মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
‘ও আআওও’
চিৎকারের সঙ্গে ভেসে আসে হাততালি। একটি বাড়ির জানালা খোলা। সেখানে ভিড় করে আছেন অনেকে। ঘরের ভেতরেও কোনো খালি জায়গা নেই। যেখানে স্থান পেয়েছেন বাড়ির কর্তার পরিবার ও পরিচিতরা। আর ঘরের বাইরে এলাকার কিংবা পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন এমন কেউ। তারা জানালার গ্রিল ধরে ভেতরে তাকিয়ে আছেন। কে কোন অবস্থানে আছেন তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবার চোখ একটি বড় বাক্সের দিকে। সেখানে সাদা-কালো পর্দায় দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার জঙ্গল। তারা বিস্ময় ও উত্তেজনা নিয়ে দেখছেন, বিপদে পড়া নায়িকাকে রক্ষা করছেন গাছের লতায় ঝুলে আসা এক তরুণ। নাম তার টারজান। তার চিৎকারের স্বর যত উচ্চ হয়, হাততালি তত বাড়ে।
প্রায় ১০০ বছর আগে অলিম্পিকে পাঁচ স্বর্ণপদক জয়ী সাঁতারু জনি ওয়েজমুলার- অভিনীত টারজান সিরিজের মুভিগুলো বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে তৈরি হয়। তারও প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোর অলস দুপুরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন প্রচারিত হতো তখন দর্শকদের আগ্রহ ছিল এতটাই তীব্র। টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের এই আকর্ষণ বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজ ‘ম্যাকগাইভার’ নিয়ে শিল্পী ডলি সায়ন্তনীর গান থেকে। তার তুমুল জনপ্রিয় ‘হ্যালো ম্যাকগাইভার’ গানের লাইন ছিল এমন, ‘টেলিফোন ধরি না, কবিতা পড়ি না, রাত জেগে দেখি না ভিসিআর, আমার দুচোখ শুধু তাকেই খোঁজে, ম্যাকগাইভার, হ্যালো ম্যাকগাইভার শয়নে স্বপনে ভাবি আসবে কবে বুধবার’।
সে-সময় টিভি চ্যানেল ছিল একটিই, বাংলাদেশ টেলিভিশন। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, টেলিভিশন সেট ছিল মহল্লার হাতেগোনা কয়েকটি বাসায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই টিভিসেট রাখা হতো একটি বড় কাঠের বাক্সে তালা দিয়ে। সেই বাক্স আবার হাতে সেলাই করা কাপড়ের পর্দা দিয়ে মুড়ে রাখা হতো। তখন কোনো বাসায় টিভিসেট রাখতে হলে সরকারি লাইসেন্স করাতে হতো, যা প্রতিবছর নবায়নের নিয়ম ছিল। সে-সময় টিভিসেট ছিল সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতীক।
বিটিভির অনুষ্ঠান এবং নাটক ছিল সবার মুখে মুখে। ফজলে লোহানী তাঁর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানে বিনোদন ও কৌতুকের পাশাপাশি টিভি রিপোর্টিংয়ের ধারা বদলে দেন। পদ্মার নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উড়ির চরের এক বৃদ্ধার ইন্টারভিউ কিংবা প্যালেস্টাইন সমস্যাসহ নানা বিষয়ে সীমিত সুবিধা নিয়ে তিনি যে-অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন তা দর্শকের মনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘সপ্তবর্ণা’, ‘সোনালি দরজা’ নিয়ে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনের দরজা খুলে দিতে চেষ্টা করেছেন। আনিসুল হক তাঁর ‘বলা না বলা’, ‘এখনই’ অনুষ্ঠানে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরেন। ‘কান্না’ নিয়েও একটি পুরো অনুষ্ঠান হতে পারে আনিসুল হক তা প্রমাণ করেছিলেন। শফিক রেহমান ‘সোনার হরিণ’ ও ‘লাল গোলাপ’ অনুষ্ঠানে আইকিউ ও তথ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন।
হানিফ সংকেত জনপ্রিয় হন ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের জন্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা ম্যাগাজিন ‘ইত্যাদি’। শাইখ সিরাজ কৃষিবিষয়ক প্রোগ্রাম ‘মাটি ও মানুষ’-এ প্রাণের সঞ্চার করেন। আইনের মতো আপাত নিরস বিষয়কে ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয় করে তোলেন রেজাউর রহমান। তাঁর অনুষ্ঠানে প্রবীণ আইনজীবী গাজী শামসুর রহমানের চোখ বন্ধ করে ‘দবির ও ছবির’-এর গল্পের ভেতর দিয়ে আইনি সমাধানের বিষয়গুলো ছিল অনন্য। এই অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত ভাওয়াল রাজার মামলা নিয়ে নাটিকা ছিল আরেক বড় আকর্ষণ। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘উজ্জীবন’-এ আলোচনা করে জনপ্রিয় হন সৈয়দ আলী আশরাফ ও এম. শমশের আলী। আসাদ চৌধুরী ‘প্রচ্ছদ’, রায়হান গফুর ‘পরিচয়’, প্রফেসর আবদুল মমিন চৌধুরী কুইজ অনুষ্ঠান ‘ধীমান’, আবদুন নূর তুষার ‘শুভেচ্ছা’ নিয়ে বিটিভির প্রতিনিধিত্ব করেছেন একসময়। সিনেমার গানের ‘ছায়াছন্দ’ কিংবা ইংরেজি পপ মিউজিকের অনুষ্ঠান ‘সলিড গোল্ড’ পরিবারে সব বয়সীদের জন্য অনুমোদিত ছিল না। এই নির্দেশনা মানতে ছোটদের মধ্যে কোনো ক্ষোভ থাকত না।
ঈদের দিন মানে ছিল ‘আনন্দমেলা’। এই প্রোগ্রামটি ছিল উপস্থাপকদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। অনেক উপস্থাপক হারিয়ে গিয়েছেন আনন্দমেলায় ব্যর্থতার কারণে। আবার অনেকের ক্যারিয়ার বদলে দিয়েছে আনন্দমেলা। অভিনেতা আফজাল হোসেন, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, সাংবাদিক আবেদ খান ও শিক্ষক সানজিদা আক্তার দম্পতি, ডা. নকীব উদ্দিনসহ অনেককেই আনন্দমেলার পরীক্ষা দিতে হয়।
মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনার শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’ ক্ষুদে প্রতিভা খুঁজে বের করার এক দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি ছিল। এই অনুষ্ঠানের থিম সং ‘আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি’ কোনো অংশে কম জনপ্রিয় ছিল না। ফেরদৌসী রহমানের অক্লান্ত পরিবেশনায় ‘এসো গান শিখি’র মতো এত সহজ ও প্রাণবন্ত প্রোগ্রাম আর কেউই করতে পারেননি। ‘ক-এ কলা, খ-এ খাই’, ‘খরগোশ ও খরগোশ, তুমি রান্না করছো কী’ গানের সুর বিটিভির সামনে বসা ক্ষুদে দর্শকদের হৃদয়কে আন্দোলিত করত।
বিটিভির একক ও ধারাবাহিক নাটকগুলো ছিল সমাজের প্রতিচ্ছবি। বেগম মমতাজ হোসেনের ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল সন্ধ্যা’ নাটকে আফরোজা বানু ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিমু-শাহেদ’ চরিত্র এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে, আজাদ প্রোডাক্টস এই জুটির ছবি দিয়ে ভিউকার্ড ছেপে ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে ফেলে। হুমায়ূন আহমেদের ‘এই সব দিনরাত্রি’ ও ‘কোথাও কেউ নেই’ দুই ধারাবাহিক নাটকের চরিত্র টুনি ও বাকের ভাইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নজিরবিহীন মিছিল ও আন্দোলন হয়েছে। লেখকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল। গ্রামভিত্তিক নাটক ‘মাটির কোলে’ স্মরণীয় হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ধসে ছাত্রদের মৃত্যুর কারণে। তখন ছাত্ররা এই নাটকটিই দেখছিলেন।
আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটক ‘জব্বর আলী’ সিরিজে নানা ধরনের অন্যায় তুলে ধরা হতো। যার ফলে জব্বর আলীকে প্রতি ঈদের দিন জেলে বসে সেমাই খেতে হতো। এখনো বাস্তব জব্বর আলীরা রোজার সময় খাদ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন। তবে এখন ‘রোকন দোলন জবা কুসুমের মা’দের জেলে সেমাই নিয়ে যেতে দেখা যায় না। আবদুল্লাহ আল মামুনের আরেক চরিত্র ‘বাবর আলী’। যিনি মানুষকে প্রতারণা করে পঞ্চাশ বা একশ টাকা হাতিয়ে নিতেন। বর্তমান সমাজের বাবর আলীরা ব্যাংক থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন আর তাদের সতর্ক করে কোনো টিভি চ্যানেলে গান বাজে না, ‘বাবর আলী ও বাবর আলী, সর্বনাশা এ পথ ছেড়ে এখনো সময় আছে আয় চলি।’
বিটিভির পাশাপাশি একসময় শুরু হয় টেরিস্ট্রিয়াল সুবিধাপ্রাপ্ত বিটিভির আরেকটি চ্যানেল। প্রথমে এর নাম ছিল ছয় নাম্বার চ্যানেল। ব্রুস লি অভিনীত ‘গ্রিন হর্নেট’ টিভি সিরিজটি এখানে দেখানো হতো। পরবর্তীকালে এই টেরিস্ট্রিয়াল সুবিধা ব্যবহার করে বেসরকারি একুশে টিভি বা ইটিভি দেশজুড়ে প্রচারের সুযোগ পায়। একসময় নিয়ম বহির্ভূতভাবে তরঙ্গ বরাদ্দের অভিযোগে একুশে টিভির টেরিস্ট্রিয়াল প্রচার বন্ধ করা হয়। বর্তমানে বিটিভির নিয়ন্ত্রণে আরো আছে বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ টেলিভিশন ও বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র।
বিটিভি এক পর্যায়ে বেসরকারি পর্যায় থেকে অনুষ্ঠান ও নাটক কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘প্যাকেজ প্রোগ্রাম’ নামে কেনা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ এবং মাসুদ রানার কাহিনি নিয়ে নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ ছিল এই তালিকার শুরুতে। বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের অনুমোদন টিভি জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে সারাদেশে অবকাঠামোগত সমস্যার জন্য সূচনা সময়ের চ্যানেলগুলো প্রথমে ঢাকায় এবং পরে ক্রমান্বয়ে বিভাগীয় শহরে তাদের অনুষ্ঠান দেখানোর সুযোগ পায়। এ- কারণে প্রথমে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোর দর্শক ও বিজ্ঞাপন কম ছিল। একটি চ্যানেল প্রায় সারাদিন শুধু বিড়ির বিজ্ঞাপন প্রচার করত। অবস্থা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি টেলিভিশনের মধ্যে এটিএন বাংলা এবং চ্যানেল আই এই চ্যালেঞ্জে টিকে যায় সাফল্যের সঙ্গে এবং তারা ব্যবসাসফল হয়।
পর্যায়ক্রমে আরো বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রচারে আসতে থাকে। দেশে অনুমোদিত বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী, বাংলাভিশন, দেশ টিভি, চ্যানেল নাইন, মাই টিভি, এটিএন নিউজ, মাছরাঙা, ইনডিপেন্ডেন্ট, মোহনা, সময়, বিজয়, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, জিটিভি, একাত্তর, এশিয়ান, এসএ টিভি, গান বাংলা, যমুনা, দীপ্ত, নিউজ টোয়েন্টিফোর, ডিবিসি নিউজ, দুরন্ত, বাংলা, নাগরিক, আনন্দ, টি স্পোর্টস, নেক্সাস, টিভি টুডে ইত্যাদি প্রচারিত হচ্ছে, আরো কয়েকটি প্রচারের অপেক্ষায় আছে। বিভিন্ন কারণে কয়েকটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এত টিভি চ্যানেল মিলেও বাংলাদেশের দর্শকদের ভারতীয় চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। একসময় কলকাতার দর্শকরা বিটিভির নাটক দেখতে উদগ্রীব থাকতেন। এখন জিটিভি, স্টার জলসা ইত্যাদি ভারতীয় চ্যানেলগুলো এদেশের মানুষের লাইফস্টাইলও বদলে দিচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, উৎসবের পোশাক থেকে শুরু করে সামজিক রীতিনীতিও তাদের প্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি চ্যানেল শুধু কাজের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়নি, একই সঙ্গে সাংবাদিকতার গ্ল্যামারও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের পাশাপাশি বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনগুলো তরুণ শ্রোতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রেডিও টুডে, ফুর্তি, আমার, এবিসি, মেট্রোওয়েভ, স্বাধীন, এশিয়ান, ভূমি, ঢাকা, সিটি, পিপলস, কালারস, ধ্বনি, নেক্সট, জাগো ইত্যাদি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। অনলাইনে নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ, বাংলানিউজ-এর পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকাগুলোও এখন অনলাইনে জোর দিচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও মিডিয়া বিষয়ে পড়াশোনা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাঁচ দশকে সাংবাদিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। তবে আদর্শ ও নীতিগতভাবে কতটা উন্নতি হয়েছে সে-প্রশ্ন থেকেই যায়।
দুই
স্বাধীন বাংলাদেশে শুরুতে সংবাদপত্রের সংখ্যাও ছিল কম। দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ‘ইত্তেফাক’ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী। সমাজে ইত্তেফাকের প্রভাব ছিল একচেটিয়া। বামধারার পত্রিকা ‘সংবাদ’ এবং ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া ‘আজাদ’- এর পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত ‘দৈনিক বাংলা’ ছিল আলোচিত। একটি পরিবারে পত্রিকা রাখা মানে ছিল রুচি ও অগ্রসরতার প্রকাশ। বাড়িতে পত্রিকা এলে প্রথমেই তা চলে যেত পরিবারের কর্তার হাতে। তিনি দেখার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌথ পরিবারের সদস্যরা একেক জন একেক পাতা নিয়ে যেতেন। বিশেষ করে ইত্তেফাকের ভেতরের পাতায় টারজান কমিকস, রাশিচক্র, সিনেমা ও খেলার পাতাগুলো চলে যেত তাদের ভক্তদের কাছে। যারা সারাদিন অপেক্ষা করতেন পত্রিকার জন্য। মফস্বল শহরে পত্রিকা কখনো কখনো সন্ধ্যায় বা পরদিন গিয়ে পৌঁছাত। নব্বইয়ের দশকে দৈনিক পত্রিকার জগতে নতুন একটি ধারার জন্ম দেয় ‘আজকের কাগজ’। প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর, সমকাল, জনকণ্ঠ, মানবজমিন, ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ ইত্যাদি বর্তমান সময়ের প্রচলিত পত্রিকা।
সাপ্তাহিক পত্রিকার মধ্যে স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা গ্রুপের ‘বিচিত্রা’ একধরনের সামাজিক বিপ্লব ঘটায়। বিষয় বৈচিত্র্য, লেখার স্টাইল, তারুণ্যনির্ভর উপস্থাপনার জন্য পাঠকরা অপেক্ষা করতেন পরের সপ্তাহে কী বিষয়ে কভার স্টোরি হয় সেটি দেখার জন্য। বিচিত্রার পাশাপাশি সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি নির্ভর ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সাপ্তাহিক রোববার’, ‘চিত্রবাংলা’ ম্যাগাজিনগুলো সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব ম্যাগাজিনে মূলত আর্থ-সামজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় বেশি প্রাধান্য পেত।
সরাসরি রাজনীতিকে পাঠকের সামনে ভিন্নমাত্রায় তুলে ধরে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে তুলনামূলক ছোট কলেবরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’। কোনো ম্যাগাজিনের সার্কুলেশন দেড় লাখ হতে পারে সেটা দেখিয়ে দেয় ৩২ পৃষ্ঠার এই ম্যাগাজিনটি। সামরিক শাসনবিরোধী আক্রমণাত্মক অবস্থানের জন্য কয়েক দফায় ম্যগাজিনটি নিষিদ্ধ হয়। এর বাইরে একই রকমের স্বল্প কলেবরের ‘বিচিন্তা’, ‘খবরের কাগজ’, ‘আজকের সূর্যোদয়’ বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণীর মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাহিত্যপ্রেমীদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ছিল আনন্দবাজার গ্রুপ- প্রকাশিত কলকাতা থেকে আসা ‘দেশ’ ম্যাগাজিন। একই গ্রুপের ‘সানন্দা’ আরেক শ্রেণীর নারীপাঠকের পছন্দের তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশের নারীদের কাছে ‘বেগম’ ম্যাগাজিনটি ছিল নিয়মিত পাঠের তালিকায়। বিশেষ করে বেগমের ‘ঈদ সংখ্যা’ নারী-পুরুষ সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। পরবর্তীকালে সাহিত্যনির্ভর ঈদ সংখ্যার জন্য আলোচিত হয় ‘বিচিত্রা’ এবং আরো পরে ‘অন্যদিন’। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসা ‘সোভিয়েত নারী’ ও ‘উদয়ন’ ম্যাগাজিনগুলো শুধু বিষয় বৈচিত্র্য নয়, এর মেকআপের জন্যও পাঠকের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়। ম্যাগাজিনগুলোর তুলনামূলক পুরু কাগজগুলো হয়ে যেত সেই পরিবারের স্কুলসদস্যদের ক্লাসের বইয়ের মলাট।
তিন
একসময় উৎসাহী ব্যক্তিরা পত্রিকা প্রকাশ করতেন কোনো চেতনাকে ধারণ ও প্রচার করার জন্য। এ-কারণে অনেক সময় তাঁদের জেল ও জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। বর্তমানে কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিডিয়া পরিণত হয়েছে করপোরেট হাউজের বর্ধিত অংশে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বে এই রূপান্তর ঘটে গিয়েছে আরো আগে। প্রায় প্রতিটি বড় করপোরেট হাউজের এক বা একাধিক মিডিয়া আছে। এসব মিডিয়া আদর্শ প্রচারের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই মূল কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ বেশি দেখে থাকে। অনেকে চ্যানেলের লাইসেন্স পাওয়ার পর তা চালাতে কোনো করপোরেট হাউজের সঙ্গে পার্টনারশিপে যান। কিন্তু একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ টাকার কাছেই চলে যায়। বাংলাদেশের মিডিয়া মালিকদের কারো কারো মধ্যে আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। অনেক মালিক ব্যবসায়িক সাফল্য লাভের পর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে উৎসাহী হন। তখন পুরো মিডিয়া পরিণত হয় তাঁর রাজনৈতিক প্রচারণার যন্ত্রে।
মিডিয়ার আয়ের প্রধানতম উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন। টিআরপি পেতে ব্যস্ত হয়ে এই বিজ্ঞাপন সংগ্রহের বা প্রচারের ইঁদুরদৌড়ে অনেক সময় নীতি-নৈতিকতার বিষয়গুলো ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।
ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের কারণে মূলধারার মিডিয়াগুলো সংকটে আছে। তাদের বিশাল সেটআপ এবং ব্যাপক ব্যয়ের বিপরীতে যে-বিজ্ঞাপন তারা আয় করছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বিজ্ঞাপন তুলে নিয়ে যাচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া। ঘরে বসে সামান্য টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়েই এসব মিডিয়ায় যে-কেউ অংশ নিতে পারেন। এখানে যিনি তা আপলোড করছেন তিনিই রাজা বা
রানী। ফলে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। প্রতিটি টিভি চ্যানেল এখন ইউটিউবে তাদের প্রোগ্রাম বা খবর দিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যেসব আকর্ষণীয় ও পাঠক চাহিদা মেটানো সংবাদ তারা টিভি চ্যানেলে দিতে পারছে না সেগুলোও ইউটিউবে দিয়ে আয় করার চেষ্টা করছে। ওটিটি প্লাটফরমসহ অজস্র অনলাইন মিডিয়ার সার্বক্ষণিক অনুষ্ঠান, খবর, সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারে অবস্থা যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে বড় মিডিয়া হাউজগুলো ক্রমশ সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় আছে।
পৃথিবীজুড়েই মিডিয়া একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিটি সন্ধিক্ষণেই এই ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। এত কিছুর পরও কেউ কেউ মনে করেন, এখনো সমাজ পরিবর্তনে মিডিয়া যত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে তা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ মিডিয়া এখন শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, তা পরিণত হয়েছে জীবনের সঙ্গী হিসেবে। মানুষের জীবনদৃষ্টি বদলে দিতে ইতিবাচক কাজ করতে পারে মিডিয়া। অনেক কিছুর ভিড়ে পাঠক, শ্রোতা, দর্শক তিন শ্রেণীই একসময় প্রকৃত তথ্য এবং সত্যকেই খুঁজে পেতে চাইবেন।
এই বিশ্বাস পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার মতো বাংলাদেশেও আছে। এখানেও প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু মিডিয়া গড়ে উঠছে। তারা আশাবাদী তাদের বুক পকেটে রাখা জোনাকি পোকাগুলো টিমটিম করে হলেও অন্ধকারে আলো জ্বেলে যাবে।
লেখক পরিচিতি: মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা। সম্পাদক, সাপ্তাহিক বিপরীত স্রোত। আড়াই দশক ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মাধ্যমে। বাংলার অনালোচিত গৌরবময় ইতিহাসে আগ্রহী। ‘রুটস’ ম্যাগাজিন সম্পাদনার মাধ্যমে ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মে সামনে সহজ ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। প্রকাশিত গল্পের বই একটি।
Leave a Reply