বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন

ভারতে সিএএ-র আওতায় আদৌ কি কেউ নাগরিকত্বের আবেদন করলেন?

  • Update Time : সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৯.৩৮ এএম
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে প্রতিবাদ হয়েছিল সারা দেশে - ফাইল ছবি

সারাক্ষণ ডেস্ক

অমিতাভ ভট্টশালী

ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র আওতায় কতজন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলেন, সেই তথ্য সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই বলে তারা জানিয়েছে। তথ্য জানার অধিকার আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে একাধিক সমাজকর্মী এই একই উত্তর পেয়েছেন।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, এমন সমাজকর্মীরা তাই বলছেন কেউ কি আদৌ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন?

তারা জানাচ্ছেন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী কর্মকর্তা নিয়োগ-সহ যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা আছে আইনে, সেগুলি যে চালু হয়নি, তা সরকার নিজেই স্বীকার করেছে সুপ্রিম কোর্টে।

শুধুমাত্র আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সংবাদ মাধ্যমের কাছে জানিয়েছিলেন যে বরাক উপত্যকা থেকে একজন নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

কিন্তু সেই ব্যক্তি কে, তার পরিচয় প্রকাশ করেননি তিনি। আবার বরাক উপত্যকার সাংবাদিকরাও কেউ খুঁজে পাননি যে কে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

পরিস্থিতি দেখে বিজেপির একাংশ মনে করছে ভোটের আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করে যে রাজনৈতিক লাভ তারা পাবে মনে করেছিল, তা সম্ভবত পাওয়া যাবে না।

তথ্য জানার অধিকার আইন অনুযায়ী করা আবেদনের উত্তর

পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন যে উদ্বাস্তু এবং মতুয়ারা, তাদেরও কেউ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন বলে এখনও জানা যাচ্ছে না।

আবেদনকারীর সংখ্যা

তথ্য জানার অধিকার আইন বা আরটিআই অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফরেনার্স ডিভিশন’-এর অধীন নাগরিকত্ব বিভাগের কাছে একাধিক চিঠি বা মেইল পাঠানো হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার পর থেকে কতজন অনলাইনে সেই আবেদন করেছেন।

তবে বাংলা পক্ষ নামের একটি সংগঠনের তরফে মুহম্মদ শাহিন যেমন আরটিআই অনুযায়ী চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তেমনই ওই একই দফতরে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামীও।

দুজনকেই একই উত্তর দেওয়া হয়েছে নাগরিকত্ব বিভাগের তরফ থেকে।

ওই বিভাগের ডিরেক্টর হিসাবে আর ডি মিনা জানিয়েছেন তার দফতর এ তথ্য রাখে না।

মি. শাহিনকে পাঠানো জবাবে তথ্য না রাখার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের যে রুল জারি করা হয়েছে, সেটি অনুযায়ী কতজন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলেন, সেই তথ্য রাখার কোনও ব্যবস্থাই নেই।

দুজন সমাজকর্মীকেই বলা হয়েছে যে যদি তারা প্রধান তথ্য অফিসারের দেওয়া এই উত্তরে সন্তুষ্ট না হন, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘বিদেশি’ বিভাগের যুগ্ম সচিবের কাছে আবেদন করতে পারেন।

মতুয়াদের ‘ঠাকুরবাড়ি’তে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ – ফাইল চিত্র

‘কেউ আবেদনই করেনি, তথ্য কি করে দেবে?’

সমাজকর্মীরা বলছেন যে অন্তত পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্ভবত নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কেউ আবেদনই করেননি, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তথ্য কোথা থেকে থাকবে?

যে সংগঠনের হয়ে মুহম্মদ শাহিন আরটিআই আবেদনগুলি করেছিলেন, সেই বাংলা পক্ষের প্রধান, অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এটা কী হতে পারে যে অনলাইন আবেদন কত জমা পড়ল, সেই তথ্য থাকবে না সরকারের কাছে?”

“আমাদের ওই আবেদনের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, যে বাস্তবে কতজন নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করছেন সেটা জানা। এই জন্য একাধিক আবেদন করা হয়েছে। উত্তর কী পেলাম? তারা নাকি রেকর্ডই রাখছে না।”

“ডিজিটাল অ্যাপ বানিয়েছে, অথচ তাদের কাছে রেকর্ড নেই? কতগুলো আবেদন জমা পড়েছে, সেটা তারা জানে না? অথচ এমন বলা হয়নি যে আমাদের এই তথ্য জানার এক্তিয়ার নেই”, বলছিলেন মি. চ্যাটার্জী।

মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি অংশের নেতা ও লেখক-সমাজকর্মী সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের কথায়, “কেউ আবেদন করলে তো তথ্য দিতে পারবে সরকার। আমার জানা মতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্তত একটা আবেদনও জমা পড়েনি। তাই তাদের কাছে তথ্যও নেই। কী জবাব দেবে?”

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার পরে মতুয়াদের একাংশের উৎসব

অবকাঠামো গড়া হয়নি

মি. বিশ্বাস বিবিসিকে আরও বলছিলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী কেউ আবেদন করলে সেটা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, যেসব কর্মকর্তা নিয়োগ করা দরকার – সেগুলো যে সরকার এখনও করে উঠতে পারেনি, সেটা তারা নিজেরাই জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে।

মি. চ্যাটার্জী এবং মি. বিশ্বাস দুজনেই বলছিলেন যে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক লাভের আশায় বিজেপি আইনটা চালু করে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা কোনও উদ্বাস্তু বা মতুয়া যে নতুন আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাবে না, তা সবার কাছেই স্পষ্ট।

তবে আইনটি চালু হওয়ার পরে মতুয়া মহাসঙ্ঘের যে অংশটি বিজেপির সমর্থক, তাদের মধ্যে আনন্দ উৎসব হয়েছিল।

ওই অংশের প্রধান, বিজেপির বিদায়ী সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও উচ্ছ্বসিত ছিলেন আইন চালু হওয়ায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন, এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তারাও কেউ এখনও নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করার কথা ভাবছেনই না।

এঁদেরই একজন, যিনি আবার বিজেপির সমর্থক, তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, “আমি কেন নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করব? আমার তো সব পরিচয়পত্রই আছে।“

উদ্বাস্তু ও মতুয়া নেতাদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চলে আসা প্রায় দুই কোটি মানুষের এখনও নাগরিকত্ব নেই।

যদিও এটাও তারা স্বীকার করেন যে আইনসম্মত উপায়ে নাগরিকত্বের নথি না থাকলেও এদের সকলেই কোনও না কোনও ভাবে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ডের মতো নথি ‘জোগাড়’ করে নিয়েছেন।

আর সে কারণেই তারা নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে উৎসাহী নন।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার বিরুদ্ধে আসামে প্রতিবাদ – ফাইল ছবি

‘এই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভবই নয়’

সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের কথায়, “আমরা বারবার মতুয়াদের আর উদ্বাস্তুদের বুঝিয়েছি যে এই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভবই নয়। আবেদন করতে গেলে যেসব নথি দরকার, সেগুলো জোগাড় করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।”

“আর তার থেকেও বড় বিষয় হল নাগরিকত্বের আবেদন করছেন মানে প্রথমেই আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে আপনি ভারতীয় নাগরিক নন, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।”

“কিন্তু এখানে এদের প্রায় সবার আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আছে, অনেকে সরকারি চাকরি করেন,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

তার কথায়, “ভারতের নাগরিক নন, এটা নিজে স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ এখন যত পরিচয়পত্র আপনার আছে, সব বাতিল হয়ে যাবে। তারপরেও আপনার আবেদন যে গৃহীত হবে, আপনাকে যে নাগরিকত্ব দেওয়া হবেই, তার গ্যারান্টি কোথায়?”

নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই আইন চালু?

বিশ্লেষকরা মনে করছিলেন যে ভোট ঘোষণা হওয়ার ঠিক আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বিজেপির রাজনৈতিক লাভ হবে।

আসামের সাংবাদিক বৈকুণ্ঠনাথ গোস্বামী মনে করেন, বিজেপির নির্বাচনী পাটিগণিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ বাস্তবায়নের এটাই সঠিক সময়।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “৪০০ আসনের সীমা অতিক্রম করবে বলে দাবি জানানো বিজেপি কিন্তু দক্ষিণ ভারত থেকে ওড়িশার বিজু জনতা দল পর্যন্ত সব দলকে নিজেদের জোটে একত্রিত করার চেষ্টা করছিল। এ থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিজেপি একটি আসনও হারাতে চায় না।”

“তাই সিএএ-র মাধ্যমে বাংলার মতুয়া সম্প্রদায় এবং আসামের হিন্দু বাঙালি ভোটকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে এনআরসি-তে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালির নাম বাদ পড়েছে।”

“ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হওয়া এই মানুষগুলো বিজেপির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এখন নির্বাচনে সিএএ-র মাধ্যমে এই মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে ভাষণ দেওয়া হবে”, বলছিলেন মি গোস্বামী।

আবার পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া ভোট একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর সব দলের কাছেই।

মতুয়ারা দুটি লোকসভা আসনে নির্ণায়ক শক্তি এবং আরও প্রায় তিরিশটি বিধানসভা এলাকায় তারা বড় সংখ্যায় বসবাস করেন।

আইন চালু হওয়ার পরে বিজেপি নেতাদের উৎসব

বিজেপির কি আদৌ লাভ হবে?

আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে ভোটের মুখে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করে দিয়ে নিজেদের দিকে ভোট টানার যে পরিকল্পনা হয়েছিল, এখন তা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে দলের মধ্যেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

বিজেপিরই পশ্চিমবঙ্গের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা ভেবেছিলাম সিএএ চালু হয়ে গেলে ভোটে আমাদের লাভ হবে। কিন্তু আবেদনই তো জমা পড়ছে না দেখছি, তাহলে আর ভোটে আমাদের সুবিধা হবে কীভাবে?”

“আসলে নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করতে আইনে যেসব শর্ত পূরণ করার কথা বলা হয়েছে, যেসব নথি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো বহু মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে না হওয়ারই কথা।”

ব্যক্তিগত ভাবে একথা বললেও বিজেপি নেতা-নেত্রীরা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বারে বারেই পশ্চিমবঙ্গে এসে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করার কৃতিত্ব প্রচার করছেন।

তারা বলছেন যে এই মতুয়া এবং উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পথ খুলে গেছে।

কিন্তু তাহলে আবেদন কেন জমা পড়ছে না? সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024