সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
হেরম্ব নিজের ভুল বুঝে সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ কথা তার স্মরণ নেই যে, তার মতো আনন্দ আজ বাইরের পৃথিবীতে বেড়াতে যায়নি, পরম সহিষ্ণুতায় আলো ও অন্ধকারের যে সমন্বয় নিজের মধ্যে করে নিয়ে পৃথিবীর মানুষ ধৈর্য ধরে থাকে আনন্দের কাছে সে সহিষ্ণুতার নাম পরাজয়। সুপ্রিয়ার আবির্ভাবের আগে সে নিজে কি মন নিয়ে এখানে দিন কাটাচ্ছিল হেরম্বের সে কথা মনে পড়ে।
এখানে আসবার আগে মনের সেই উদাত্ত ঊর্ধ্বগ অবস্থা তার কল্পনাতীত ছিল। কি সেই বিপুল একক পিপাসা, প্রশান্ত, নিবিড়, অনির্বচনীয়। এইখানে গৃহকোণে বসে সমগ্র অভিজাত মনোধর্মের বিরাট সমন্বয়ে চেতনার সেই অনাবিল নিরবচ্ছিন্ন পুলক- স্পন্দন, বিশ্বের এক প্রান্তের ভাঙা কুটির থেকে অন্য প্রান্তের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত হৃদয়ে নিখিল-হৃদয়ের জীবনোৎসব, অনন্ত, উদার উপলব্ধির মেলা! সেই মনে ছোট স্নেহ, ছোট মমতাকে কে খুঁজে পেয়েছে?
দে মনের আলো ছিল দিন, অন্ধকার ছিল রাত্রি-অঙ্গনে বিছানো এক টুকরো রোদ আর তরুতলের ক্ষীণ ছায়ার যোগাযোগ আগের মতো মনের আলোছায়ার খেলা সাঙ্গ হয়ে যেত না। সুপ্রিয়াকে মনে করতে হলে সেই মন নিয়ে হেরম্বকে শহরের ধূলিভরা পথে পথে বেড়াতে হত। আর আজ সুপ্রিয়ার কাছ থেকে পরিবর্তিত, ছোট মমতায় ছোট সুখদুঃখে উদ্বেলিত মন নিয়ে এসে সে কি বলে এত সহজে আনন্দের মনের বিচার করে রায় দিচ্ছে?
হেরম্বের অনুশোচনার সীমা রইল না। তাই আনন্দ যখন বলল, ‘তোমার আজ কি হয়েছে, তুমি কিছুই বুঝতে চাইছ না কেন?’-তখন সে বিহ্বলের মতো আনন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা বলতে পারল না।
আনন্দ তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, ‘দেখো তুমি প্রথম যেদিন এলে সেদিন থেকে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। জেগে ঘুমিয়ে আমি যেন স্বপ্ন দেখতাম। সব সময় একটা আশ্চর্য সুর শুনছি, নানা রকম রঙিন আলো দেখছি, একটা কিসের ঢেউয়ে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছি’-বিস্ফারিত চোখে হেরম্বের দিকে চেয়ে আনন্দ মাথা নাড়ল, ‘বলতে পারছি না যে আমি যে সব ভুলে গেছি!’
তার ভুলে যাওয়ার অপরাধ যেন হেরম্বের, এমনি তীব্রস্বরে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন ভুলে গেলাম? কেন বলতে পারছি না?’
Leave a Reply