প্রায় এক দশক আগে চিবকের স্কুল থেকে অপহৃত ২৭৬ জন মেয়ের মধ্যে সে ছিল একজন। বিশ্বজুড়ে আলোচিত সেই অপহরণ ঘটনা প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে জোরালো একটা প্রতিবাদ প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল । প্লাটফরমটির হ্যাশট্যাগ ছিল #BringBackOurGirls
লিসুর সাথে সাংবাদিকদের সাক্ষাতে নাইজেরিয়ান কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তার সাথে গোপনে দেখা করতে হয়।
লিসু সহ প্রায় ১৮০ জনের মতো মেয়ে হয় পালিয়েছিল নয়তো মুক্তি পেয়েছিল। বোকো হারামের সদস্যদের হাতে সিমবাসা বনের গোপন আস্তানায় জিম্মি থাকা অবস্থায় এদের কেউ কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। লিসু সেই অবস্থায় দুইটি সন্তানের জন্ম দেয়।
পালাবার পর লিসু(এটা তার আসল নাম নয়) সরাসরি সরকারের পূনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেয় যেখানে অন্য আরও বেশ কিছু পালিয়ে আসা মেয়ে ছিল।ইতোমধ্যে বোর্নো রাজ্য সরকার পূর্বের বন্দীদের বাক স্বাধীনতা সীমিত করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। লিসুর সাথে কথা বলে জানা গেল, ”সরকারী আবাসনে তার সাথে যেভাবে আচরণ করা হয়েছে তাতে সে “গভীরভাবে অসন্তুষ্ট ।”
সে মনে করে যে, তার সাথে এখন যেভাবে আচরণ করা হচ্ছে তা বন্দী জীবনযাপনের চেয়ে খারাপ।
“কখনও কখনও মনে পড়লে আমি কাঁদি। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি: ‘আমি কেন সাম্বিসা থেকে নাইজেরিয়ায় ফিরে এলাম, এসে এমন অপমানজনক আচরণের মুখোমুখি হতে হলো যে প্রায় প্রতিদিনই অপমানিত হতে হয় । বরং সাম্বিষায় থাকাকালীন আমি কখনোই এমন মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করিনি।”
অন্যদিকে নাইজেরিয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে তারা প্রাক্তন বন্দী এবং তাদের সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও পুষ্টি সরবরাহ করছে। আমিনা আলি, চিবক বন্দীদের মধ্যে প্রথম যে ২০১৬ সালে অপহরণের পরপরই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
সে তার চিকিৎসা নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল।সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ ই এপ্রিল সে তার স্কুলকে পুড়তে দেখেছে, সেটি এখন তার সামনে।
সাম্বিসায় জিম্মি হিসেবে দুই বছর কাটিয়েছেন আমিনা।
বন্দীদের অনেকের মতো, তাকেও একজন জঙ্গিকে “বিয়ে” করতে এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল।কিন্তু জঙ্গলে জীবনযাপনের একটা রুটিন ছিল; রান্না করা, পরিষ্কার করা, কুরআন শেখা, কিন্তু আমিনা কখনই আশা ছেড়ে দেয়নি যে সে একদিন পালিয়ে যাবে। তারপরও সে মুক্তির প্রহর গুনছিল ।
আমিনা ও হেলেন সহপাঠী ছিলেন। হেলেনের নেতৃত্বে গির্জার ব্যান্ডে তারা দুজনই গায়িকা ছিলেন। অপহরণের পর, দুজনে সাম্বিসা বনে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, যতটা সময় একসঙ্গে কাটাতে পারে। হেলেনের সাথে আমিনার শেষ কথোপকথনটি ছিল চিবোক সম্পর্কে এবং বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হবার।
এরপর সে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মাদু বুহারি সহ সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেছিলেন, যারা তাকে আশা দিয়েছিলেন যে তার জীবনের গতিপথ আরও ভালভাবে পরিবর্তিত হবে।
আমিনা জানান, প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, তিনি তাদের যত্ন নেবেন এবং তাদেরকে আবার স্কুলে পাঠাবেন এমনকি সাথে বাচ্চাদেরও। ২০১৬ সালে বোকো হারাম থেকে ফেরার পর আমিনা তার সন্তান সহ তখনকার প্রেসিডেন্ট মোহামম্দ বুহারীরর সাথে দেখা করেন।
আমিনা এখন চিবক থেকে সড়কপথে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দূরে ইয়োলায় তার মেয়ের সাথে একটি ছোট ঘরে বসবাস করে। প্রতিবেশীর সাথে ভাগাভাগি করে বাথরুম ব্যবহার করেন এবং বাইরে কাঠের জ্বালানীতে রান্নার কাজ সারেন। তিনি প্রতিদিনের খরচ মেটাতে মাসে ২০,০০০ নাইরা ($১৫; £১২) পান কিন্তু সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তার মেয়ের শিক্ষার জন্য এটুকু যথেষ্ঠ নয়।
তিনি কৃষিকাজ থেকে যে সামান্য অর্থ উপার্জন করেন তা দিয়েই সংসার চালান। তিনি বলেন, “আমার মেয়ের দেখাশোনা করা আমার পক্ষে কঠিন।” আমাকে পরিশ্রম করতেই হবে কারণ আমার কেউ নেই।” শেষ কথা হলো, বোকো হারাম শিবিরে জন্মগ্রহণকারী তার মেয়েকে লালন-পালন করার জন্য আমিনা আয়ের জন্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
তারপরও বর্তমানে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ নাইজেরিয়া (AUN), একটি বেসরকারি ও অভিজাত প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমিনা তার মেয়েকে লালন-পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমিনা ২০১৭ সাল থেকে AUN-এ যোগ দিয়েছেন, কিন্তু এখনো স্নাতক হননি। প্রাক্তন বন্দীদের মধ্যে মাত্র একজন স্নাতক হয়েছেন।নাইজেরিয়ার নারী বিষয়ক মন্ত্রী উজু কেনেডি-ও হানিয়ে বলেছেন যে সরকার গত ছয় বছরে চিবক মেয়েদের এবং তাদের শিক্ষার জন্য AUN-কে বছরে প্রায় $৩৫০,০০০ প্রদান করছে।
তিনি আরো বলেন,” এই মেয়েদেরই প্রথম এবং সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা উচিত। শিক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম এবং সর্বাগ্রে। আমাদের জানা উচিৎ যে কেউ খালি পেটে স্কুলে যেতে পারেনা।”রাকিয়া গালি হল আরেক চিবক মেয়ে – সে ২০১৭ সালে বোকো হারাম থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল। সে অল্প সময়ের জন্য AUN-এর ছাত্রী ছিল, কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে আর এগুতে পারেননি।
রাকিয়া বলেন, তিনি কোনো আর্থিক সহায়তা পান না এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আমিনার মতো কৃষিকাজ থেকে যে অর্থ উপার্জন করেন তা দিয়ে তার ছেলের শিক্ষার খরচ বহন করেন।”সরকার আমাদের প্রতি অবিচার করেছে,” তিনি আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন। “তারা জানত যে আমরা [সাম্বিসা বনে] গিয়েছিলাম এবং বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এসেছি। তারা যদি আমাদের সাহায্য করতে না পারে, তাহলে কে আমাদের সাহায্য করবে?”
মুহাম্মাদ আলি, একজন প্রাক্তন বোকো হারাম যোদ্ধা যিনি চিবক অপহরণের সাথে জড়িত ছিলেন, তিনি এখন তার আট সন্তান সহ মাইদুগুরিতে তার পরিবারের সাথে বসবাস করছেন।আলি ১৩ বছর ধরে জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সক্রিয় ছিলেন এবং কমান্ডার পদে উন্নীত হন, এমনকি চিবক মেয়েদের একজনকে জোর করে “বিয়েও” করেন।
অন্যান্য হাজার হাজার যোদ্ধার মতো, মুহাম্মদ আলিকে সাধারণ ক্ষমা দেওয়া হয়েছিল এবং রাজ্য সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচিতে জায়গা পেয়েছিল। এখন তার একটি খামার আছে, কিন্তু অপহৃত মেয়েদের উদ্ধারে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনীর সাথেও কাজ করে যাচ্ছে।
সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচি বিতর্কের উর্ধে্ব নয়, কেউ কেউ বলছেন যে, মোহাম্মদের মতো প্রাক্তন জঙ্গিদের জেল খাটতে হবে এবং তাদের অসংখ্য অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।বিদ্রোহ চলছে, এবং মুক্তিপণের জন্য অপহরণ নাইজেরিয়ায় আরও ব্যাপক হয়ে উঠেছে।
এই রিপোটিংয়ের সময় উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় তিনটি পৃথক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, এই আক্রমণগুলির মধ্যে একটি ছিল একটি স্কুলে এবং এটি ২০২১ সাল থেকে এটিই সবচেয়ে বড় অপহরনের ঘটনা।মোহাম্মদ আলি বলেছেন যে চিবোক অপহরণের “সফলতা” এই ধরনের আক্রমণকে আরো উৎসাহিত করেছে।
“আমরা বুঝতে পেরেছি যে ঘটনাটি সমগ্র জাতি এবং সমগ্র আফ্রিকাকে নাড়া দিয়েছে” , যোগ করেন আলি।নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা বিদ্রোহ মোকাবেলায় এর ক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়ে গেছে ।নাইজেরিয়ার প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল ক্রিস্টোফার গুয়াবিন মুসা, সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া “বিশাল” চ্যালেঞ্জগুলি স্বীকার করেছেন। তিনি দেশের বর্তমান নিরাপত্তাহীনতার অবস্থাকে ” অস্বাভাবিক ধাক্কা” বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন যে এ অবস্থার মোড় ঘুরবে।
জেনারেল মুসা জানান , বন্দী ৯১ জন চিবক মেয়েকে তাদের সামরিক বাহিনী দ্বারা উদ্ধারের আশা বাদ দেয়া যায়না।তার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমিনাও আশাবাদী।
Leave a Reply