক রকম, কাঁচা, কাঁচা-পাকা, গালপাট্টা, ছাগল দাড়ি, লব্য দাড়ি, গোঁফহীন দাড়ি ইত্যাদি।

উৎফুলুন্নেসা বললেন, শোন বড় জাহাঁপনা আর ছোট জাহাপনা, এইসব মুণ্ড হচ্ছে আমাদের ভূতপূর্বে স্বামীদের। উত্তরদিকের দেওয়ালে আমার স্বামীদের, আর দক্ষিণের দেওয়ালে লুংফলের। বিবাহের পর এরা প্রত্যেকেই আমাদের সখীদের প্রতি লোলুপ নয়নে চেয়েছিল, সেজন্যে আমাদের নিয়ম অনুসারে এদের কতল করা হয়েছে। তোমরা যেমন কুলটা স্ত্রীকে দণ্ড দাও, আমরা তেমনি লম্পট স্বামীকে দিই। ওহে শাহরিয়ার আর শাহজমান, যদি হ’শিয়ার না হও তবে তোমাদেরও এই দশা হবে। খবরদার, তলোয়ারে হাত দিও না, তা হলে আমাদের এই রক্ষীরা এখনই তোমাদের গরদান নেবে।

শাহরিয়ার বললেন, পিশাচী রাক্ষসী খুলী ইবলিস-নন্দিনী, তোমাদের মনে কি দয়া মায়া নেই?

-তোমাদের চাইতে ঢের বেশী আছে। তোমরা প্রতিদিন নব নব বধূ ঘরে এনেছ, এক রাত্রির পরেই প্রত্যেককে হত্যা করেছ। তাদের চরিত্র ভাল কি মন্দ তা না জেনেই মেরে ফেলেছ। আমরা অত নির্দয় নই, বিনা দোষে পতিহত্যা করি না। যদি দেখি লোকটা অন্য নারীর ওপর নজর দিচ্ছে তবেই তার গরদান নিই।

শাহজমান চুপি চুপি বললেন, দাদা, মুণ্ডুগুলো মাটির কি প্লাস্টিকের তৈরী নয় তো?

শাহরিয়ার বললেন, না, তা হলে মাছি বসত না। অবশ্য একটু গুড় লাগালেও মাছি বসে। যাই হক, এই শয়তানীদের কবল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আমাদের সলো যদি প্রচুর সৈন্য থাকত তবে সখীর দল সমেত এদের গ্রেপতার করে নিয়ে যেতাম।

তার পর শাহরিয়ার গুর,গম্ভীর স্বরে বললেন, তালাক দিলাম, এখনই দেশে ফিরে যাব। শাহজাদী, তোমাদের আমরা উৎফুল বললেন, তোমাদের তালাক-বাক্য গ্রাহ্য নয়, এখানকার আইন আলাদা।

আমরা ছেড়ে না দিলে তোমাদের এখান থেকে মুক্তি নেই।

-তবে এই সখীদের সরিয়ে দাও, ওরা চোখের সামনে থাকলে আমাদের লোভ হবে।

-ওরা এখানেই থাকবে, নইলে তোমাদের চরিত্রের পরীক্ষা হবে কি করে। মাথা চাপড়ে শাহরিয়ার বললেন, হা, আমাদের পারস্য আর তাতার রাজ্যের কি হবে?

উৎফুল বললেন, তার জন্যে ভেবো না। তোমার সেনাপতি শমশের জঙ্গ শহর- জাদীকে বেগম করে পারস্যের সিংহাসনে বসবে আর নওশের জঙ্গ দিনারজাদীকে বেগম করে তাতার রাজ্যের মালিক হবে। তুমি আর শাহজমান এখনই ফরমান আর রাজীনামায় পাঞ্জার ছাপ লাগাও। দেরি ক’রো না, তা হলে বিপদে পড়বে।

নিরুপায় হয়ে শাহরিয়ার আর শাহজমান দলিলে পাঞ্জার ছাপ দিলেন। তার পর শাহরিয়ার করজোড়ে বললেন, শাহজাদী, দয়া কর। এখানে তোমাদের সখীদের দেখলে আমরা প্রলোভনে পড়ব, প্রাণ হারাব। আমাদের অন্য কোথাও থাকতে দাও।

-তা থাকতে পার। এই গুলবুলিস্তানের উত্তরে পাহাড়ের গায়ে অনেক গুহা আছে, সেখানে তোমরা সুখে থাকতে পারবে। সাত দিন অন্তর এখান থেকে রসদ পাবে। দুজন মোল্লাও মাঝে মাঝে গিয়ে ধর্মোপদেশ দেবেন। ওখানে তোমরা পাপ- মোচনের জন্যে নিরন্তর তসবি জপ করবে এবং হরদম আল্লার নাম নেবে।

পাঁচ বৎসর পরে মোল্লারা জানালেন যে আল্লার কৃপায় দুই ভ্রাতার চরিত্র কিঞ্চিত দুরস্ত হয়েছে। তখন দুই শাহজাদী নিজ নিজ স্বামীকে মুক্তি দিলেন, তালাকও দিলেন।

শাহরিয়ার ও শাহজমান দেশে ফিরে গিয়ে দেখলেন, প্রজা সৈন্য আর রাজ- কোষ সব বেহাত হয়ে গেছে, শমশের রাজ্য ফিরে পাবার কোনও আশা নেই। খানার জনতাকে আরব্য রজনীর বিচিত্র নির্বাহ করতে লাগলেন। আর নওশের সিংহাসনে জে’কে বসেছেন, অগত্যা তাঁরা বাগদাদে গেলেন এবং কাফি- কাহিনী শুনিয়ে কোনও রকমে জীবিকা।.১৮৮১ শক (১৯৫৯)।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024