রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০১:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

কাতারের  আমীরের বাংলাদেশ সফর: আগামীর বাংলাদেশের বর্নিল সম্ভাবনা

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ৭.৫৭ পিএম

মো. আব্দুল হান্নান 

গত ২২-২৩ এপ্রিল ২০২৪, শীর্ষ-পর্যায়ে কাতারের  মহামান্য আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ‘র  বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর, বাংলাদেশ-কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক অনন্য মাত্রায় উন্নীত করেছে । জানুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশের  সাধারণ নির্বাচনের পর,  এটাই শীর্ষ-পর্যায়ের প্রথম সফর, যা  সরকার এবং দেশের জন্য অত্যন্ত  আনন্দ  ও ইতিবাচক ভাবমূর্তির বার্তা বয়ে এনেছে। কেননা,  এ সফর অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমপর্কের দিগন্তকে অধিকতর গভীর ও বিস্তৃত মাত্রায় প্রসারনে অমিত সম্ভাবনার  দ্বার উন্মোচন করেছে। বিশেষকরে, গত  একদশকের অধিককালে,  বাংলাদেশের  প্রধান মন্ত্রীর সফল  নেতৃত্বে,  বাংলাদেশের যে  অভাবনীয় রূপান্তরমূলক  উন্নয়ন ঘটেছে, এ  সফরের মাধ্যমে,  কাতারের মহামান্য আমীরের ইতিবাচক মূল্যায়ন, এবং আগামীর উন্নত বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব তৈরীর নিমিত্তে ব্যক্তিগত সদিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

 

কাতার  বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধুপ্রতিম দেশ। কাতার, বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য অংশীদার। সেখানে, বাংলাদেশের প্রায় ৪ লক্ষ  শ্রম ও পেশাজীবী, কাতারের অবকাঠামো নির্মান এবং উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।  সেখান থেকে বাংলাদেশে  রেমিটেনস  আসে  প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেশাজীবী সেখানকার স্বনামধন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, উচ্চতর পেশা ও ব্যবসায় নিয়োজিত আছে। বিশেষকরে, গত ফুটবল বিশ্বকাপের (২০২২) অনুষ্ঠানকল্পে  সার্বিক অবকাঠামো বিনির্মাণে বাংলাদেশী শ্রমজীবীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। কাতার সরকার ও জনগণ তাদের  ভূমিকার  ভূয়সী প্রশংসা করেছে এবং কাতারে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ-কাতারের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নত এবং বিস্তৃত করতে, এ  সফরে যে ৫ টি এগ্রিমেন্ট সই হয়,  তা’হল পারস্পরিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও  সুরক্ষা ; দ্বৈত-কর পরিহার ; আয়করের আওতায় রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ ; সামুদ্রপথ ও বন্দরের সংযোগ ; এবং দুদেশের শীর্ষ সংগঠন – ফেডারেশন অব চেম্বের অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর মধ্যে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল গঠন  সংক্রান্ত। এছাড়াও ৫টি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে যুব ও ক্রীড়া; জনশক্তির কর্মসংস্থান; কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ; শিক্ষা ; এবং কাতারের  বন্দর “মাওয়ানি কাতার” এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যকার সহযোগিতা সংক্রান্ত।

এ সফরের  সফলতাকে রাজনৈতিক  ও কূটনৈতিক মাপকাঠিতে  বিচার করলে, অত্যন্ত সফল বলতে হবে।  কেননা, কাতারের মহামান্য আমীর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উল্লম্ফন এবং  মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফল নেতৃত্বের রুপান্তরকারী  অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে নিশ্চয়ই  আগাম অবহিত ছিলেন বাংলাদেশের অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নয়নের চলমান “ ফ্লাগ-শিপ ” কর্মসূচী, যেমন ঃ পদ্মা-সেতু, বিমান-বন্দর, মেট্রো-রেল, বিদ্যুৎ-খাত, নদীর তলদেশে টানেল, টেলি–স্যটেলাইট, গভীর সমুদ্রবন্দর, পারমানবিক শক্তিকেন্দ্র,টেলি-যোগাযোগ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদির কথা । সফরে এসে, মহামান্য আমীর নিজেই প্রত্যক্ষ করছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকল্পের সাথে সফল অবকাঠামো বিনির্মানের  কর্মযজ্ঞ। এবং, অপ্রতিরুদ্ধ  অগ্রগতির ধারা ।

কাতার ও বাংলাদেশ দু’দেশই ভারসাম্যপুর্ন, ইতিবাচক এবং ফরওয়ার্ড লুকিং পররাষ্ট্রনীতির  জন্য  বহিঃবিশ্বে সমাদৃত। আফগানিস্তান ও প্যালেস্টাইনে হামাস ইস্যুসমূহ, বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে নিরাপত্তা বিশ্বয়ে ইতিবাচক ভূমিকা,  আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা কল্পে উদ্যোগ, এবং দেশের সার্বিক দর্শনীয় উন্নয়ন সাম্প্রতিক বছরসমূহে কাতারের প্রতি  প্রশংসনীয়  আন্তর্জাতিক অভিকর্ষ তৈরী করেছে। গত ১৫ বছরে মধ্যে,  বাংলাদেশের সরকার প্রধানও তাঁর সফল-নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির  রূপান্তরিত উন্নয়ন এবং স্বল্পোন্নত  দেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরনের মাধ্যমে  বহির্বিশ্বে “অভিকর্ষ”  সৃষ্টি করেছে। গ্লোবাল সাউথের এই দুই উদীয়মান দেশের নেতৃত্বের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শান্তি (প্যালেস্টাইনসহ) প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে অবস্থান অভিন্ন। অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই, এ শীর্ষ-সফর, দুদেশের সম্পর্ককে  অধিকতর  সমৃদ্ধ এবং উন্নত করার রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে আরও জোরালো করেছে।

অর্থনৈতিক সফলতার বিষয়টি, মহামান্য আমীরের নিজের মূল্যায়নেই প্রতিভাত। তিনি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বলেছেন,  বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের উদীয়মান গন্তব্য’, যা বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিকে অধিকতর উচ্চ-মাত্রায় উন্নীত করেছে। বিশেষ করে,বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগের  আগ্রহই  প্রতিফলিত হয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে, বৈদেশিক বিনিয়োগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা অনেক  বড়  ভূমিকা রাখে। দেখা যায়, এসফরে মহামান্য আমীরের অনেক গুরুত্তপুর্ন  সফর-সঙ্গীদের  মধ্যে ছিলেন কাতারের  বৈদেশিক বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের  মন্ত্রী এবং বাণিজ্য মন্ত্রী ।

সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে সকল ক্ষেত্রসমূহ অধিকতর গুরুত্ব পায় তা’হলঃ পেট্রো কেমিকেল ; ইলেক্ট্রনিক্স, আইটি, জ্বালানি, ফুড-প্রসেসিং, কৃষি ;বন্দর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা; এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন; কক্সবাজার কেন্দ্রিক উন্নয়ন; শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ; দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি। চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতা বাস্তবায়ন এবং  দুদেশের মধ্যে উন্নয়ন অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে যে প্রক্রিয়া (আইনি কাঠামো,  কানেটিভিটি অবকাঠামো, বিনিয়োগের  সুরক্ষা এবং স্বচ্ছ রাজস্ব ব্যবস্থা, ব্যক্তিখাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি) দরকার তা হচ্ছে এগ্রিমেন্ট ও সমঝোতা সনদের মাধ্যমে। তা যথাযথভাবেই হয়েছে । এমনকি,  এসবের প্রায়োগিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে সরকারি পর্যায়ের বাইরে দুদেশের ব্যক্তি খাতের মধ্যে এগ্রিমেন্ট হয়েছে “ জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল ” গঠনের।

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত  দেশে উন্নীত হওয়ার চ্যালেঞ্জিং  অভিযাত্রায়  সবচেয়ে বেশি দরকার সার্বিক উন্নয়নের ধারা বেগবান  করতে  বিনিয়োগের নিশ্চয়তা ;  জ্বালানির নিশ্চয়তা ;  গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান এবং স্মার্ট ব্যবস্থাপনা ; ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ  করিডোর স্থাপন এবং সরবরাহ চেইনের অনিশ্চিয়তা  দূরীকরণ এবং দক্ষ জনশক্তি  গড়ে তোলা । নিশ্চিতভাবে, এ শীর্ষ-সফর সকল গুরুত্তপুর্ন বিষয়ে বাংলাদেশকে অত্যন্ত আশাবাদী করেছে।

সাংস্কৃতিক  ক্ষেত্রে সাফল্য বিবেচনায়, এ সফরে,  যুব,  ক্রীড়া,  শিক্ষা, গবেষনা,  শ্রমজীবীদের উন্নত প্রশিক্ষণ,  এবং কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং সহযোগিতার নিমিত্তে  আলোচনা এবং সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ তার অবকাঠামো উন্নয়ন, গুনগত মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও  গবেষণার বিশেষ সুযোগ কাতার থেকে প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমীতে, কাতারের কূটনীতিবিদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে কাতার আগ্রহপ্রকাশ করেছে। কাতারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে, দেশে ও বিদেশে উচ্চতর পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দু’দেশের সার্বিক উৎপাদনশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কৌশলগত দিক থেকে সাফল্য বিবেচনায়,  মেরিটাইম কানেক্টিভিটি প্রনিধানযোগ্য। এ বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা  বিষয়ে কাতারের মাওয়ানি  বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথেও   হয়েছে সমোঝতা চুক্তি। কানেকটিভিটির সফল-বাস্তবায়ন, মেরিটাইম ক্ষেত্রে  সক্ষমতা ও বহুমাত্রিকতা অর্জনে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিকে উচ্চ-মাত্রায় উন্নীত করবে। কেননা, চট্টগ্রাম বন্দরসহ মাতারবাড়ি এবং পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনায় বঙ্গোপসাগর তথা ভারতমহাসাগর-কেন্দ্রিক মেরিটাইম-লেইন ও করিডোর প্রতিষ্ঠার সার্বিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের অবকাঠামো আঞ্চলিকভাবে অত্যন্ত গুরত্বপুর্ন গন্তব্য হয়ে উঠবে। এবং, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তা সুদূরপ্রসারী বহুমাত্রিক সুযোগ বয়ে আনবে।

জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে,  বিশেষকরে এলএনজি সরবরাহে বাংলাদেশকে  অধিকতর সুবিধা প্রদানে সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও মসৃণ করার বিষয়ে আলোচনা, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ইতিবাচক প্রভাবই ফেলবে।  বাংলাদেশ, ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের সাথেও কৌশলগত  অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা ও জ্বালানি নিরাপত্তায় সম্পৃক্ত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ,  শ্রম ও পেশাজীবীদের অধিকতর কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ও রেমিটেন্স প্রাপ্তির উৎস বিবেচনার বাইরেও এসফরের মাধম্যে  কাতারের সাথে  বহুমাত্রিক  সম্পর্ক উন্নয়নের অমিত সম্ভাবনা দেখছে। এবং,  বাংলাদেশ ও কাতারের শীর্ষ-পর্যায়ে, দু’দেশের  কৌশলগত বন্ধনের সম্মিলন পরিদৃষ্ট হয়েছে।

কাতারের মাহামান্য আমীর বাংলাদেশ অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার খবর রাখেন  বলেই আজকের এ সফর। বোস্টন কনসালটেন্সিসহ  অনেক স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রক্ষেপন মতে বাংলাদেশের  অর্থনীতি যে “ট্রিলিয়ন ডলারে” উন্নীত হবে, ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধশালী হবে, এবিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অবগত এবং অধিকতর আগ্রহান্বিত।  কাজেই, এ সফরে এসে কাতারের মাহামান্য আমীর নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন  ফ্লাগ-শিপ  অবকাঠামো বিনির্মানের প্রকল্প বান্তবায়নের অগ্রগতি। বিশেষ করে অনুধাবন করেছেন  রূপকল্প-২০৪১ ভিত্তিক অর্থনীতির রুপান্তরমুলক  উন্নয়নের কর্মকাণ্ডের  অগ্রগতি এবং এ অভিযাত্রায়, মাননীয়  প্রধানমন্ত্রীর অবিচল প্রত্যয় ও নেতৃত্বের  সাথে জনগণের অংশীদারিত্ব। অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই অনুমিত হয়,  কাতারের মহামান্য আমীর আগামীর উন্নত বাংলাদেশের সাথে কাতারের অংশীদারিত্বেরই  ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন এ সফরের মাধ্যমে।

সার্বিক বিবেচনায়,  এ শীর্ষ-সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যেরই একটি মাইলফলক ।

 

লেখকঃ মোঃ আব্দুল হান্নান – জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাজ্য ও ওমানে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত। 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024