বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০৫:৩৭ অপরাহ্ন

নারায়নগঞ্জে সাত খুন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ-সহ আসামীদের বিচার কতদূর?

  • Update Time : শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৫.৪৩ পিএম
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় প্রধান আসামী নূর হোসেন

সারাক্ষণ ডেস্ক

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় পুরো দেশ তোলপাড় হলেও দশ বছরেও ওই মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। জেলা আদালত ও হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে আসামীরা যে আপিল করেছিলো তার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মনিরুজ্জামান বুলবুল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে সব ধাপ পেরিয়ে মামলাটি এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। “আশা করি দ্রুতই সেখান থেকে এ মামলার চূড়ান্ত রায় আসবে,” বলছিলেন তিনি।

এর আগে নারায়ণগঞ্জের আদালত এ সংক্রান্ত মামলায় ২৬জনকে মৃত্যুদণ্ড ও নয় জনকে কারাদণ্ড দিয়েছিলো। পরে হাইকোর্ট পনের আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আর বাকী এগার জনকে যাবজ্জীবন এবং অন্য নয় জনের কারাদণ্ড বহাল রাখে।

বিচারিক আদালত ও পরে হাইকোর্টে এ মামলার রায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো তারা হলেন তখনকার র‍্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ (পরে অবসরপ্রাপ্ত), তখনকার কোম্পানি কমান্ডার মেজর আরিফ হোসেন (পরে অবসরপ্রাপ্ত), লেফট্যানেন্ট কমান্ডার এম মাসুদ রানা (ঘটনার পরে চাকুরিচ্যুত) এবং বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন।

মামলার বাদী ও খুন হওয়া সাতজনের অন্যতম কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে তারা চান আদালত যে দণ্ড দিয়েছে তা দ্রুত কার্যকর করা হোক।

“জানিনা কবে এই অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করা হবে। কতদিন অপেক্ষা করতে হয় কে জানে। সরকারের কাছে অনুরোধ দ্রুত শাস্তি কার্যকর করুন,” বলছিলেন তিনি।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক র‍্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ ( মামলার রায়ের পর তোলা ছবি)

কী ঘটেছিলো ১০ বছর আগে

আশরাফ হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তবে বাস করেন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকায়। দশ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ২৭ শে এপ্রিল বিকেলে তিনি ওই এলাকাতেই ছিলেন।

“হঠাৎ করে পুরো নারায়ণগঞ্জ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো। প্যানিক ছড়িয়ে পড়েছিলো। রাস্তাঘাট খালি হয়ে গেলো। খবর ছিলো শুধু একটাই যে চন্দন সরকার ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ দশ জন নিখোঁজ। তাদের কেউ তুলে নিয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে সেদিনের ঘটনা মনে করে বলছিলেন তিনি।

সেদিন আদালত থেকে ফেরার পথে সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৫ জন এবং তার আইনজীবী চন্দন সরকার ও মি. সরকারের ড্রাইভারকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে-এই খবর মূহুর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

নজরুল ইসলাম, চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভার ছাড়াও সেদিন আরও যারা অপহৃত হয়েছিলেন তারা হলেন মি.ইসলামের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন এবং মনিরুজ্জামান স্বপনের ড্রাইভার জাহাঙ্গীর আলম।

এর তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপরই এই অপহরণ ও হত্যার সাথে বিশেষ বাহিনী র‍্যাবের সেখানকার কর্মকর্তা ও কয়েকজন সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে আসে।

পরে তখনকার র‍্যাব-১১ অধিনায়ক ও সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদসহ আরো একজন সেনা কর্মকর্তাকে সেনানিবাস থেকেই আটক করা হয়। মি. সাঈদ তখনকার একজন মন্ত্রীর জামাতা হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও বেশ আলোচনা হয়।

কিন্তু ঘটনার পরপরই ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন মামলার আরেক অভিযুক্ত নুর হোসেন। ঐ বছরই জুনে কলকাতা থেকে নুর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে সেখানকার পুলিশ। এক বছর পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এর মধ্যে এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটি করেন নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি আর অন্যটি করে চন্দন সরকারের জামাতা।

২০১৪ সালে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঐ ঘটনায় নারায়নগঞ্জসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয় (ফাইল ফটো)

পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুই মামলার কার্যক্রম এক সাথেই চলে এবং ২০১৬ সালের সতেরই জানুয়ারি বিচারিক আদালতে মামলার রায় হয়। রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‍্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

যদিও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তারেক সাঈদ যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন তাতে তিনি দাবি করেন যে মেজর আরিফই তাকে সাত জনকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে জানান।

তার দাবি ছিলো যে ২০১৪ সালের মার্চে র‍্যাবের অধিনায়কদের মাসিক সম্মেলনে তিনি একটি তালিকায় থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পান, যে তালিকায় তখনকার প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামেরও নাম বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিলো।

ওই সম্মেলনের পরদিন তিনি তখনকার মেজর আরিফকে নির্দেশ দেন আর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানা নামে আরেকজন কর্মকর্তাকে নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারের বিষয়ে মি. আরিফকে সহায়তার নির্দেশ দেন।

তারেক সাঈদ তার জবানবন্দীতে তখন দাবি করেছিলেন যে সাতাশে এপ্রিল নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালায় র‍্যাব এবং রাত এগারটার দিকে মেজর আরিফ তাকে জানান যে নজরুল ইসলামসহ আসামিদের তিনি মেরে ফেলেছেন।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় অভিযুক্তদের আদালতে নেয়ার দৃশ্য (ফাইল ফটো)

সাত খুনের চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় র‍্যাবের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশে সে বছর সাতই মে জনপ্রশাসনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার।

কমিটি নারায়ণগঞ্জের ঐ অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জড়িত ছিল কি না তা একটি গণ-তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে দেখার চেষ্টা করে এবং অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সময়মত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অবহেলা ছিল কি না সেটিও জানার চেষ্টা করে।

এই গণ-তদন্তের জন্য কমিটির সদস্যরা নারায়ণগঞ্জে যান এবং যেখানে মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাগুলো ঘুরে দেখেন।

কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষের সাথে কথা বলেছে যাদের মধ্যে রাজনীতিক, সাধারণ মানুষজন, নিহতদের আত্মীয়স্বজন ও র‍্যাবের কর্মকর্তারাও ছিলেন।

পরে ২০১৭ সালের ১৬ই জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার রায় হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যায়। ২০১৮ সালের অগাস্টে উচ্চ আদালত পনের আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন। এরপর আপিল করা হয় কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরেই মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পিপি মনিরুজ্জামান বুলবুল।

আদালত যাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল

সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছিলো নারায়নগঞ্জের বিচারিক আদালত। এরা হলেন নূর হোসেন, র‍্যাব ১১ সাবেক অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ( ঘটনার পরে অবসরপ্রাপ্ত), র‍্যাবেক ক্যাম্প কমান্ডার মেজর আরিফ হোসেন, লে কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরিফ হোসেন (আরওজি-১), ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া ও বেলাল হোসেন,সিপাহী আবু তৈয়ব, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দু বালা, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, ছানা উল্লাহ ছানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন ও আবুল বাশার, সৈনিক আব্দুল আলীম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন শরীফ ও তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবীর।

পরে হাইকোর্ট নূর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেনসহ পনের জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। বাকী যাদের মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টও বহাল রেখেছে তারা হলেন- লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম৷

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024