শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৩ পূর্বাহ্ন

আমার ইস্তাম্বুল

  • Update Time : শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ৪.০৩ পিএম

তাপস দাস

 

শাকিল রেজা ইফতি বাংলাদেশের বর্তমান যুব সমাজের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। শাকিল ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে সৃজনশীল মেধা অন্বেষনে দেশ সেরা শিক্ষার্থী নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কাছ থেকে জাতীয় মেধা পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। ‘আমার ইস্তাম্বুল’ শাকিল রেজা ইফতির দ্বিতীয় প্রকাশিত বই। প্রথমটি ছিল ‘অশ্রুত একুশ ‘, প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে।

প্রথমেই বলি, বইটির নামকরণ আমার অন্তরের বেশ কিছু গোপন প্রশ্নকে পুনরায় জাগ্রত করেছে। একজন বাংলাদেশী নাগরিক যখন বইয়ের নামকরণ করে ‘ আমার ইস্তাম্বুল ‘ তখন স্বাভাবিকভাবে বর্তমান জাতি রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় ‘দেশ ‘ এর যে ধারণা, সেটি আঘাত প্রাপ্ত হয়। এই নামকরণ বিশ্বনাগরিকতার ধারণাকে সমর্থন যোগায়। হয়তো সুদূর তুরস্ক থেকে এসে শাহজালাল যেভাবে পূর্ববাংলার সংস্কৃতির মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক সেই ভাবেই শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে শাকিল ইস্তাম্বুলে উড়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে তাদেরই একজন। এটি এক লৌকিক সমাপতনও বটে। আমি মনে করি, একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক পরিচয়ে এক বা একাধিক রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে, কিন্তু ‘দেশের ‘ ধারণা ব্যাপক। আমি রাষ্ট্র এবং দেশকে এক আসনে রাখার পক্ষপাতী নই । শাকিলও হয়তো সেই অর্থে তার মানস জগতে তুরস্ককে নিজের বর্তমান দেশের জায়গা দিয়েছে। রুমির ভাষায় ‘ একই ভাষাভাষীর মানুষজন নয়, বরং একই আবেগ ধারণ করা মানুষজনের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর(পৃষ্ঠা: ৮৭) ‘ ।

এই আবেগের পথ ধরে তুরস্করের ইয়েতেবের পাহাড়ি পথ তার মনকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কখনও দার্জিলিং কখনও রাঙামাটিতে। শাকিলের ভাষায় ‘পাহাড়ি এলাকা বলতে দার্জিলিং আর রাঙামাটি গিয়েছিলাম আগে। তবে এখানকার পাহাড়ের ধরণটা বেশ আলাদা (পৃষ্ঠা: ১৪) ।
এছাড়া শাকিলের লেখায় ধরা পড়েছে বুরসা , এস্কিশেহরি ,শিলে এবং আভা শহরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যসহ জানা অজানা নানা ইতিহাস, যা তুরস্কের প্রকৃতির বহুত্ববাদকে তুলে ধরে। মনে রাখতে হবে, শাকিলও কিন্তু বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে। সুতরাং লেখকের মানসপট থেকে তার লেখায় যে সেগুলি উঠে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। শিলে এবং আভা সম্পর্কে শাকিল লিখেছে ” কৃষ্ণসাগরের পাশের এই এলাকাগুলোয় শুধু পাহাড় আর সবুজ। শিলেতে মানুষ মূলত যায় সমুদ্রসৈকতে স্নান করতে, সাঁতার কাটতে (পৃষ্ঠা: ৪০) । এই শিলে হয়তো শাকিলকে মনে করিয়ে দিয়েছে তার কক্সবাজারকে যদিও তা তার এই লেখায় সেটি উঠে আসেনি । এস্কিশেহরি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শাকিল লিখেছে ” ছোট্ট সাজানো গোছানো এই শহরটিকে স্টুডেন্ট সিটিও বলা যায় (পৃষ্ঠা: ৩৬)।

তবে, এস্কিশেহরি যে রাস্তা তার মনকে বিচলিত করেছে তার নাম ‘ইস্তিকলাল স্ট্রিট ‘, আশ্চর্যের বিষয় এই রাস্তা শাকিলকে নিজের জেলা দিনাজপুর কিংবা ঢাকার কথা মনে করায়নি, তাকে মনে করিয়েছে ইস্তাম্বুলের কথা। কারণ ইস্তাম্বুলেও একই নামে একটি রাস্তা আছে। আমার মনে হয় এখানেই বইটির নাম করনের স্বার্থকতা। এই রাস্তার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে শাকিল লিখেছে ” ইস্তিকলাল শব্দের অর্থ হল স্বাধীনতা। অটোমান আমলে এই রাস্তার নাম ছিল জাদ্দে-ই-কেবির বা গ্রান্ড এভিনিউ। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটির নাম পালটে ইস্তিকলাল স্ট্রিট করা হয় (পৃষ্ঠা : ৩৭) ।

প্রাকৃতিক ভিন্নতার মধ্যে যে অভিন্নতা ইস্তাম্বুলকে ‘ আমার ‘ করে তুলতে সাহায্য করেছে তাহল মাতৃভাষার প্রতি তুর্কিদের শ্রদ্ধা। একজন বাংলাদেশী নাগরিকের কাছে এর থেকে আকর্ষণীয় জিনিস কিবা হতে পারে। শাকিলের ভাষায় “এখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় তুর্কি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে ইংরেজি শেখানোর ধরনটাকে মুখ্য করে আরো কিছু বিষয়কে তুর্কি শিক্ষর্থীরা তাদের ইংরেজি কম জানার কারন হিসেবে দায়ী করে থাকে। কিন্তু তারা যতই কম জানুক, তাদের ব্যবহারটিকে বেশ শক্তিশালী মনে হয়েছে (পৃষ্ঠা: ১৬)। ”

একটি রাষ্ট্রকে চেনার আর একটি বিশেষ পন্থা হলো সেখানকার মানুষকে বোঝা, যা শাকিলের চোখ এড়িয়ে যায়নি। শাকিল লিখেছে তুর্কিরা পশুপাখি ভালোবাসে বলেই ইস্তাবুলের রাস্তাঘাটের বেড়ালগুলোর চেহারা ও রকম তুলতুলে সুন্দর। মুদির দোকানে পশুপাখিদের জন্য প্যাকেটজাত খাবার বিক্রি হয়। তুর্কিরা মর্নিং ওয়াকের ফাকে অথবা অফিসে যাওয়ার পথে বিড়ালদের খাবার দিতে দিতে যায়(পৃষ্ঠা: ১৮-১৯)। তুরস্কের জনগণ ছাড়া এই রাষ্ট্রে আছে বেশকিছু সিরীয় দেশান্তরীদের বাস। শাকিলের ভাষায় ” ইস্তাম্বুলে আমার ডরমিটরির এলাকায় বিপুল সংখ্যক দেশান্তরিত সিরীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস। পুরোএলাকায় ওদের খাবার, পোশাক-আশাকসহ বিভিন্ন খুদে ব্যবসার দোকান। সিরিয়ার তরুনেরা ঈদে নতুন পোশাক কেনাকে তাদের সংস্কৃতির অংশ মনে করে (পৃষ্ঠা: ৮৫)।

আমি লেখার শুরুতেই তুরস্কের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববাংলার যে সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলে ছিলাম তাঁর অন্যতম মাধ্যম ছিলেন হজরত শাহজালাল । তবে যার নির্দেশে তিনি এই বাংলায় এসেছিলেন তাঁর কথা ছাড়া তুরস্ক নিয়ে যেকোনো আলোচনা অমীমাংসিত থাকে। তিনি হলেন সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমি। শাকিলের লেখনীতে সেদিক এড়িয়ে যায়নি বরঞ্চ সেই ইতিহাসের ধারাকে আরো প্রসারিত করেছে। লেখকের পরিচয় ঘটেছে রুমির ২২তম বংশধর এসিন ছেলেবি বায়রুর। তাদের সাক্ষাতের সম্পূর্ণ একটি ভাষ্য জায়গায় পেয়েছে ‘ রুমির ছায়ায় এক অপরাহ্নে ‘ বলে একটি অধ্যায়ে।

আমরা যারা সামান্য বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করি, তাদের মধ্যে হয়তো বৃহৎ অংশ একমত যে, এক্ষেত্রে গঙ্গার থেকে পদ্মার অবদান বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশি। তুরস্কে গিয়েও শাকিল কৃষ্ণসাগরের বুকে পদ্মার কৃতিত্বকে বর্ধিত করছে। যা আমি মনে করি শাকিলের একটি অন্যতম কৃতিত্ব। তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করা বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ লেখাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘গীতাঞ্জলি ‘, যা তুর্কি ভাষায় ‘ইলাহিলার (গান ) নাম দিয়ে অনুবাদ করেছিলেন বুলেন্ত এজেনিভ, যার প্রথম সংস্করণটি বেশ পুরোনো, সেই ১৯৪১ সাল (পৃষ্ঠা : ৩৫)। এই ধারায় নতুন ভাবে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে চলে শাকিল এবং তার সহযোদ্ধা গবেষক ও শিক্ষক ড. মুসা তোপকায়া। তুর্কি ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি ওজদেমির আসাফ। এই ওজদেমির কবিতা প্রথম তুর্কি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে শাকিল। যা বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে নিঃসন্দেহে একটি পালক যুক্ত করবে।

‘ অপেক্ষা করো ; বলেছে
তারপর চলে গেছে।
আমি অপেক্ষা করিনি, সেও আর আসেনি।
মৃত্যুর মতো কিছু একটা ঘটেছিল
কিন্তু কারো মৃত্যু হয়নি। ‘

(কবিতা ‘অপেক্ষা করতে বলেছে’, লেখক ওজদেমির আসাফ, অনুবাদ শাকিল রেজা ইফতি( পৃষ্ঠা : ২১)।

শাকিল কৃতী ছাত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের শোভন সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী , সেই সূত্রে আমিও শাকিলের সহযোদ্ধা। এই বিষয়টি আমার কাছে গর্বের। একজন ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের এবং তুরস্কের ক্রমবর্তমান মৌলবাদী ধারণার যে সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে শাকিলের লেখনী এড়িয়ে যায়নি। শাকিল লিখছে ‘ বাংলাদেশে যেমন পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা হামলার শিকার হয়েছেন। একই রকমভাবে আমরা দেখি ইস্তিকলাল স্ট্রিটে ২০১৬ সালে আইএস আত্মঘাতী বিস্ফারণ ঘটিয়েছে(পৃষ্ঠা : ৩৮)।

এছাড়া সমগ্র বই জুড়ে আছে লেখকের বন্ধু , অপ্রকাশিত, প্রকাশিত প্রেম , বোবা চোখের আক্ষেপ ,
মনের বিপ্লবের দোলাচল যা নতুন পাঠকদের আবিষ্কারের উদ্যেশ্যে উহ্য রাখলাম।

 

লেখকঃ তাপস দাস, গবেষক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী অধ্যাপক, কান্দি রাজ কলেজ, মুর্শিদাবাদ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024