সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন

আবু ইসহাকের গল্প — ময়না কেন কয় না কথা

  • Update Time : বুধবার, ৬ মার্চ, ২০২৪, ৫.১৮ পিএম

আবু ইসহাক

 

-জয় বাংলা!

ভীত-সন্ত্রস্ত সোলেমান খাট থেকে গড়িয়ে মেজেয় নামে। আরো তিন পাক গড়িয়ে সে খাটের তলায় চলে যায়। সটান শুয়ে সে মিশে যেতে চায় মেজের সাথে। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে তার সারা শরীর। মুক্তিবাহিনী নিশ্চয় ঘেরাও করেছে বাড়িটা।

সাতজন সশস্ত্র পাকসেনা ও দশ-বারোজন অবাঙালির সাথে মিলিটারি ট্রাকে চড়ে গত রাতে সে ‘অপারেশান’-এ গিয়েছিল। পথ দেখিয়ে সে-ই নিয়ে গিয়েছিল গোপীবাগ। মুক্তিবাহিনীর কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। ঐ এলাকার দশ-বারোটা বাড়িতে তালা ঝুলছিল। তালা ভেঙে ঐসব বাড়ির বহনযোগ্য অনেক কিছু তারা নিয়ে এসেছে। তার ভাগে পড়েছে একটা রেডিও, একটা টেবিল ফ্যান, একটা টেবিল ঘড়ি, দুটো ফুলদানি ও ডজনখানেক ছোট-বড় চামচ।

‘অপারেশন’ থেকে ভোর রাতের দিকে বাড়িতে ফিরেই সে শুয়ে পড়েছিল। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিল না সে। গোলযোগের শুরুতেই বউ- ছেলে-মেয়েদেরকে সে গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে আর কেউ নেই এখন। কাজের মেয়েটায় বোধ হয় দরজা খোলা না পেয়ে চলে গেছে।

চোখ বুজে পরবর্তী ‘অপারেশান’-এর পরিকল্পনা করছিল সে। সে সময়ে শোনা গেল শব্দ দুটি- ‘জয় বাংলা’। শব্দ তো নয়, যেন দুটো বুলেট তীব্র আঘাত হানলো তার বুকে।

খাটের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে সে কান খাড়া করে রাখে। কিন্তু কলজে-কাঁপানো শব্দ দুটো শোনা যায় না আর। শরীরের থরথরানি কমলেও তার বুকটা দুরুদুরু করছে তখনো।

ভয়ে ভয়ে সে খাটের তলা থেকে বেরোয়। একটার পর একটা জানালা খুলে সে দেখে নেয় কেউ ঢুকে পড়েছে কি না বাড়ির ভেতর।

একতলা বাড়িটার চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের ওপরের দিকের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বসানো আছে কাচের টুকরো। বাড়িতে ঢুকবার একমাত্র দরজা পাকুড়টোলা গলির দিকে। সেটিও বন্ধ। সুতরাং বাড়ির ভিতর ঢোকা এতো সহজ নয়।

সোলোমান বুঝে উঠতে পারছে না কোন্ দিক থেকে শব্দ দুটো তার বুকে এসে আঘাত হানলো। শব্দ দুটোর উৎস তার আতঙ্কগ্রস্ত মন নয় তো? শেষে মনের বাঘের ডাক শুনে তার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

 

 

এতক্ষণে সাহস ফিরে আসে সোলেমানের বুকে। তবুও গলিতে বেরুবার দরজাটা খুলতে সাহস হয়না তার। পশ্চিম দিকের দোতলা বাড়িটা থেকে ইংরেজি গানের সুর ভেসে আসছে। পুবদিকের একতলা বাড়িটায় কোনো সাড়াশব্দ নেই।

সোলেমান টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকায়। দশটা বেজে সতেরো মিনিট। তার এখনই বেড়িয়ে পড়া দরকার। অলি-গলি, এ-পাড়া, ও-পাড়া, ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ এখন। কোন বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান বাজে, কোন বাড়িতে সন্দেহজনক ছেলে-ছোকরাদের আনা-গোনা, কোন বাড়িতে দরজায় তালা ঝুলছে…সারাদিন এসব খবর সংগ্রহ করে সে রাতের অন্ধকারে কন্টিনেন্টাল এন্টার- প্রাইজ-এর অফিসে গিয়ে ঢোকে। ছদ্ম সাইনবোর্ডের আড়ালে ওটা আসলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একটা অফিস।

-জয় বাংলা!

-জয় বাংলা! তো

চমকে ওঠে সোলেমান। মনের বাঘ তো নয়! এ যে বনের বাঘের ডাক। থরথরিয়ে ওঠে তার বুকের ভেতটা। শব্দজোড়া দু’বার শোনা গেল। দু’জনের গলার আওয়াজ। পুচকে ছেলেদের কণ্ঠস্বরের মতো মনে হলো। একজনের কণ্ঠস্বর কেমন যেন খ্যানখ্যানে। পুচকে ছেলেরাও যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। অল্পবয়সী ছেলে- ছোকরাদের হাতে এখন গুলি-বোমা, রাইফেল-রিভলভার।

-জয় বাংলা!

-জয় বাংলা!

আবার। আওয়াজ আসছে পুবদিকের বাড়িটা থেকে। কেউ ভিতরে আসছে অথবা বাইরে যাচ্ছে কেউ। স্বাগত সম্ভাষণ বা বিদায় সম্ভাষণ জানাতে শব্দদুটির প্রচলন শুরু হয়েছে ইদানীং।

বাড়িটা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর গোপন আড্ডা।

জরুরী খবর। সন্ধ্যে পর্যন্ত এ খবর নিয়ে বসে থাকা সমীচীন নয়। সোলেমান কাপড় চোপড় পরে। ঘর তালাবন্ধ করে বাইরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজার ফুটো দিয়ে গলিটা দেখে নেয় ভালো করে। না, কেউ ওঁত পেতে নেই। পুব পাশের বাড়িটা থেকেও কাউকে বেরুতে দেখা যায় না। গলি দিয়ে হাঁটাচলা করছে দু’-চারজন নিরীহ পথচারী। সে দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে পড়ে।

বেলা বারোটা। একটা মিলিটারি ট্রাক পাকুড়টোলা লেনের সাত নম্বর বাড়িটার সামনে এসে থামে। মেজর জানজুয়ার আদেশে একদল সশস্ত্র সেপাই ঝটপট ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলে। তারা সবাই শুয়ে পড়ে অবস্থান নেয়। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে তারা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। মেজর জানজুয়ার ডান হাতে উদ্যত রিভলভার। তিনিও এগিয়ে যান বুকে হেঁটে। হঠাৎ তাঁর গম্ভীরকণ্ঠের আদেশ শোনা যায়, অন্দর কৌন হ্যায়? হ্যান্ডস আপ! আর্মস ছোড়কে সারেন্ডার করো।

 

 

ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। হামাগুড়ি দিয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে আবার একই হুঙ্কার ছাড়েন মেজর জানজুয়া।

একজন বুড়োলোক দরজা খুলে হাত উপরে না তুলেই ধীরপায়ে এগিয়ে আসছেন। তাঁর পেছনে আসছে নয়-দশ বছরের একটি ছেলে।

-তুমহার কি নাম আছে? মেজর জানজুয়ার প্রশ্ন।

-শমশের মজুমদার। বেয়াদব সমারিক অফিসারটির ‘তুমি’ সম্বোধন হজম করে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দেন বৃদ্ধ মজুমদার।

-তুমি হিন্দু আছে!

-না, আমি মুসলমান। নির্ভীক কণ্ঠ মজুমদারের। বুকের ভিতর তাঁর ক্ষোভ ও আক্রোশের দাবানল। তাঁর একমাত্র ছেলেকে ওরা তাঁর সরকারী বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করেছে। কলেজের ছাত্র একমাত্র নাতিটা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সে বেঁচে আছে, না মরে গেছে… কোনো খবর নেই। তাই নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যে বৃদ্ধের এতোটুকু প্রয়াস নেই। তিনি উর্দু ভালোই বলতে পারেন কিন্তু নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে হানাদারের কথার জবাবে উর্দু বলতে তিনি ঘৃণা বোধ করেন।

-তুম ক্যায়সা মুসলমান? মজুমদার তো হিন্দু হোতা হ্যায়!

-শুনুন মেজর সাহেব, আপনাদের দেশের রাও-রাঠোর রাজপুত পদবীধারীরা যদি মুসলমান হতে পারে তবে মজুমদার কেন মুসলমান হতে পারবে না? তাছাড়া আরবী শব্দ ‘মজুম’ আর ফরাসী শব্দ ‘দার’ মিলে হচ্ছে মজুমদার। মেজর জানজুয়া বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে পারেন ভালোভাবেই। তাঁর নিজের পদবীটাও আদিতে হিন্দু সম্প্রদায়েরই পদবী ছিল। এখনো জানজুয়া পদবীধারী বহু হিন্দু আছে ভারতে। তাই বৃদ্ধের কথা শুনে তিনি তাঁর নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হন। কিন্তু বাইরে তার অণুমাত্রও প্রকাশ পায় না। তিনি আবার বলেন,-তুম আগার মুসলমান হো তো কালেমা শাহাদাত বলো।

—আশহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।

—ওয়াকেই তুম মুসলমান হো। তুমহারা পিছে কৌন হ্যায় উঅ লাড়কা?

-ও আমার বাসায় কাজ করে।

-আওর কোন্ হ্যায় ঘরমে?

-আমার স্ত্রী আছে। তার প্যারালিসিস। সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না।

-মেরে পাছ খবর হ্যায়, তুমহারা ঘরমে ‘মুক্তি’ হ্যায়।

-মুক্তি? না তো!

-হ্যাঁ, জরুর হ্যায়। তুমহারা ঘরমে ‘জয় বাংলা’ রাহতা হ্যায়।

-না, কক্ষনো না।

-ঝুট বাত মাত বোলো, হামলোহ তুমহারা ঘর সার্চ করেগা।

-হ্যাঁ, করুন।

 

 

মেজর জানজুয়া তাঁর সেপাই নিয়ে ঘরে ঢোকেন। কিন্তু বিছানায় শোয়া এক বৃদ্ধা ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না বাড়িটায়।

বৃদ্ধ মজুমদারকে আবার জিজ্ঞেস করেন মেজর,-আজ মুক্তি আইসেছিলে, তুমহারা ঘরে?

-না, কেউ আসেনি।

-ঝুট মাত বলো, আজ ‘জয় বাংলা’ আইসে নাই?

-না, আসেনি।

-তুমহার বাল সফেদ হোয়ে গেলো, তবু ভি ঝুট বাত বোলতে আছো।

-না, আমি সত্যি কথাই বলছি।

-রহিমদাদ, ইনকো হাতকড়া লাগাও।

একজন সেপাই বৃদ্ধ মজুমদারের হাতে হাতকড়া লাগায়।

মেজর জানজুয়া এবার কাজের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেন,-অ্যাই লাড়কা, তেরা কি নাম আছে?

-আর নাম লেবু। লেবু শেখ।

-এহি ঘরমে আজ কোই আদমি আইসেছিলো?

-ও হ্যোঁ, কেও ন আইয়ে।

মেজর তাঁর হাতের ছড়ি দিয়ে লেবুর পিঠে বাড়ি মেরে বলেন,-মার মারকে খতম করিয়ে দিবো। জলদি বোল।

-কেও আইয়ে ন হুজুর। কাঁদতে কাঁদতে বলে লেবু।

-জয় বাংলা।

মেজর ও তাঁর সেপাইরা চমকে ওঠে। তাদের বিস্মিত চোখ দেখতে পায়, বারান্দার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা খাঁচা ঝুলছে। তার ভিতর একটা পাহাড়ী ময়না। সোনাকানি ময়নাটা মাথা নিচু করে চেয়ে আছে তাদের দিকে।

-জয় বাংলা।

এতক্ষণে রহস্যের গোড়াঘরের সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু আরো কে একজন পাখিটার সাথে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয় সেটা বের করতে হবে তাঁকে। তিনি লেবুকে ধমক দিয়ে বলেন,-এই লাড়কা, ময়নার সঙ্গে আওর কোন্ ‘জয় বাংলা’ বোলে? জলদি বোল। নেহি তো মার মারকে খাল উখার দিবো।

-আঁ-আঁ-আই ময়নাডারে বেঙ্গাই।

-বেঙ্গাই! বেঙ্গাই কিয়া চীজ? মজুমদারের দিকে তাকান মেজর।

-ও ময়নাটিকে ব্যাঙ্গায় মানে ব্যঙ্গ করে।

-নেহি সমঝা।

মজুমদার ইংরেজিতে বলেন ‘দ্য বয় জাষ্ট মিমিকিস দ্য বার্ড।

-নেহি নেহি, ইয়ে লাড়কা ময়নাকো জয় বাংলা ছিখলায়া।

-না, ও শেখায়নি।

 

_তব কাহাঁসে ইয়ে বুলি ছিখ লিয়া?

 

কিছুদিন আগে এ গলি দিয়ে পরপর কয়েকদিন মিছিল গেছে। ওদের শ্লোগান শুনে ময়নাটা শিখেছে। শামশের মজুমদার আসল কথাটা চেপে যান। তাঁর নাতি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে ময়নাটা রেখে গেছে দাদার কাছে। ‘জয় বাংলা’ কথা দুটো সেই শিখিয়েছে ময়নাটাকে।

মেজর জানজুয়া বৃদ্ধের কথা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো। এবার তিনি লেবুর দিকে তাকিয়ে বলেন,—এই লাড়কা, ময়নাকে তো বহুত বেঙ্গাইতে পারস। আভি হামারে বেঙ্গাইতে হোবে।। বোল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

হাকিস্তান জিন্দাবাদ।

হারামজাদে, তু কিয়া বোলা! মেজর তাঁর ছড়ি দিয়ে শপাং শপাং বাড়ি মারেন লেবুর পিঠে।

মজুমদার তাকে বলেন,-ওকে শুধু শুধুই মারছেন মেজর সাহেব। ওর বাড়ি হচ্ছে নোয়াখালি গন্ডগ্রামে। নোয়াখালির অশিক্ষিত লোক প-কে হ বলে।

মেজর জানজুয়া বৃদ্ধ মজুমদার ও লেবুকে ছেড়ে দিয়ে খাঁচাসহ ময়নাটাকে গাড়িতে তুলতে আদেশ দেন।

-জয় বাংলা।

মেজর তর্জনী নাচিয়ে পাখিটাকে ধমক দেন,-চোপ কর চিড়িয়াকা বাচ্চা।

-দাদাভাই কলা খাবো। জয় বাংলা।

-তেরা কল্লা আভি হাম খায়েগা।

মজুমদারের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও একজন সেপাই খাঁচাটাকে নিয়ে ট্রাকে ওঠে। ময়নাটা খাঁচার ভেতর ছটফট করছে, পাখা ঝাপটাচ্ছে আর বলছে, জয় বাংলা।

বৃদ্ধ মজুমদারের দুই গাল বেয়ে অশ্রুরধারা নামে।

ক্যান্টনমেন্টে নিজের বাসায় ময়নাটাকে নিয়ে আসেন মেজর জানজুয়া। তাঁর ব্যাটম্যান ছাড়া আর কেউ নেই, বাসায়। ময়নাটাকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শেখাবার জন্য তিনি ব্যাটম্যান শেরদিলকে নির্দেশ দেন।

শেরদিল দিনের পর দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বুলি শিখছেই না পাখিটা। ওটা কিছুক্ষণ পর পর ডেকে ওঠে, জয় বাংলা। -পাকিস্তান জিন্দাবাদ না বলুক , ওটার ‘জয় বাংলা’ বুলি বন্ধ করতেই হবে। …নির্দেশ দেন মেজর জানজুয়া। ‘জয় বাংলা’ বললেই পিচকারী দিয়ে পানি ছিটোতে হবে ওটার গায়ে। এতো করেও যখন ওর ‘জয় বাংলা’ বুলি বন্ধ করা গেল না তখন ওটাকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেন মেজর জানজুয়া।

কানের কাছে যখন তখন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান শুনতে আর ভালো লাগে না তাঁর। তাছাড়া ক্যান্টনমেন্টের ভিতর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ বুলি কিছুতেই উচ্চারিত হতে দেয়া যায় না।

 

পাখিটাকে ছেড়ে দেয়ার পরেও ওটা দূরে কোথাও যাচ্ছে না। ধারেকাছে কেউ না থাকলে খাঁচার ওপর এসে বসে। লোকজন দেখলে উড়ে গিয়ে বাসার সামনের কাঁঠাল গাছটার ডালে গিয়ে বসে আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘জয় বাংলা’।

একদিন মেজর জানজুয়া ‘অপারেশান’ থেকে ফিরে বারান্দায় বসে কফির পেয়ালায় সবেমাত্র চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় কাঁঠাল গাছ থেকে ময়নার ডাক ভেসে আসে- ‘জয় বাংলা’।

মেজর জানজুয়া রিভলভার বের করে গুলি ছোঁড়েন পাখিটার দিকে। কিন্তু এতোদূর থেকে ছোঁড়া রিভলভারের গুলি পাখিটার অনেক দূর দিয়ে চলে যায়। তিনি আবার গুলি ছুঁড়বার আগেই ময়নাটা পুবদিকে উড়ে চলে যায়। ওটাকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আর কোনদিন ডাকতে শোনা যায়নি। ও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এখানে কথা বলা মোটেই নিরাপদ নয়। তারপর, মুক্ত হয়েছে দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক দিন পর্যন্ত শোনা গেছে পাখিটার সেই ডাক। এখন আর সে ডাক শোনা যায় না। পাহাড়ি ময়নাটা বোধহয় পাহাড়েই চলে গেছে। সে আবারও বুঝতে পেরেছে, এখানে কথা বলা আর নিরাপদ নয়।

এপ্রিল, ১৯৯১

৬৬ বড মগবাজার, ঢাকা

আবু ইসহাক, (১৯২৬-২০০৩) কথাসাহিত্যিক, অভিধান-প্রণেতা।

আবু ইসহাক (ইংরেজি: Abu Ishak) (জন্ম: ১ নভেম্বর, ১৯২৬ (১৫ কার্তিক, ১৩৩৩ বাংলা) তৎকালীন মহকুমা মাদারিপুর (বর্তমান শরিয়তপুর জেলা) নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে, মৃত্যু: ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩, ঢাকায়); তিনি ১৯৪৬ সালে, মাত্র বিশ বছর বয়সে রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ এবং এটি প্রকাশ করা হয় ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে। ১৯৫৪ সালে লেখা ‘জাল’ উপন্যাসটিও প্রকাশিত হয়েছিলো তার লেখার আরও ৩৪ বছর পরে। ১৯৬০ সাল থেকে ২৫ বৎসরে ধরে লেখা তাঁর ‘পদ্মার পলিদ্বীপ‘ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। ছোটগল্পের জগতেও ‘মহাপতঙ্গ’ কিংবা ‘জোঁক’ অসাধারণ দুটি গল্প।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024