স্বদেশ রায়
মিয়ানমারের ভবিষ্যত যে ভিন্ন দিকে যাচ্ছে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভক্ত মিয়ানমার হতে সময় নিলেও মিয়ানমারের কেন্দ্রিয় সরকার যে খুব দ্রুত আরো দুর্বল হয়ে যাবে তার অনেকগুলো বিষয় পরিস্কার হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমারের এই পরিবর্তন নিয়ে যে বাংলাদেশ ভাববে না তা নয়, তবে বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বাংলাদেশ থেকে যে কোন ভাবেই হোক কিছুটা নিরাপত্তার সঙ্গে আরকানের ভূখন্ডে পাঠানো।
এ মহূর্তে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আরকান আর্মি প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে জিতছে। আরকানের অধিকাংশ ভূখন্ড এখন আরকান আর্মির দখলে। আরকান আর্মি এই যে যুদ্ধে একের পর এক জয়লাভ করছে, তারা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে সমানতালে যুদ্ধ করছে- এর পেছনে নিশ্চয়ই এক বা একাধিক শক্তি আছে। কারণ, তাদের অস্ত্র, ট্রেনিং, অর্থ ইত্যাদির সাপোর্ট ছাড়াতো আর এত বড় যুদ্ধ করা আরাকান আর্মির পক্ষে সম্ভব নয়।
আর এই সাপোর্ট নিশ্চয়ই কোন বেআইনি গোষ্টি বা সন্ত্রাসী গোষ্টি দিচ্ছে না। কারণ, আরকান আর্মি কোন সন্ত্রাসী গোষ্টি নয়। তারা একটি বিশেষ নৃগোষ্টি’র অধিকারের জন্যে লড়ছে।
অবশ্য একে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলা যেতে পারে। কারণ, একটি দেশে হাজার হাজার নৃগোষ্টির মানুষ, নানান ধর্মের মানুষ বাস করবে এটাই স্বাভাবিক। যখন কোন দেশ কোন বিশেষ নৃগোষ্টির মানুষ বা কোন বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য শতভাগ বাসোপযোগী থাকে না, তখন ওই রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে সফল রাষ্ট্র নয়। কিছুটা হলেও ব্যর্থ রাষ্ট্র। অবশ্য এ আলোচনা এ লেখায় নয়। কারণ, এ হিসেবে দেখতে গেলে পৃথিবীর অনেক সংখ্যক রাষ্ট্রই কিছুটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। তাছাড়া মিয়ানমারের এই নৃগোষ্টির সমস্যা দীর্ঘ সমস্যা। সে ইতিহাসও টানতে গেলে লেখার মোড় ভিন্ন দিকে চলে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো আরকানের যে আরকান আর্মি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে ওই আর্মির বিষয় ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ফেরত পাঠানো।
আরাকান আর্মিকে কেউ না কেউ সাহায্য করছে। সাহায্য ছাড়া এত বড় যুদ্ধ তারা এতদিন ধরে চালাতে পারতো না। আর এ সাহায্য যে কোন কোন দেশ বা যে দেশগুলো কোন বিশেষ ফর্মে করছে তা সকলেই বুঝতে পারছে। সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো প্রকৃত ইনফরমেশান নেই যে কোন কোন দেশ কীভাবে সাহায্য করছে। তবে সরকারের কাছে এই ইনফরমেশান নেই এটা হতে পারে না। এবং এই ইনফরমেশান থাকা সরকারের কাজের মধ্যে পড়ে।
সরকার হয়তো তার নীতিতে অবশ্যই সে সব শক্তির সঙ্গে, মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে, সর্বোপরি আরকান আর্মি’র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এবং তাদের পরবর্তী কাজ নির্ধারণ করছে। সরকারের হয়তো প্লান- এ, প্লান- বি, প্লান- সি এমনি নানান পরিকল্পনা রয়েছে। হয়তো এখানে যে চিন্তাটি উপাস্থাপন করতে যাচ্ছি সেটা প্লান- ডি বা তারও পেছনে যেতে পারে তারপরেও বিষয়টিকে চিন্তায় রাখা দরকার।
কারণ, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার দুবর্ল হয়ে পড়লে আরকান, আর্মি, কারেন আর্মি, শান আর্মি এমনি বিভিন্ন এথনিক গ্রুপগুলো বিভিন্ন এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে তখন যে কোন ফর্মেই হোক মিয়ানমারকে নিয়ে পৃথিবীর বড় শক্তিগুলো ও এশিয়ার বড় শক্তিগুলোকে ভাবতে হবে। তখন নতুন কোন না কোন ফরম্যাট সামনে আসবে। আর বাংলাদেশ সরকারের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- ওই ফরম্যাটের মধ্যে যে কোনভাবেই হোক রোহিঙ্গাদের জন্যে কিছুটা নিরাপদ একটা আবাসস্থল যাতে থাকে সে জন্যে কূটনীতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া।
আর এর একটা ফরম্যাট ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্য একটি যুদ্ধকে ঘিরে দেখা যাচ্ছে। এবং এটা অনেকটা পরিকল্পিতই মনে হচ্ছে। কারণ, সাধারণত ইসরাইলের পক্ষ থেকেই ফিলিস্তিনের ওপর আক্রমন এ যাবত বেশি ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু এবার ফিলিস্তিনের হামাস সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে ইসরাইলকে আক্রমন করে। ফিলিস্তিনের নেতা, পৃথিবীর অন্যতম বড় নেতা ইয়াসির আরাফাতের বিপরীতে কারা হামাস তৈরি করেছিলো, কী জন্যে করেছিলো সে আলোচনায় এখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যাহোক, যদিও এ মুহূর্তে ইরানও ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।
তারপরেও পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে এগুচ্ছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যের সহ অনেক দেশের সমর্থন নিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো বা সমাধানের সময় গাজা এলাকার ভাগ্য ভিন্ন হতে পারে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইল থেকে আলাদা করে গাজা জাতিসংঘ হোক বা অন্য কোনভাবে হোক, ওই এলাকার মানুষের জন্যে বিশেষ করে ওই এলাকার ফিলিস্তিনিদের জন্যে একটা নিরাপদ স্থানের দিকে হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব এবার এগুবে।
ভবিষ্যতের গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্যে যে নিরাপদ গাজা এলাকা পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের চিন্তায় এসেছে এমনই একটা চিন্তা এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ করতে পারে।
ইসরাইল ও ফিলিস্তিন যে যুদ্ধ করুক না কেন, তাদের যেমন পেছনে কিছু শক্তি আছে, তেমনি মিয়ানমারের আরকান আর্মি শুধু নয়, ভবিষ্যত মিয়ানমার নির্মানের পেছনেও বেশি কিছু শক্তি কাজ করছে। তাদেরকে এখন বোঝানোর দরকার, ভবিষ্যতের নিরাপদ গাজার মতো, আরকানেও রোহিঙ্গাদের একটি নিরাপদ স্থান যেন ভবিষ্যত মিয়ানমার গঠনের পরিকল্পনায় স্থান পায়। এ মুহূর্তে আরকান আর্মি তাদের সামরিক সরকারের সঙ্গে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে কিছু রোহিঙ্গা মুসলিমকে সঙ্গে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু এটা সত্য যে দিন শেষে আরকান আর্মির বুদ্ধিস্ট সংখ্যাগরিষ্ট অংশ রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের সঙ্গে নেবে না। বাস্তবে রোহিঙ্গারা যতটা না নির্যাতিত হয়েছে সামরিক বাহিনী দ্বারা প্রায় সম-পরিমানই আরকান বুদ্ধিস্টদের দ্বারা। আর ধর্মীয় এই পার্থক্য ঘোচানো বর্তমানের পৃথিবীতে খুবই দুসাধ্য একটা বিষয়।
তাই সব থেকে ভালো পথ রোহিঙ্গাদের জন্যে আরাকানে নিরাপদ একটা স্থান। তা এই মিয়ানমার গেইমের বড় প্লেয়ারদেরকেও যেমন মানতে হবে, তেমনি জাতিসংঘকেও মানতে হবে। এবং উভয়েই মিলে এর নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দায়টি যেহেতু বাংলাদেশের, তাই এখানে বাংলাদেশকে অনেক বেশি প্রচেষ্টা নিতে হবে। বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, পশ্চিমারা বা মিয়ানমার গেইমের এশিয়ানরা কেউই খুব সহজে এটা চাইবে না। তারা যদি সহজে এটা চাইতো তাহলে রোহিঙ্গাদের প্রথম থেকে তারা মিয়ানমারের শরনার্থী হিসেবে চিহ্নিত করতো। ধর্মীয়ভাবে করতো না। ১৯৭১ সালেও ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে এক কোটি শরণার্থী গিয়েছিলো তার নব্বই ভাগের বেশি ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু সেদিন ভারত কোন মতেই তাদেরকে হিন্দু শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেনি। পাকিস্তানি শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। এমন কি ডিপি ধার, পি এন হাসকার প্রমুখ বিভিন্ন সাক্ষাতকারে অনেকটা অসত্য বলেছিলেন। তারা শরনার্থীদের ধর্মে হিন্দু মুসলিম সমান সমান বলেই চিহ্নিত করেছিলেন।
রোহিঙ্গাদের ধর্মীয়ভাবে চিহ্নিত করার পেছনের একটা বড় কারণ কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। আর রোহিঙ্গারা মুসলিম। তাই তারা এখানেই থাকুক এমন একটি খেলা- ভবিষ্যত এ্ই মিয়ানমারকে নিয়ে যে গেইম বহু আগে থেকে শুরু হয়েছে সেখানেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন অন্তত দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে এ বাধা কাটাতে হবে। যাতে মিয়ানমার গেইমে আগামী দিনে যাতে রোহিঙ্গাদের আরাকানে একটা নিরাপদ স্থান হয়।আর সেটা নিশ্চিত করতে পারলে তা দেশের জন্য যেমন সাফল্য তেমিন দশ লাখেরও বেশি লোক শতভাগ ফিরে না পেলেও অন্তত ৮০ ভাগ তো নিজের দেশ ফিরে পাবে।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply