সারাক্ষণ ডেস্ক
মিয়ানমারের জান্তা বিরোধী চলমান যুদ্ধে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল ও বাংলাদেশ সীমান্তে বর্ষা মৌসুমের সুবিধা নিয়ে জান্তাদের কোণঠাসা করে ফেলেছে।
আরাকান আর্মি জান্তার সাথে যুদ্ধে তাদের একের পর এক বিজয় ঘোষণা করছে , কারন ঘন বর্ষার কারনে জান্তা আর্মি তাদের পরিকল্পিত অপারেশনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এই মুহূর্তে বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আউটপোস্ট , বর্ডার ক্যাম্প ও শক্তিশালি ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে।
নাম ও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এ ব্যাপারে আরাকান আর্মির মিডিয়া টিম ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’ জানিয়েছে,“এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা সনাতনী যুদ্ধের সাথে বেশ কিছু বিশেষ বিদ্রোহী পদ্ধতি ব্যবহার করছি।”
আরাকান আর্মি
“আমরা শহরের কাছে শত্রু মিলিটারীর ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পূর্বে আশেপাশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখলে নেই এবং তারপরে আক্রমনে যাই।”
এই ধরনের কৌশলগুলো আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সফলতার প্রমাণ বহন করে। যেমন গত কয়েকমাস ধরে এই কৌশলে আমরা রাখাইনের একটি জনপ্রিয় সামুদ্রিক এলাকা নাগপালি দখল করতে সমর্থ হই । এই নাগপালি হলো আর্মি জেনারেল, ব্যবসায়ীদের আবাসিক এলাকা ও রিসোর্ট রয়েছে। মিয়ানমার মিডিয়া বলছে, আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের হেডকোয়াটার্স দখলে নিয়েছে।
আরাকান আর্মির মতে, “ঘন বর্ষা ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ রাখাইন রাজ্যকে দখলে নেয়া তাদের যুদ্ধ কৌশলকে আরো বেগবান করেছে। এখনকার এই বর্ষা যুদ্ধটা পূর্বের দুই সময়ের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
আরাকান আর্মির মিডিয়া উইং ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’ জানায়, “যুদ্ধে, এই বর্ষাকে কাজে লাগানোর জন্যে আমরা তৈরী হয়ে নিয়েছিলাম, কারন বর্ষায় আমরা আমাদের অবস্থান নেয়াতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি এবং শত্রুর অবস্থানে ড্রোন আক্রমনে আমরা সফল হয়েছি।”
মিয়ানমার বিষয়ক ঝানু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ডেভিড স্কট মেথিসন বলেন, এ বছরের বর্ষা মৌসুমে যুদ্ধ গত দুইটি বর্ষা যুদ্ধের চেয়ে ভিন্ন মাত্রায় দেখা গেছে যা জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরাকান আর্মির জয়কেই নিশ্চিৎ করতে যথেষ্ঠ সাহায্য করবে।”
ডেভিড স্কট মেথিসন
মেথিসন আরো বলেন, আরাকান আর্মি গঠিত হওয়ার পর থেকে এই মুহূর্তের যুদ্ধটা জান্তার টিকে থাকার জন্যে সবচেয়ে কঠিন সময় ।
আরাকান আর্মির মিডিয়া উইং এর দাবী “ আরাকান আর্মি ২০০৯ সালে গঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে তাদের ৪০ হাজার নিয়মিত নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও কয়েক হাজার সহযোগী সদস্য রয়েছে। তাদের মতে, জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে এই সদস্যরা আরাকান আর্মিকে একটি অস্থায়ী স্টেট আর্মড ফোর্সে পরিনত করেছে।”
এসময় দকিসণ এশিয়ার কতিপয় সামরিক গোয়েন্দা শাখা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে আরাকান আর্মির সদস্য সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারন এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির আক্রমণ মিয়ানমার জান্তার শাসনকে দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। কারন ইতোমধ্যে রাখাইনের বেশ কয়েকটি সামরিক অপারেশনের হাই কমান্ড তারা দখলে নিয়েছে।
ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান এর লোগো
আরাকান আর্মির মিডিয়া উইং ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’ আরো জানায়, “ আমাদের সৈনিকরা ইতোমধ্যে রাখাইনের ২ টি মিলিটারী অপারেশন কমান্ডকে দখলে নিয়েছে।” এছাড়াও আমরা বেশ কয়েক ডজন সামরিক ঘাঁটির হালকা ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের বেশ কিছু সৈনিকদের জিম্মি করতে পেরেছি।
মেথিসনের মতে, আরাকান আর্মি “ মিলিটারী অপারেশন কমান্ড লক্ষ্য করে অপারেশন চালানোতে খুবই ভাল অবস্থানে আছে, কারন তাদের রণ কৌশল সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। তাদের কৌশল রাখাইনের সব শহরকে দখলে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। ”
বেশ কিছু রিপোর্ট যারা মিয়ানমারের সামরিক শাসনের খবর দেয় তারা জানায়, আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে রাখাইনের অর্ধেক শহরাঞ্চলই দখলে নিয়েছে।
২০১৭ সালে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে জানা যায়, “রাখাইনের বর্তমান সংঘাত মিয়ানমারকে একটি নতুন অধ্যায় খুলে দিল যা একটি টেক্সটবুক উদাহরণ হয়ে থাকবে, কারন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে জাতিগতভাবে নির্মূল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
পশ্চিম রাখাইনে মিয়ানমার জান্তা আর আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলাকালীন এক নারী তার বাসস্থানের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। মে ২১, ২০২৪।
স্পেশাল এডভাইজরী কাউনিসল ফর মিয়ানমার, একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এক্সপার্ট গ্রুপ মে মাসের এক রিপোর্টে জানায়, মিয়ানমারের সামরিক শাসন তার দেশের ৮৬% শহরাঞ্চল এবং ৬৭% জনগনের উপরে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কাউন্সিল জানায়, ২০২২ সাল থেকে মিয়ানমারের এই সংঘাত সবচেয়ে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারানোর দিকে গেছে এবং ২০২৩ সাল থেকে সেটি আরো দ্রুত বেড়েছে।
কিন্তু গৃহযুদ্ধ এই শাসনকে সীমান্তে সংখ্যালঘুদের সাথে একটা চ্যালেঞ্জে আটকে দিয়েছে এবং নতুন এই সশস্ত্র সংগঠনটি ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট যেটি এন্টি রেজিম পলিটিকাল অপোজিশন নামে পরিচিত তার সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।মিয়ানমার হিম্যোন রাইটস গ্রুপ ‘এসিস্টেন্স এসোসিয়েশন অব পলিটিকাল প্রিজনারস’ এর মতে, ২০২১ সালে জান্তা ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে কমপক্ষে ৫,১৬১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সতর্ক বার্তা জানিয়ে বলেছে, সংঘাতে এ পর্যন্ত ৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মিলিটারী জেনারেলরা আরো নতুন সৈনিক নিয়োগ করে রাখাইনে যুদ্ধ পাঠাচ্ছে। কিন্তু তাতেও আরাকান আর্মির কোনো শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছেনা জান্তার নতুন এই অতিরিক্ত সৈনিকরা।
আরাকান আর্মির মিডিয়া উইং ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’ জানায়, “এটা সত্য যে, SAC সিটোয়ের সেনা ঘাঁটিতে এখন অতিরিক্ত সৈনিক আর মিলিটারী সরঞ্জাম দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করছে।” কিন্তু সংগঠনটি আরো জানায় যে, এদের অগ্রসরতা আমাদের সামরিক শক্তিকে মোটেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে যথেষ্ঠ নয়।
Leave a Reply