শ্রী নিখিলনাথ রায়
প্রত্যেক হিন্দুর মনে এক অনির্বচনীয় মুর্শিদাবাদের অন্য কোন স্থানে এত বারাণসীতে উপস্থিত হইলে, যেমন শান্তভাবের উদয় হয়, মুর্শিদাবাদ- বাসী ও প্রবাসী হিন্দুদিগের মনে বড়নগরও সেইরূপ শান্তভাবের সঞ্চার করিয়া থাকে। বারাণসীর ন্যায় ইহারও পদপ্রান্ত দিয়া পুণ্যসলিলা ভাগী- রথী আপনার পবিত্র দেহে তরঙ্গ তুলিয়া প্রবাহিতা হইতেছেন; বারাণসীর ন্যায় বড়নগরের দেবমন্দিরসমূহের শঙ্খঘণ্টারোলে তাঁহার তরঙ্গলহরীও নৃত্য করিয়া উঠে। মহারাণী ভবানীর স্থাপিত ভবানীশ্বর শিব বিশ্বেশ্বর ও রাজরাজেশ্বরী দেবী অন্নপূর্ণারূপে বিরাজ করিতেছেন।
ভবানীর পুণ্যবতী কন্যা তারার স্থাপিত গোপালমূর্ত্তি বিন্দুমাধবের ও অষ্টভুজ গণেশ চুন্ডিরাঞ্জের স্থল অধিকার করিয়াছেন, এরূপ বলা যাইতে পারে। অন্নপূর্ণার ন্যায় রাজরাজেশ্বরীর ভবন হইতে কোন ক্ষুধার্তই প্রত্যাবৃত্ত হয় না। এই মুর্শিদাবাদ-কাশী শ্রীহীন ও অরণ্যসম হইলেও আজিও এমন এক পবিত্রতার ধারা টালিয়া দেয় যে, তাহাতে সমস্ত অন্তরাত্মা আপ্লুত হইয়া যায়। বৃহৎ বৃহৎ অশ্বথ বট প্রভৃতি বৃক্ষাদি দূরব্যাপী শাখাবিস্তার- পূর্ব্বক অর্থভাগীরথীকে ছায়াময়ী করিয়া, বড়নগরকে যেন তপোবনতুল্য করিয়া রাখিয়াছে।
যাঁহারা শান্তিপ্রয়াসী, তাঁহারা এই শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হইলে, আনায়াসেই মহাশাস্তি লাভ করিতে পারিবেন। বড়নগর ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে এবং বর্তমান আজিমগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশন হইতে প্রায় অর্দ্ধক্রোশ উত্তরে অবস্থিত। বড়নগর পূর্ব্বে সুবিস্তৃত রাজশাহী জমীদারীর রাজধানী ছিল। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দিন পর্যন্ত বড়নগর মুর্শিদাবাদের একটি প্রধান বাণিজ্য স্থান ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে যে সমস্ত প্রধান প্রধান আড়ঙ্গ ছিল, বড়- নগর তাহাদের মধ্যে অন্যতম। এই সমস্ত আড়ঙ্গে ইউরোপীয়গণের দালাল গোমস্তারা প্রতিনিয়তই গতায়াত করিত।
বড়নগরের পিত্তল, কাঁসার দ্রব্য অতীব উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। বড়নগরের ঘড়ার কথা বঙ্গবাসী মাত্রেই বিশেষ করিয়া জানিত। এখানে এত অধিক কাংস্য- বণিকের বাস ছিল যে, রজনীর শেষভাগে তাহাদিগের বাসননির্মাণের শব্দে সমস্ত গ্রামের লোকের নিদ্রাভঙ্গ হইত। এ জন্য রাজা বিশ্বনাথের মহিষী রাণী জয়মণি বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার আর নহবত রাখিবার প্রয়োজন হইবে না। মুর্শিদাবাদের খাগড়াপ্রভৃতি স্থানে অধিকাংশ কাংস্যৰণিকের বাসস্থান পূর্ব্বে বড়নগরেই ছিল।
Leave a Reply