স্বদেশ রায়
লোকাল গর্ভমেন্টের সব ধরনের নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক প্রতীক প্রত্যাহার ও দলীয় মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারি দল আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক দল, অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি জীবনেও যদি কখনও কোন ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়, তা সেটা যত দেরিতে হোক না কেন, অবশ্যই তা সঠিক সিদ্ধান্ত।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যখন লোকাল গর্ভমেন্টে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে সময়ে একটি দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ওই দৈনিকে আমার কলামে দেশের, গণতন্ত্রের ও সর্বোপরি সমাজের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে এই সিদ্ধান্ত না নেবার জন্যে লিখেছিলাম। সেখানে লোকাল গর্ভমেন্টে রাজনীতি ঢুকিয়ে নেপাল, ও পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের ও সমাজের কী ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেছিলাম। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন উপদেষ্টা আমাকে বিষয়টি নিয়ে আরো লেখার জন্যে বলেন। তাঁরা এ বিষয়ে একমত তাও বলেন। তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলাম, একই বিষয় বার বার লিখলে তা প্রপাগান্ডা করার পর্যায়ে পড়ে। একজন সামান্য সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু বুঝেছি আমি লিখেছি। আপনারা যদি একমত হন তাহলে সেটা আপনাদের পার্টি ফোরামে বা সরকারের ফোরামে বলেন। তাদের উত্তর আর উল্লেখ না করি।
এরপরে ওই সময়ের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হলে, তিনি জানালেন, আমার লেখাটি ঠিক হয়নি। তিনি লন্ডনের উদাহরণ দিয়ে অনেক কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে যেহেতু সম্পর্কটা অনেক গভীর ছিলো, তাই বির্তকে না গিয়ে শুধু বলেছিলাম, ওরা অনেক দিন রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র চর্চা করছে। আর আমরা হাজার হাজার বছর ধরে একটি সামাজিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছি। রাষ্ট্র এবং রাজনীতি আমাদের জীবনে এখনও একেবারে নতুন বিষয়। তাই একে মাছ কাটার বটিতে না নিয়ে যাওয়া মঙ্গল বলে আমি মনে করি। মৃদু ভাষী ওই মানুষটি আর কোন কথা বলেননি। ওই আলোচনা আর এগোয়নি। এর পরে যথারীতি লোকাল গর্ভমেন্টকে রাজনীতিকরণ করা হয়।
সাংবাদিক হিসেবে লক্ষ্য করতে থাকি মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনে বিজয় অবিধ সবখানে ক্রমেই সমাজের সম্মানিতরা ছিটকে পড়তে থাকেন। এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো ধীরে ধীরে গ্রাম-সমাজ থেকে মান্যগন্য ব্যক্তি, শিক্ষিত স্বজ্জন ব্যক্তি নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে থাকেন। এমনকি তারা অনেকটা অপাঙক্তেয় হয়ে যেতে থাকেন সমাজজীবনে। আর গ্রাম-সমাজের নেতৃত্ব চলে যেতে থাকে এক ধরনের রাজনৈতিক তরুণদের হাতে, যারা শুধু জীবন সম্পর্কে অনঅভিজ্ঞ নয়, যে কোন লোভকে সম্বরণ করার মতো বয়স, অভিজ্ঞতা, পারিবারিক আচরণ ও শিক্ষাও অর্জন করে পারেনি।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো অনেক পুরানো না হলেও একেবারে কম নয়। “গন্ড গ্রাম” বা একটি পরিপূর্ণ গোছানো গ্রাম এ ভাষায় যোগ হয়েছে। বাস্তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম নিয়ে হাজার বছর আগেই সৃষ্টি হয়েছে একটি সভ্য সমাজ এ ভূখন্ডে। এই ধরনের একটি সভ্য সমাজ ব্যবস্থার জনগোষ্টিতে রাজনীতি’র দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত করতে গেলে সব সময়ই খেয়াল রাখার প্রয়োজন পড়ে, রাষ্ট্র বা রাজনীতি যেন সমাজ বা মানুষেকে রেজিমেন্টেড না করে ফেলে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল দিয়ে সমাজ পরিচালিত করলে সে সমাজ যে কত ভয়াবহ হয়, তা দেখার জন্যে বেশি দূর যাবার প্রয়োজন নেই। বাড়ির পাশে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে গেলেই যথেষ্ট। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে এবং মানুষের ভোটকে দলীয় কর্মীদের অধীনে বা প্রশাসনের অধীনে নিয়ে যাবার জন্যে – একটি সমাজের নিম্মস্তরকে কীভাবে রাজনীতির মাধ্যমে রেজিমেনটেড করতে হয় পশ্চিমবঙ্গে জ্যেতি বসু সে কাজটি করে গেছেন। তার কুফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা এখন সেখানে প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে।
যাহোক, লোকাল গর্ভমেন্টে দলীয় রাজনীতির কুফল কী হয় তা আমাদের গত প্রায় দশ বছরে অনেকখানি ঘটে গেছে। যে কারণে কোভিডের ভেতর বা কোভিড শেষে একটি অনলাইন পোর্টালে এ বিষয়টি একটি লেখা লিখেছিলাম। সে সময়ে দেশের বিভন্নি এলাকা থেকে দেশকে ভালোবাসে এমন অচেনা মানুষের কাছ থেকে লেখার প্রতিক্রিয়া পেয়ে বুঝতে পারি, আমাদের সমাজ “মাছ কাটার বটিতে রাজনীতি” আর নিতে পারছে না।
যাহোক, সরকার ও সরকারি দল শেষাবদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা লোকাল গর্ভমেন্ট নির্বাচনে কোন দলীয় মনোনয়ন দেবে না। এক অর্থে বলা যায় এটা লোকাল গর্ভমেন্টকে রাজনীতিমুক্ত করার প্রথম পদকক্ষেপ। বাস্তবে এই পদক্ষেপ কতদূর এগুবে তা এখনই বোঝা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, আগামী নির্বাচনে বা দু্ই একটা নির্বাচনে খুবে বেশি দূর এগুবে না। কারণ, বাঙালি সমাজের এই গণতান্ত্রিক লোকাল গর্ভমেন্টের বয়স অনেক দীর্ঘ। যা মূলত গোত্র প্রথা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একটা সামাজিক রূপ নিয়েছিলো বলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়। সহজাত এই বিষয়টি বিদেশী শাসকরাও খুব বেশি ভাঙ্গেনি। শক, হুন, মোগল, পাঠান ,ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচরাও এখানে খুব বেশি হাত দেয়নি। বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গের আগে এই লোকাল গর্ভমেন্টকে কিছুটা হলে নষ্ট করেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান তাঁর মৌলিক গণতন্ত্র’র নামে লোকাল গর্ভমেন্টকে মূল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে। তাই ১৯৬০ এর দশক থেকে যে নষ্টের ধারা শুরু তা একটি দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবার প্রশ্ন ওঠে না। তবে যদি ভালোর পথে চলা কিছুটা শুরু হয় সেটা দেশের জন্য বড় ভাগ্য। “যদি কিছু শুরু হয়” এমন প্রশ্ন সামনে আসছে এ কারণে সরকারি দল নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা দলীয়ভাবে এ নির্বাচন করবে না। কিন্তু তাদের স্থানীয় নেতারা কি সেটা মানবেন? তারা তো চাইবেন, তাদের নিজস্ব লোককে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে। আর স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের কথামতই তো প্রশাসন চলবে। প্রশাসন ও সরকারি নেতার পরোক্ষ সহযোগীতা থাকলে- তাদের পরোক্ষ লাঠি মোকাবিলা করার রিস্ক নিতে আর যাই হোক কোন নিপাট মানুষ যাবেন না। এ কারণে এই নির্বাচনের আগে বড় প্রশ্ন, কেন্দ্র কি পারবে, তৃনমূলকে নিয়ন্ত্রন করতে? তাছাড়া সরকারি দলে কার্যত কেন্দ্রে নেতা একজন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর একার পক্ষে কি সম্ভব হবে গোটা তৃনমূলকে নিয়ন্ত্রন করা?
তারপরেও আকাশ যখন দীর্ঘক্ষণ মেঘাচ্ছন্ন থাকে সে সময়ে এক চিলতে রোদ খোঁজাই মনে হয় উচিত। সে হিসেবে প্রথমে সামনে আসে- যদি এই নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের আবার ভোট কেন্দ্রে যাবার ইচ্ছা জাগে, তা সে শতভাগ না হোক- একটা অংশের হলেও অনেক বেশি। স্বেচ্ছায়, প্রার্থীকে ভালোবেসে যদি কিছু মানুষও ভোট কেন্দ্রে যেতে চায় তাহলেও সেই এক চিলতে রোদ ক্ষনিকের জন্যে হলেও আকাশ থেকে মাঠের ঘাস অবধি নাড়া দেবে।
তবে ভোটের চরিত্র যেমন নানান কারণে বদলে গেছে দেশে দেশে। আজ চায়নাও জোরগলায় বলছে তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কারণ, তাদের নেতা বিপুল সংখ্যক সদস্য’র ভোটে নির্বাচিত হয়। হোক তা আজীবন। তাকেও বা প্রশ্ন করার মতো শক্ত উদার গণতন্ত্রের ভিত কতটুকু আর অবশিষ্ট আছে পৃথিবীতে!
এ যেমন আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে, তেমনি বাংলাদেশেও তরুণদের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। ক্ষুদ্র পরিসরে কথাবার্তা বলে, খোঁজ খবর নিয়ে তাদের কথার অর্ন্তনিহিত অর্থ থেকে বুঝতে পারি, গনতন্ত্র ও রাষ্ট্র নিয়ে তাদের অনেকের চিন্তায় একটা পরিবর্তন এসেছে। বাস্তবে তরুণদের একটি বড় অংশ যারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, তারা গণতন্ত্র, ভোট, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে খুব একটা ভাবতে রাজি নয়। এ কাজকে তারা সময় নষ্ট করা মনে করে। তারা তাদের জীবন নিয়ে ভাবতে রাজি। তারা মনে করে জীবনটি তার নিজের। এ জীবন নিয়ে তাকেই এগুতে হবে। এমনকি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেনী নিয়েও তাদের কোন ক্ষোভ নেই। তারা মনে করে, এটা সবকালে সব দেশেই ছিলো। এক সময়ে যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ অন্ধের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভূঃস্বর্গ মনে করতো, সেই মাছের ঝাঁক এখন আর নেই। এমনকি ধর্মের নামেও আছে কিনা সন্দেহ। কারণ, সকলে এখন তথ্য প্রযুক্তির ফলে বুঝতে শিখেছে, সবকালে , সবদেশে বিপ্লব শেষে ওই জারদের প্রাসাদে কমরেডরা বাস করে। আবার ওই রাষ্ট্রে নিজ যোগ্যতা বলে, অনেক কিছুই করা যায়। এই সঠিক বাস্তবতায় এখন বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রজম্ম দাঁড়িয়ে। তাই তারা সহজে ভোট কেন্দ্রে ফিরবে এমনটি আশা করা এ মুহূর্তে খুব বেশি হয়ে যায়। এ সব ক্ষেত্রে সময়ের জন্যে অপেক্ষাই সঠিক।
দ্বিতীয়ত, দলীয় প্রতীক না দিলেও প্রথমবারেই লোকাল গর্ভমেন্ট নির্বাচন খুব বেশি রাজনীতি মুক্ত যেমন হবে না তেমনি সমাজের প্রকৃত গণ্যমান্যরাও খুব বেশি সংখ্যক নির্বাচিত হবেন না। প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তি নিয়েই অধিকাংশই নির্বাচিত হবেন। তার পরেও যারা সমাজকে এগিয়ে নেবার মতো প্রজ্ঞা, ত্যাগ নিজের চরিত্রের মধ্যে রাখেন এদের আবার ফিরে আসার শুরুটাও যদি শুরু হয় তাহলেও তা অনেক বেশি।
কারণ, সমাজটা আর যাই হোক, খেলনাও নয়, ভাড়া বাড়িও নয়। আমাদের সভ্যতায় সমাজই আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। আমারা গভীরভাবে নিজের দিকে তাকালে নিশ্চয়ই বুঝতে পারি এই মাটির সমাজের সংস্কৃতিই আমাদের জীবনের ৯৫ ভাগ। রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্মীয় মতবাদ বার বার নানান নামে এসেছে। তারা পানির ওপরের তেলের মতো পাঁচ ভাগ হয়ে পানিকে ঠেকে দিয়েছে। তেলকে মনে হয়েছে সবটুকু। অথচ নিচে ঠিকই ৯৫ ভাগ পানিই থেকে গেছে। তা্ই সমাজের সংস্কৃতিই এ ভুখন্ডের মানুষের প্রকৃত আশ্রয়স্থল। লোকাল গর্ভমেন্ট নির্বাচন থেকে রাজনীতিকে তুলে নিয়ে যদি এ আশ্রয়স্থলের একভাগ ময়লাও পরিস্কার হয়, তাহলেও সভ্যতার ইতিহাসে সে অনেক বেশি।
লেখক, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সারাক্ষণ- এর সম্পাদক
Leave a Reply