গণ্ডোর। কিয়েছে তো কি হইয়েছে? সভি তো ওহি কিয়েছে। লেকিন বানিয়ে দিয়েছে কোন? তদারক কোন কিয়েছে? ঠিকাদার কোন লাগিয়েছে? সব হামি। আশরফি হমার চাচেরা ভাই লাগে। হামি সলাহ দিয়েছি তব না রূপয়া খরচ কিয়েছে। অটল। মন্দ নয়, টাকা ঢাললে আশরাফ, পুণ্য হ’ল গন্ডেরির।
গন্ধেরি। কেনো হোবে না? দো দো লাখ রূপেয়া হর জগেমে খরচ দিয়া। জোড়িয়ে তো কেতনা হোয়। উস পর কমসে কম স’য়কড়া পাঁচ রূপয়া দস্তুরি তো হিসাব কিজিয়ে। হাম তো বিলকুল ছোড় দিয়া। আশরফিলালকা পুন যদি সোলহ লাখকা হোয়, মেরা ভি অসাসি হজার মোতাবেক হোনা চাহ্তা। অটল। চমৎকার ব্যবস্থা! পুণ্যেরও দেখছি দালালি পাওয়া যায়। আমাদের শ্যাম-দাগঞ্জেরি-দা যেন মানিকজোড়। গন্ধেরি। অটলবাবু, আপনি দো চার অংরেজী কিতাব পড়িয়ে হামাকে ধরম কি শিখলাবেন? বঙ্গালী ধরম জানে না। তিস রূপয়ার নোকরি করবে, পাঁচ পইসার হরিলুঠ দিবে। হামার জাত রূপয়া ভি কামায় হিসাবসে, পুন্ ভি করে হিসাবসে। আপনেদের ববীন্দরনাথ কি লিখছেন বৈরাগ সাধন মুক্তি সো হমার নহি।
হামি এখন চলছি, রেস খেলনে। কোন্ট্রি গেরিল ঘোড়ে পর্ আজ দো-চারশও লাগিয়ে দিব। অটল। আমিও উঠি শ্যাম-দা। আর্টিকেলের মুসাবিদা রেখে যাচ্ছি, দেখে রাখবেন। প্রসপেক্টস তো দিব্বি হয়েছে। একটু-আধটু, বদলে দেব এখন। পরশ, আবার দেখা হবে। নমস্কার।
বাগবাজারে গলির ভিতর রায়সাহেব তিনকড়িবাবুর বাড়ি। নীচের তলায় রাস্তার সম্মুখে নাতিবৃহৎ বৈঠকখানা-ঘরে গৃহকর্তা এবং নিমন্ত্রিতগণ গল্পে নিরত, অন্দর হইতে কখন ভোজনের ডাক আসিবে তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছেন। আজ রবিবার, তাড়া নাই, বেলা অনেক হইয়াছে।
তিনকড়িবাবুর বয়স ষাট বৎসর, ক্ষীণ দেহ, দাড়ি কামানো। শীর্ণ গোঁফে তামাকের ধোঁয়ায় পাকা খেজুরের রং ধরিয়াছে-কথা কহিবার সময় আরসোলার দাড়ার মত নড়ে। তিনি দৈব ব্যাপারে বড় একটা বিশ্বাস করেন না। প্রথম পরিচয়ে শ্যামবাবুকে বুজরুক সাবাস্ত করিয়াছিলেন, কেবল লাভের আশায় কম্পানিতে যোগ দিয়াছেন। কিন্তু আজ কালীঘাট হইতে প্রত্যাগত সদ্যঃস্নাত শ্যামবাবুর অভিনব মূর্তি দেখিয়া কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হইয়াছেন। শ্যামবাবুর পরিধানে লাল চেলী, গেরুয়া রঙের আলোয়ান, পায়ে বাঘের চামড়ার শিং-তোলা জুতা। দাড়ি এবং চুল সাজিমাটি দ্বারা যথাসম্ভব ফাঁপানো, এবং কপালে মস্ত একটি সিন্দুরের ফোঁটা।
তিনকড়িবাব, তামাক-টানার অন্তরালে বলিতেছিলেন-দেখুন স্বামীজী, হিসেবই হ’ল ব্যবসার সব। ডেবিট ক্রেডিট যদি ঠিক থাকে, আর ব্যালান্স যদি মেলে, তবে সে বিজনেসের কোনও ভয় নেই।’ নিশ্যামবাবু। আজ্ঞে, বড় যথার্থ’ কথা বলেছেন। সেইজন্যেই তো আমরা আপনাকে চাই।
আপনাকে আমরা মধ্যে মধ্যে এসে বিরক্ত করব, হিসেব সম্বন্ধে পরামর্শ নেবাপন “পতিনকড়ি। বিলক্ষণ, বিরক্ত হব কেন। আমি সমস্ত হিসেব ঠিক ক’রে দেব। মিটিংগুলো একট, ঘন ঘন করবেন বুঝি নায় ডিরেক্টরস, ফী বাবদ কিছু, বেশী খরচ হবেটিগেলো অডিটার-ফডিটার আমি বুঝি না। আরে বাপ, নিজের জমাখরচ যদি নিজে না বুঝলি তবে বাইরের একটা অর্বাচীন ছোকরা এসে তার কি বুঝবে? ভারী আজকাল সব বলি তবে শিখেছেন! সে কি জানেন-একটা গোলকধাঁধা, কেউ যাতে না বোঝে তারই কেজ কিপিং বুঝি-রোজ কত টাকা এল, কত খরচ হ’ল, আর আমার মজুদ রইল কত। আমি যখন আমড়াগাছি সবডিভিজনের ট্রেজারির চার্জে’, তখন এক নতুন কলেজ-পাস গোঁফকামানো ডেপুটি এলেন আমার কাছে কাজ শিখতে। সে ছোকরা কিছুই বোঝে না, অথচ অহংকারে ভরা। আমার কাজে গলদ ধরবার আস্পর্ধা। শেষে লিখলুম কোল্ডহাম সাহেবকে, যে হজের তোমরা রাজার জাত, দু-ঘা দাও তাও সহ্য হয়, কিন্তু দেশী ব্যাঙাচির লাথি বরদাস্ত করব না। তখন সাহেব নিজে এসে সমস্ত বুঝে নিয়ে আড়ালে ছোকরাকে ধমকালেন। আমাকে পিঠ চাপড়ে হেসে বললেন-ওয়েল তিনকড়িবাবু, তুমি হ’লে কতকালের সিনিয়র অফিসর, একজন ইয়ং চ্যাপ তোমার কদর কি বুঝবে? তার পর দিলেন আমাকে নওগাঁয়ে গাঁজা-গোলার চার্জে বদলি ক’রে। যাক সে কথা। দেখুন, আমি বড় কড়া লোক। জবরদস্ত হাকিম ব’লে আমার নাম ছিল। মন্দির টন্দির আমি বুঝি না, কিন্তু একটি আধলাও কেউ আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। রক্ত জল করা টাকা আপনার জিম্মায় দিচ্ছি, দেখবেন যেন-
শ্যাম। সে কি কথা! আপনার ঢাকা আপনারই থাকবে আর শতগুণ বাড়বে। এই দেখুন না-আমি আমার যথাসর্বস্ব পৈতৃক পঞ্চাশ হাজার টাকা এতে ফেলেছি। আমি না হয় সর্ব- ত্যাগী সন্ন্যাসী, অর্থে প্রয়োজন নেই, লাভ যা হবে মায়ের সেবাতেই ব্যয় করব। বিপিন আর এই অটল ভায়াও প্রত্যেকে পঞ্চাশ হাজার ফেলেছেন। গন্ডেরি এক লাখ টাকার শেয়ার
নিয়েছে। সে মহা হিসেবী লোক-লাভ নিশ্চিত না জানলে কি নিত? তিনকড়ি। বটে, বটে? শুনে আশ্বাস হচ্ছে। আচ্ছা, ‘একবার কোল্ডহাম সাহেবকে কনসল্ট করলে হয় না? অমন সাহেব আর হয় না।
ঠাঁই হয়েছে’-চাকর আসিয়া খবর দিল।
‘উঠতে আজ্ঞা হ’ক ব্রহ্মচারী মশায়, আসুন অটলবাবু, চল হে বিপিন।’ তিনকড়িবাবু, সকলকে অন্দরের বারান্দায় আনিলেন।
শ্যামবাবু, বলিলেন-‘করেছেন কি রায়সাহেব, এ যে রাজসূয় যজ্ঞ। কই আপনি বসলেন না!’
তিনকড়ি। বাতে ভুগছি, ভাত খাইনে দু-খানা সুজির রুটি বরাদ্দ।
শ্যাম। আমি একটি ফেৎকারিণী-তন্ত্রোক্ত কবচ পাঠিয়ে দেব, ধারণ ক’রে দেখবেন। শাক- ভাজা, কড়াইয়ের ডাল-এটা কি দিয়েছ ঠাকুর, এ’চোড়ের ঘণ্ট? বেশ, বেশ? শোধন করে নিতে হবে। সুপক কদলী আর গব্যঘৃত বাড়িতে হবে কি? আয়ুর্বেদে আছে-পনসে কদলং কদলে ঘতম্। কদলীভক্ষণে পনসের দোষ নষ্ট হয়, আবার ঘৃতের দ্বারা কদলীর শৈত্যগুণ দূর হয়। পুঁটিমাছ ভাজা-বাঃ। রোহিতাদপি রোচকাঃ পুণ্টিকাঃ সদ্যভর্জিতাঃ। ওটা কিসের অম্বল বললে-কামরাঙা? সর্বনাশ, তুলে নিয়ে যাও। গত বৎসর শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে ঐ ফলটি জগন্নাথ প্রভুকে দান করেছি। অম্বল জিনিসটা আমার সয়ও না-শ্লেষ্মার ধাত কি না। উত্প, উদ্প, উদ্প। প্রাণায় আপনায় সোপানায় স্বাহা। শয়নে পদ্মনাভণ্ড ভোজনে তু জনার্দনম্। আরম্ভ কর হে অটল।
অটল। (জনান্তিকে) আরম্ভের ব্যবস্থা যা দেখছি তাতে বাড়ি গিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হবে।
তিনকড়ি। আচ্ছা ঠাকুরমশায়, আপনাদের তন্ত্রশাস্ত্রে এমন কোন প্রক্রিয়া নেই যার দ্বারা লোকের-ইয়ে-মানমর্যাদা বৃদ্ধি পেতে পারে?
শ্যাম। অবশ্য আছে। যথা কুলাগবে-অমানিনা মানদেন। অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হ’লে অমানী ব্যক্তিকেও মান দেন। কেন বলুন তো?
তিনকড়ি। হাঃ হাঃ, সে একটা তুচ্ছ কথা। কি জানেন, কোল্ডহাম সাহেব বলেছিলেন, সুবিধা পেলেই লাট সাহেবকে ধ’রে আমায় বড় খেতাব দেওয়াবেন। বার বার তো রিমাইন্ড করা ভাল দেখায় না তাই ভাবছিলুম যদি তন্ত্রে-মন্ত্রে কিছু হয়। মানিনে যদিও, তবুও-শ্যাম। মানতেই হবে। শাস্ত্র মিথ্যা হতে পারে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এ বিষয়ে আমার সমস্ত সাধনা নিয়োজিত ক’রব। তবে সদ্গুরু প্রয়োজন, দীক্ষা ভিন্ন এসব কাজ হয় না। গুরুও আবার যে সে হ’লে চলবে না। খরচ-তা আমি যথা সম্ভব অল্পেই নির্বাহ করতে পারব।
তিনকড়ি। হং। দেখা যাবে এখন। আচ্ছা, আপনাদের আপিসে তো বিস্তর লোকজন দরকার হবে, তা-আমার একটি শালীপো আছে, তার একটা হিল্লে লাগিয়ে দিতে পারেন না? বেকার ব’সে ব’সে আমার অন্ন ধ্বংস করছে, লেখাপড়া শিখলে না, কুসঙ্গে মিশে বিগড়ে গেছে। একটা চাকরি জুটলে বড় ভাল হয়। ছোকরা বেশ চটপটে আর স্বভাব-চরিত্রও বড় ভাল।
শ্যাম। আপনার শালীপো? কিছু বলতে হবে না। আমি তাকে মন্দিরের হেড-পাণ্ডা ক’রে দেব। এখনি গোটা-পনর দরখাস্ত এসেছে-তার মধ্যে পাঁচজন গ্রাজুয়েট। তা আপনার আত্মীয়ের ক্রেম সবার ওপর।
তিনকড়ি। আর একটি অনুরোধ। আমার বাড়িতে একটি পুরনো কাঁসর আছে-একট, ফেটে গেছে, কিন্তু আদত খাঁটী কাঁসা। এ জিনিসটা মন্দিরের কাজে লাগানো যায় না?
সস্তায় দেব। শ্যাম। নিশ্চয়ই নেব। ওসব সেকেলে জিনিস কি এখন সহজে মেলে?
গন্ডেরির ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছে। বিজ্ঞাপনের জোরে এবং প্রতিষ্ঠাঙ্গণের চেষ্টায় সমস্ত শেয়ারই বিলি হইয়া গিয়াছে। লোকে শেয়ার লইবার জন্য অস্থির, বাজারে চড়া দামে বেচা-কেনা হইতেছে।
অটলবাবু বলিলেন-‘আর কেন শ্যাম-দা, এইবার নিজের শেয়ার সব ঝেড়ে দেওয়া যাক।
গন্ডেরি তো খুব একচোট মারলে। আজকে ডবল দর। দু-দিন পরে কেউ ছোঁবেও না।’ শ্যাম। বেচতে হয় বেচ, মোদ্দা কিছু তো হাতে রাখতেই হবে, নইলে ডিরেক্টর হবে কি ক’রে?
অটল। ডিরেক্টরি আপনি করুন গে। আমি আর হাঙ্গামায় থাকতে চাইনে। সিদ্ধেশ্বরীর কৃপায় আপনার তো কার্যসিদ্ধি হয়েছে।
শ্যাম। এই তো সবে আরম্ভ। মন্দির, ঘরদোর, হাট-বাজার সবই তো বাকি। তোমাকে কি এখন ছাড়া যায়?
মরসুমে চলল। আমাদের এইখানে শেষ। পিঠে সয়। এখন তো রাদার-ইন-ল কোম্পানির শ্যাম। আরে বাসত তার বেকন নিয়ে যাত্রায় কি পৃথক ফল হয়? সন্ধ্যেবেলা যাব এখন তোমাদের বাড়িতে, গন্ডেরিকেও যাব।
দেড় বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। ব্রহ্মচারী অ্যান্ড ব্রাদার-ইন-ল কোম্পানীর আপিসে ডিরেক্টরগণের সভা বসিয়াছে। সভাপতি তিনকড়িবাবু টেবিলে ঘুষি মারিয়া বলিতেছিলেন চরেই আ-আমি জানতে চাই, টাকা সব গেল কোথা। আমার তো বাড়িতেই টেকা ভাব- সবই এসে তাড়া দিচ্ছে। কয়লাওয়ালা বলে তার প’চিশ হাজার টাকা পাওনা, ইটখোলার ঠিকাদার বলে বারো হাজার, আদালতে ছাপাখানাওলা, শার্পার কোম্পানী, কুণ্ডু মুখুজো, আরও কত কে আছে। বলে আদালতে যাব। মন্দিরের কোথা কি তার ঠিক নেই-এর মধ্যে দু-লাখ টাকা ফ’কে গেল?
আ-আ-আমি জানতে চাই
সে ভন্ড জোচ্চোরটা গেল কোথা? শুনতে পাই ডাবে মেরে
আছে, আপিসে, বড় একটা আসে না।’
অটল। ব্রহ্মচারী বলেন, মা তাঁকে অন্য কাজে ডাকছেন-এদিকে আর তেমন মন নেই। আজ তো মিটিংএ আসবেন বলেছেন।
বিপিন বলিলেন-‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন সার, এই তো ফর্দ রয়েছে, দেখুন না জমি- এক কেনা, শেয়ারের দালালি, preliminary expense, ইট-তৈরী, establishment, বিজ্ঞাপন, আপিস-খরচ-তিনকড়ি। চোপ রও ছোকরা। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা।
এমন সময় শ্যামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন-‘ব্যাপার কি?’ তিনকড়ি। ব্যাপার আমার মাথা। আমি হিসেব চাই।
শ্যাম। বেশ তো, দেখুন না হিসেব। বরঞ্চ একদিন গোবিন্দপুরে নিজে গিয়ে কাজকম তদারক ক’রে আসুন।
তিনকড়ি। হ্যাঁ, আমি এই বাতের শরীর নিয়ে তোমার ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে মরি আর কি। সে হবে না-আমার টাকা ফেরত দাও। কোম্পানি তো যেতে বসেছে। শেয়ার- হোল্ডাররা মার-মার কাট-কাট করছে।
শ্যামবাবু কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া বলিলেন-‘সকলই জগন্মাতার ইচ্ছা। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। এতদিন তো মন্দির শেষ হওয়ারই কথা। কতকগুলো অজ্ঞাতপূর্ব কারণে খরচ বেশী হয়ে গিয়ে টাকার অনটন হয়ে পড়ল, তাতে আমাদের আর অপরাধ কি? কিন্তু চিন্তার কোনও কারণ নেই, ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা call-এর টাকা তুললেই সমস্ত দেনা শোধ হয়ে যাবে, কাজও এগোবে।’
গণ্ডোর বলিলেন-‘আউর টাকা কোই দিবে না, আপকো ঘোড়াই বিশোআস করবে।’ শ্যাম। বিশ্বাস না করে, নাচার। আমি দায়মুক্ত, মা যেমন ক’রে পারেন নিজের কাজ চালিয়ে নিন। আমাকে বাবা বিশ্বনাথ কাশীতে টানছেন, সেখানেই আশ্রয় নেব।
তিনকড়ি। তবে বলতে চাও, কোম্পানি ডুবল?
গণ্ডেরি। বিশ হাঁথ পানি।
শ্যাম। আচ্ছা তিনকড়িবাবু, আমাদের ওপর যখন লোকের এতই আবিশ্বাস, বেশ তো, আমরা না হয় ম্যানেজিং এজেন্সি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার নাম আছে, সভ্রম আছে, লোকেও শ্রদ্ধা করে, আপনিই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে কোম্পানি চালান না?
অটল। এইবার পাকা কথা বলেছেন।
তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, আমি বদনামের বোঝা ঘাড়ে নিই, আর ঘরের খেয়ে বুনো মোষ তাড়াই। শ্যাম। বেগার খাটবেন কেন? আমিই এই মিটিংএ প্রস্তাব করছি যে রায়সাহেব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি ব্যানার্জি’ মহাশয়কে মাসিক ১০০০ টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে কোম্পানি চালাবার ভার অর্পণ করা হোক। এমন উপযুক্ত কর্মদক্ষ লোক আর কোথা? আর, আমরা যদি ভুল- চুক করেই থাকি, তার দায়ী তো আর আপনি হবেন না।
তিনকড়ি। তা-তা-আমি চট্ট ক’রে কথা দিতে পারিনে। ভেবে-চিন্তে দেব।
অটল। আর দ্বিধা করবেন না রায়সাহেব। আপনিই এখন ভরসা।
শ্যাম। যদি অভয় দেন তো আর একটি নিবেদন করি। আমি বেশ বুঝেছি, অর্থ হচ্ছে সাধনের অন্তরায়। আমার সমস্ত সম্পত্তিই বিলিয়ে দিয়েছি, কেবল এই কোম্পানির ষোল শ খানেক শেয়ার আমার হাতে আছে। তাও সৎপাত্রে অর্পণ করতে চাই। আপনিই সেটা নিয়ে নিন। প্রিমিয়ম চাই না-আপনি কেনা-দাম ৩২০০, ঢাকা মাত্র দিন।
তিনকড়ি। হ্যাঁ, ভাল ক’রে আমার ঘাড় ভাঙবার মতলব।
শ্যাম। ছি ছি। আপনার ভালই হবে। না হয় কিছু কম দিন, চব্বিশ শ-দ-হাজার-
হাজার-তিনকড়ি। এক কড়াও নয়।
শ্যাম। দেখুন, ব্রাহ্মণ হ’তে ব্রাহ্মণের দান-প্রতিগ্রহ নিষেধ, নইলে আপনার মত লোককে আমার অমনিই দেবার কথা। আপনি যৎকিঞ্চিৎ মূল্য ধ’রে দিন! ট্রান্সফার ফর্ম আমার প্রস্তুতই আছে-নিয়ে এস তো বিপিন। ধরুন-পাঁচ শ টাকা।
তিনকড়ি। আমি এ-এ-আশি টাকা দিতে পারি। শ্যাম। তথাস্তু। বড়ই লোকসান হ’ল, কিন্তু সকলই মায়ের ইচ্ছা। গন্ডেরি। বাহনা তিনকৌড়িবাবু, বহুত কিফায়ত হয়া!
কুছভি নহি
তিনকড়িবাবু পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া সদাঃপ্রাপ্ত পেনশনের টাকা হইতে আটখানা আনকোরা দশ টাকার নোট সন্তর্পণে গনিয়া দিলেন। শ্যামবাবু পকেটস্থ করিয়া বলিলেন-‘তবে এখন আমি আসি। বাড়িতে সত্যনারায়ণের পূজা আছে। আপনিই কোম্পানির ভার নিলেন এই কথা স্থির। শুভমতু-মা-দশভুজা আপনার মঙ্গল করুন।’
শ্যামবাবু প্রস্থান করিলে তিনকড়িবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন-‘লোকটা দোষে গুণে মানুষ। এদিকে যদিও হাম্বগ, কিন্তু মেজাজটা দিলদরিয়া। কোম্পানির ঝক্কিটা তো এখন আমার ঘাড়ে পড়ল। ক-মাস বাতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলুম, কিছুই দেখতে পারি নি, নইলে কি কোম্পানির অবস্থা এমন হয়? যা হোক উঠে-প’ড়ে লাগতে হ’ল-আমি লেফাফা-দূরস্ত কাজ চাই, আমার কাছে কারও চালাকি চলবে না।’
গণ্ডোর। অপনের কুছ, তকলিফ করতে হোবে না। কোম্পানি তো ডুব গিয়া।
অকোভি ছুট্টি।
তিনকড়ি। তা হ’লে কি বলতে চাও আমার মাসহারাটা-গণ্ডোর। হাঃ, হাঃ, তুমুভি রূপয়া লেওগে? কাঁহাসে মিলবে বাতলাও। তিনকৌড়ি- যাবু, শ্যামবাবুকা কারবারই নহি সমঝা? নব্বে হজার রূপয়া কম্পানিকা দেনা। দো রোজ বাদ লিকুইডেশন। লিকুইডেন্টর সিঙ্কিন্ড কল আদায় করবে, তবু দেনা শুষবে।
তিনকড়ি। অ্যাঁ, বল কি? আমি আর এক পয়সাও দিচ্ছি না। গঞ্জেরি। আলবত দিবেন। গবরমিন্ট কান পকড়কে আদায় করবে। আইন এইসি
হ্যায়। তিনকড়ি। আরও টাকা যাবে। সে কত?
অটল। আপনার একলার নয়। প্রত্যেক অংশীদারকেই শেয়ার পিছ ফের দু-টাকা দিতে হবে। আপনার পূর্বের ২০০ শেয়ার ছিল, আর শ্যামদার ১৬০০ আজ নিয়েছেন। এই ১৮০০ শেয়ারের ওপর আপনাকে ছত্রিশশ টাকা দিতে হবে। দেনা শোধ, লিকুইডেশনের খরচা-সমস্ত ঢুকে গেলে শেষে সামান্য কিছু ফেরত পেতে পারেন।
তিনকড়ি। তোমাদের কত গেল? গণ্ডোর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ সঞ্চালন করিয়া বলিলেন-‘কুছভি নহি, কুছভি নহি। আরে হামাদের ঝড়তি-পড়তি শেয়ার তো সব শ্যামবাবু, লিয়েছিল-আজ আপনেকে বিকিরি কিয়েছে।’
তিনকড়ি। চোর-চোর-চোর! আমি এখনি বিলেতে কোল্ডহাম সাহেবকে চিঠি লিখছি-অটল। তবে আমরা এখন উঠি। আমাদের তো আর শেয়ার নেই, কাজেই আমরা এখন ডিরেক্টর নই। আপনি কাজ করুন। চল গণ্ডোর। তিনকড়ি। অ্যাঁ-গণ্ডেরি। রাম রাম!
ভারতবর্ষ, মাঘ ১৩২৯ (১৯২২)
Leave a Reply