সুলতানা রাজিয়া ও ফয়সাল আহমেদ
প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হলে এবং আগামি সপ্তাহ খানেক সময় ধরে চলমান তাপদহ ও প্রচন্ড গরম অব্যাহত থাকলে ঈশ্বরদীতে ১০ হাজার ১’শ ২৫ হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এবার ঈশ্বরদীর সাত ইউনিয়নসহ পৌর এলাকায় ১৭’শ হেক্টর জমিতে ধান,৮ হাজার হেক্টর জমিতে ভিন্ন প্রকার শাক সবজি,৩’শ ৫০ হেক্টর জমিতে পাট ও পদ্মার চরাঞ্চলের ৭৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা বাদাম আবাদ করা হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়া এবং প্রায় ১৩ দিন আগ থেকে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রচন্ড দাপদহ,গরম বাতাস ও খড়ার শুরু হওয়ায় কৃষকদের কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়তে থাকে। এই বিপর্যয় থেকে কৃষক ও ফসলকে রক্ষায় বিকেল থেকে সারারাত ধরে প্রতিটি ফসলের ক্ষেতে পানির স্প্রেসহ প্রয়োজনীয় সেচ ব্যবস্থা চালু রাখলে ফসলের ক্ষতি হবেনা। ঈশ্বরদী কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকারের দেওয়া তথ্যসুত্রে এসব জানাগেছে।
সুত্রমতে,প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধরন দেখে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং কৃষকদেরকে ফসলের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য নানাভাবে কাজ শুরু করেন। কর্মকর্তারা পাড়া- মহল্লায় ও গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উঠোন বৈঠক ও পরমর্শসভা শুরু করেন। এ বছর ঈশ্বরদীর সাতটি ইউনিয়নে ১১০০৫ জন কৃষক, ৩১”শ হেক্টর জমির ১১০০৫ টি বাগানে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ২৪৩ টি লিচু গাছে ১৫ লাখ মে:টন লিচু আবাদের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছেন। লিচুর সম্ভাব্য বিক্রি মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৫”শ কোটি টাকা। কিন্তু এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার লিচু চাষীরাও। তারাও অন্যান্য ফসল আবাদি কৃষকদের মতই সম্ভাব্য ক্ষতির একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন। মাত্র সাত সময়ের মধ্যে রহমতের বৃষ্টির অপেক্ষা শুরু হয়েছে। কৃষকদের বুকভরা আশা ছিল এবার লিচুর রাজধানী ঈশ্বরদী এলাকায় লিচুর বাম্পার ফলন হবে। কিন্তু না সে আশা পুরনের বিষয়টি এখন সম্পুর্ণ নির্ভর করছে রহমতের বৃষ্টি হওয়া না হওয়ার উপর । বৃষ্টি না লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষতির সম্মুখিন হবে লিচু চাষিরাও। তাপদহের আক্রমন থেকে লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনাকে রক্ষায় কৃষি অফিসের দায়িত্বশীলরা অন্যান্য ফসলের ন্যায় নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন কৃষকদের নিয়ে। কৃষি কর্মকর্তারা প্রতিদিন মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়ে উঠোন বৈঠক,পরামর্শ সভা ও অব্যাহত রেখেছেন। ঈশ্বরদী কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার ও অন্যান্য কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মতে কৃষকরা সাত দিন সঠিকভাবে রাতে রাতে গাছের গোড়ায় পানি,ছত্রাকনাশক স্প্রে ও গাছের পাতা স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে পারলে লিচুর বাম্পার ফলনের ক্ষতি হবেনা।
রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পকে ঘিরে ঈশ্বরদীতে অবস্থান করা রাশিয়ানদের মধ্যেও লিচুর কারণে ঈশ্বরদীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে লিচুর রাজধানী খ্যাত ঈশ্বরদী এলাকাকে একটুকরো রাশিয়া বলা হলেও লিচুর আবাদ এখানে কমেনি। বরং লিচুর আবাদ বেড়েই চলেছে। এবার লিচুর বাম্পার ফলনের হাতছানি দিয়েছে এবং গাছে গাছে লিচুর মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণে ম ম করছে। মিষ্টি গন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠছে লিচু বাগান এলাকা ও প্রকৃতি। এঅবস্থায় বিগত সপ্তাহখানেক ধরে ঈশ^রদীতে প্রচন্ড তাপদহ ও গরম বাতাসে লিচুর মুকুল ও গাছের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এঅবস্থায় কৃষি অফিসের পরামর্শে কৃষকদের বিরামহীন চেষ্টা চলছে বাম্পার ফলন ঠিক রাখার। তারা নিয়মিত রাতভর গাছে গাছে পানির ও ছত্রাক নাশক স্প্রে এবং গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছে । তবে আগামি সাতদিনের বেশী সময় ধরে এই চলমান প্রকৃতিক বিপর্যয় তীব্র তাপদহ,গরমবাতাস অব্যাহত থাকলে ও বৃষ্টি না হলে বাম্পার ফলনে মারাতœক বিপর্যয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব আশংকার কারণে মধু চাষিরা মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ততায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে। নানা কৌশলে লিচুর মুকুলের যত্ননেওয়ার কাজ চলছে ভালো ফলন ঠিক রাখার জন্য। মাঠ পর্যায়ের বাগান গুলিতে কৃষকদের কাজের ধরন দেখলে মনে হচ্ছে বিষয়টি যেন কৃষক ও কৃষি বিভাগের চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। তাই এখন লিচু বাগানগুলোর পরিষ্কার ও মুকুল ঝরা রোধে কীটনাশক স্প্রেসহ নানাভাবে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। ঈশ্বরদীর পাড়ায় পাড়ায় বাগানগুলোর প্রতিটি গাছে মুকুল আসায় লিচু চাষিদের মাঝেও কদিন আগে ভিন্ন আমেজ লক্ষ্য করা গেলেও সে আমেজে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
গত বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ফলনের অপেক্ষায় থাকা ঈশ^রদীর লিচু চাষিরা সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন ফলন ঠিক রাখতেচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় আখসহ নানা প্রকার সবজি চাষই ছিল ঈশ্বরদীর কৃষককুলে মানুষের জীবিকার একমাত্র প্রধান উৎস। কিন্তু এখন লিচুচাষের পাশাপাশি অনেকে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন ফলদ বাগান। এর মধ্যে অন্যতম আম বাগান,কুল,গাজর কপি,পেয়ারা। এখানে বিভিন্ন ফলদ বাগান গড়ে তুলতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও কাজ করছে। চাষিদের দেওয়া হচ্ছে সার, বীজ, চারা বিতরণের পাশাপাশি বাগান পরিচর্যায় বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ। ফলে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ফলদ বাগান করছেন পাশাপাশি অনেক বাগান চাষিও হয়েছেন স্বাবলম্বী। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার সলিমপুর,সাহাপুর,দাশুড়িয়া,মুলাডুলি,পাকশী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা এলাকার বাগানগুলোতে শোভা পাচ্ছে লিচুর মুকুল। কোনো কোনো গাছে ধরেছে গুটিগুটি লিচু। লিচুর মুকুল ও গুটি ঝরা রোধে এখন সবাই কীটনাশক স্প্রে ও পানির চাহিদা পুরণ করছেন। এক সপ্তাহ পর আবহাওয়া অনুকূলে আসলে ভাল ফলনের মাধ্যমে দাম ভালো পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছেন লিচু চাষিরা। ঈশ্বরদীর লিচু চাষিরা বলেন, লিচুর মুকুল আসার পর থেকেই গাছের প্রাথমিক পরিচর্যা শুরু করলেও তারা মুকুল রোগ বালাই ও তাপদহের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্প্রে ও পানির ব্যস্থা করছেন বলে জানান তারা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় পদক প্রাপ্ত চাষি আব্দুল বারীসহ বিভিন্ন চাষিরা জানান, তারা প্রতি বছরের ন্যায় এবারও লিচু চাষিরা মাসের শেষে মুকুল আসায় খুব খুশি হলেও তাপদহের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন।
ঈশ্বরদী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মিতা সরকারের দেওয়া তথ্য সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদীতে উৎপাদিত লিচু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এমনিকি ঈশ্বরদীর লিচুর সুনাম বিশে^র বিভিন্ন দেশেও রয়েছে। এ বছর ঈশ্বরদীর সাতটি উপজেলায় ৩১০০ হেক্টর জমির ১১০০৫ টি বাগানে ১১০০৫ জন কৃষক ৩ লাখ ৩৫ হাজার ২৪৩ টি লিচু গাছ আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫লাখ মে:টন। বিক্রি মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৫”শ কোটি টাকা। তিনি আশা পোষন করে বলেন,আমাদের দে;ওয়া পরামর্শ মতে কৃষকরা গাছের যতœ অব্যাহত রেখেছেন। এভাবে এক সপ্তাহ যতœ নিলে এবং সপ্তাহের মধ্যে তাপদহ কমলে কৃষকদের সাফল্য নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
ঈশ্বরদী-২৫.০৪.২০২৪
Leave a Reply