শ্রী নিখিলনাথ রায়
বাণিজ্যস্থল বলিয়া কথিত, তত দিন হইতে নেমিনাথ-মন্দিরের প্রতিষ্ঠা। মন্দিরটি পশ্চিমমুখে অবস্থিত। প্রবেশদ্বার দিয়া একটি প্রাঙ্গণে উপ- স্থিত হইয়া দক্ষিণমুখে আর একটি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিতে হয়। সেই প্রাঙ্গণের পূর্ব্বদিকে মন্দির, মন্দিরের সম্মুখে একটি বারাণ্ডা এবং উত্তর, দক্ষিণ উভয় পার্শ্বে দুইটি দালান, পশ্চাতে একটি সঙ্কীর্ণ পথ আছে, সেই পথের মধ্যস্থলে মন্দিরের নিম্ন দিয়া প্রাঙ্গণ পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ গিয়াছে, সুরঙ্গের সোপানাবলী সুস্পষ্ট রূপেই দৃষ্ট হয়। মন্দিরমধ্যে নেমিনাথ, পার্শ্বনাথ প্রভৃতি শ্বেতাম্বর জৈন সম্প্রদায়ের চতুর্বিংশতি মহাপুরুষই অব- স্থিতি করিতেছেন। নেমিনাথের মন্দির, বলিয়া তিনি সর্ব্বোচ্চ আসনে অবস্থিত। নেমিনাথের মূর্ত্তি পাষাণময়ী এবং পার্শ্বনাথের মূর্ত্তি অষ্টধাতু– নিৰ্ম্মিত। দক্ষিণ দিকের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে দিগম্বর সম্প্রদায়ের কতি- পয় দেবমূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। উত্তর দিকের দালানের পর আর একটি প্রাঙ্গণ; তথায় একটি ক্ষুদ্র মন্দিরে জৈন যতিগণের চরণপদ্ম রহি- য়াছে। সেই প্রাঙ্গণের এক স্থলে জগৎশেঠদিগের বাসভবন মহিমাপুর হইতে নিত্যচন্দ্রজী নামক জনৈক যতির কষ্টিপাষাণে অঙ্কিত চরণপদ্ম আনিয়া রক্ষিত হইয়াছে। মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে অর্থাৎ পূর্ব্বদিকে একটি উদ্যান; উত্থানসংলগ্ন আর একটি ক্ষুদ্র মন্দিরে শান্তশূর, কুশল- গুরুপ্রভৃতি যতিগণের চরণপদ্ম অঙ্কিত আছে। উত্থানের পশ্চাতে একটি পুরাতন পুষ্করিণী, পুষ্করিণীর নাম মধুগড়ে; মধুগড়ে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। মধুগড়ের চতুঃপার্শ্বে জৈন মহাজনদিগের বাসভবন ছিল। চারিদিক্ সোপানাবলীর দ্বারা পরিশোভিত হইয়া মধুগড়ে সাধা- রণের আনন্দ বর্দ্ধন করিত। যৎকালে মহারাষ্ট্রীয়গণ সমস্ত। বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করিয়া মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত ধাবিত হয়, সেই সময়ে, মধুগড়ের চতুঃ- পার্শ্বের মহাজনেরা আপনাদিগের ধনসম্পত্তি চিহ্নিত করিয়া, তাহার গর্ভে নিহিত করিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেকে আপনাদিগের ধনসম্প- ত্তির উদ্ধার করিতে সক্ষম হন নাই। তদবধি এইরূপ প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, যক্ষদের তৎসমুদায় অধিকার করিয়া ইহার গর্ভে বাস করিতেছেন। কাশীমবাজারের ধ্বংসের সহিত মধুগড়ে পঙ্কপরিপূর্ণ হইয়া ক্রমে ক্রমে শৈবাল ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। সেই আচ্ছাদন এরূপ ঘনীভূত ও কঠিন হইয়াছিল যে, তাহার উপর অনেক বৃক্ষাদিও জন্মে। ইহার গভীরতা অত্যধিক ছিল। এক- সময়ে একটি হস্তী ইহার পঙ্কে নিমগ্ন হওয়ায়, অনেক কষ্টে তাহার উদ্ধার- সাধন হয়। মধুগড়ের চতুদ্দিক্ এক্ষণে জঙ্গলপরিপূর্ণ; বৃহৎ’ ও ক্ষুদ্রকার কুম্ভীরসকল ইহার গর্ভে বাস করিতেছে; তাহারা প্রায়ই তীরে উঠিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে রৌদ্র উপভোগ করিয়া থাকে।
নেমিনাথ মন্দির
নেমিনাথের মন্দির ব্যতীত কাশীমবাজার ব্যাসপুরে একটি সুন্দর শিবমন্দির আছে। এই মন্দির ব্যাসপুরের সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত কৃষ্ণনাথ ন্যায়পঞ্চাননের পিতা রামকেশব কর্তৃক ১৭৩৩ শাক বা ১৮১১ খৃঃ অব্দে নির্মিত হয়। মন্দিরমধ্যে এক প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গ অবস্থিত। মন্দিরটি নানাবিধ দেবদেবীর মূর্তিবিশিষ্ট ইষ্টকদ্বারা নির্মিত। বড়নগরস্থ রাণী ভবাণীর নির্মিত শিবমন্দিরের অনুকরণে ইহার নির্মাণ হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। মন্দিরটি অধিক পুরাতন নয় বলিয়া আজিও দেখিবার উপযোগী আছে। কাশীমবাজারের অর্দ্ধ ক্রোশ দক্ষিণে বিষ্ণুপুর-নামক স্থানে এক প্রসিদ্ধ কালীমন্দির বিদ্যমান আছে। এই মন্দিরে পূজোপলক্ষে মধ্যে মধ্যে অনেক লোকের সমাগম হইরা থাকে। বিষ্ণুপুরের কালী- মন্দির কৃষ্ণেন্দ্র হোতা নামক জনৈক ধৰ্ম্মপ্রাণ ব্রাহ্মণের নির্মিত বলিয়া কথিত ছিলেন। হোতার অনেক সংকীত্তি এতদঞ্চলে দৃষ্ট হয়; তন্মধ্যে সৈয়দা- বাদের দয়াময়ী ও জাহ্নবাতীরস্থ শিবমন্দিরই সর্ব্বপ্রধান। খাগড়া- সৈয়দাবাদ হইতে বিষ্ণুপুরে আসিতে হইলে, একটি বিল অতিক্রম করিতে হয় বলিয়া, হোতা তথায় একটি সেতু নির্মাণ করিয়া দেন। অদ্যাপি তাহা হোতার সাঁকো নামে প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণেন্দ্র হোতা পলাশীর যুদ্ধ, দেওয়ানী- গ্রহণ প্রভৃতি প্রধান প্রধান ঘটনার সমর বর্তমান ছিলেন। তাঁহার নিম্মিত :কোন কোন দেবমন্দিরের শিলালিপির সময় হইতে ঐরূপই অনুমান হয়। এইরূপ দুই একটি মন্দির ও সমাধিক্ষেত্র ব্যতীত কাশীমবাজারের পুরাতন চিহ্ন কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। সর্ব্বহারী কাল ইহার সমস্তই অপ- হরণ করিয়া কাশীমবাজারের পূর্ব্ব গৌরব কাহিনীতে পরিণত করিয়াছে।
Leave a Reply