ফিলিপ ইভানভ
গত দুই বছরে, মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা স্যাংশনগুলির মধ্যে রাশিয়ার যুদ্ধের অর্থনীতির জন্য চীন যে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে তা বিশেষভাবে বিশ্লেষনের দাবী রাখে।
চীনের ভূ-অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় মস্কো যে ভূমিকা পালন করছে তা প্রায়শই অবহেলিত থাকে। রাশিয়া ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সংযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে ওয়াশিংটনের প্রতিযোগিতামূলক যে বিপদ চায়নার জন্যে তার বিরুদ্ধে চীনের অর্থনীতিকে রক্ষা করার পরিকল্পনায় রাশিয়া একটি অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধের মধ্যে মস্কোর প্রতি চীনের সমর্থনের পশ্চিমা নিন্দা সত্ত্বেও, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্কে দ্বিগুণ করছেন।
গত মাসে, শি বেইজিংয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন । পরের মাসে চীনের সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এবং জুলাইয়ে এস্তানায় পরবর্তী সাংহাইয়ের সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি অন্যান্য অনুষ্ঠানেও শীর্ষ দুই নেতার সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি চলছে।
বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাশিয়ার ওপর চীনের উল্লেখযোগ্য এবং অসমান প্রভাব নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেবল একটি দিক।
উল্লেখ্য, শির ভূ-অর্থনৈতিক কৌশল তিনটি পারস্পরিক সম্পর্কিত উপাদানের উপর ফোকাস করে: চীনের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী করা, অ-পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যকরণ এবং বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত সরবরাহ চেইনের একটি অপরিহার্য কেন্দ্র হিসাবে চীনের অবস্থান বজায় রাখা।
এই উপাদানগুলোর প্রতিটিতেই রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রথমত, রাশিয়া চীনের জন্য একটি বড় শক্তি, কৃষি এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির অংশীদার হিসেবে।
শক্তি এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সবসময় কৌশলী চীন। যখনই রাশিয়ার ওপর আমেরিকার স্যাংশন এসেছে এবং ইউরোপীয় বাজারের ক্ষতির কারণে রাশিয়ার তেল, গ্যাস, শস্য এবং সারের দাম কমেছে সুযোগ নিয়েছে চীন।
ইউক্রেনে সংঘাত, স্যাংশন এবং সুনামের ক্ষতির কারণে চাপে থাকা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের তুলনায় অ্যাক্সেস অ-সীমা প্রযুক্তিসহ চীনা দাবিগুলোর প্রতি আজ অনেক বেশি উন্মুক্ত।
২০২৩ সালে সৌদি আরবকে পিছনে ফেলে চীনের বৃহত্তম তেলের সরবরাহকারী হয়েছিল রাশিয়া, যা ২৪% বেড়ে ১০৭ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি হয়েছে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া চীনের সামগ্রিক তেল আমদানির প্রায় ১৯% সরবরাহ করেছে।
দ্বিতীয়ত, চীনা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমানে অভ্যন্তরীণ বাধা, অতিরিক্ত ক্ষমতা সমস্যা এবং ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিধিনিষেধের চাপের মুখোমুখি হওয়ার সময় রাশিয়া হয়ে উঠেছে চীনা পণ্য এবং পরিষেবার জন্য একটি বৃহৎ বাজার।
গত বছর চীনের রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২৬% বেড়ে ২৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রাশিয়া থেকে আমদানি ১৩% বেড়েছে। বাণিজ্যের পরিমাণ উঠানামা করলেও, প্রবণতাটি উর্ধ্বমুখী হতে থাকবে।
গত বছরের উত্থানের অর্থ হল অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানিকে পিছনে ফেলে রাশিয়া চীনের ষষ্ঠ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে, পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো ছেড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে ছুটে আসা চীনা গাড়ির নির্মাতাদের জন্য রাশিয়া শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ৯০০,০০০ এর বেশি চীনা গাড়ি রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, যা দ্বিতীয় স্থানের অর্থাত মেক্সিকোর ৪১৫০০০ গাড়ির আমদানিকে ছাপিয়ে গেছে।
রাশিয়া এবং চীন মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এবং সম্ভাব্য মার্কিন অবরোধের সম্ভাবনা থাকা সমুদ্রপথের বিকল্প হিসেবে বর্ধিত স্থলপথ বাণিজ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অবকাঠামো রেলপথ, বন্দর, সড়ক এবং সংরক্ষণাগার সুবিধা সম্প্রসারণ করতে ব্যস্ত।
পশ্চিমা স্যাংশনের চাপ এবং গভীরতর অর্থনৈতিক ঐক্যকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তার একটি লক্ষণস্বরূপ, রাশিয়ান ধাতু কোম্পানি নর্নিকেল গত সপ্তাহে ইঙ্গিত দিয়েছে যে এটি নতুন যন্ত্রপাতি সহ বিশ্বের বৃহত্তম ধাতুর বাজারে আরও ভাল অ্যাক্সেস পেতে দেশের আর্কটিক অঞ্চল থেকে একটি তামার কারখানা চীনে স্থানান্তর করবে।
তৃতীয়ত, তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ বা ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসলে বাণিজ্য যুদ্ধের আরও বৃদ্ধির মতো কারণে পশ্চিমের সাথে বৃহৎ পরিসরের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ঘটনায় বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক সামর্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবরেটরি হিসেবে মূলত কাজ করছে।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বাধিক স্যাংশনের মুখোমুখি এবং বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্ন একটি বড় শক্তি হওয়া সত্ত্বেও, পশ্চিমা স্যাংশন এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাশিয়া যে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে থাকার দক্ষতা দেখাচ্ছে তা থেকে চীন শিখতেও আগ্রহী।
চীনা অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকরা ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার পারফরম্যান্স পর্যালোচনা করার মতোই যত্ন সহকারে পশ্চিমা স্যাংশন এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক এবং আর্থিক নীতিগুলোও বিশ্লেষণ করছেন।
রাশিয়ায়, চীন তার মুদ্রা ব্যবস্থার বাস্তবসম্মত ব্যবহার এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে। মস্কো তার অর্থনীতি ডলারমুক্ত করতে চাইলে, ২০২৩ সালে মস্কো স্টক এক্সচেঞ্জে সমস্ত বিদেশি মুদ্রা ট্রেডিংয়ের ৪২% ইউয়ান ছিল, যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। অন্যদিকে, ডলার ৬৩% থেকে কমে ৩৯% হয়েছে।
অবশ্যই রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানের সাথে চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের বিকল্প নয়।
তবে বেইজিংয়ের ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল আমেরিকার ক্ষমতা হ্রাস করা। চীন তার অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের টেকসই ক্ষমতার উপর পণ করছে, যা শক্তিশালী থাকছে। বেইজিং বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রদর্শন করতে পারলে যে এটি রাশিয়ার সাপ্লাই চেইন এবং শক্তির বাণিজ্যে পশ্চিমকে প্রতিস্থাপন করতে পারে, তাহলে এটি তার বিশ্বের সবচেয়ে অপরিহার্য অর্থনৈতিক শক্তির মর্যাদা আরও শক্তিশালী করবে।
উভয় নকশা এবং পরিস্থিতির দ্বারা, চীন এবং রাশিয়া মার্কিন অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে প্রতিস্থাপনযোগ্য করে তোলার জন্য একসাথে কাজ করছে। তারা বিকল্প বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্কের ওপর কৌশলগতভাবে তাদের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক মনোযোগ দিয়েছে যা পশ্চিমা নিয়ম-ভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিকল্প ।
চীন পশ্চিমের প্রতি প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক নির্ভরতা কমাতে তার স্বদেশীয় সক্ষমতা এবং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। রাশিয়াও একই পথে চলছে, যদিও ছোট পরিসরে। চীনের একা এটি করার ক্ষমতা রয়েছে, তবে রাশিয়ার মতো একটি বড় শক্তি এর সাথে একযোগে কাজ করলে, একটি বহুমুখী বিশ্বে নেতৃত্বের দাবিতে বেইজিং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় চীন এবং রাশিয়া প্রত্যেকেই দুর্বল ভূমিকা পালন করছে, তবে নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা – বিশেষ করে এর অর্থনৈতিক মাত্রাগুলিকে খণ্ডিত করার যৌথ কৌশল পুতিন এবং শির জন্য ভাল কাজ করছে।
যদিও চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে ভূ-অর্থনৈতিক সারিবদ্ধতা স্পষ্ট, এটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি এবং বাধার মুখোমুখি হয়। সম্প্রতি ল্যাভরভ যখন শির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে, মার্কিন স্যাংশনের হুমকির কারণে সম্ভবত কয়েকটি চীনা ব্যাংক চীনা ইলেকট্রনিক উপাদানের জন্য রাশিয়ার অর্থ প্রদান ব্লক করেছে। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল নাকি চীনা কৌশলবিদদের দ্বারা একটি কাঠামোগত সমন্বয় ছিল তা দেখার বিষয়।
বাস্তববাদী এবং স্বার্থকেন্দ্রিক, চীন এবং রাশিয়া উভয়ই বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সংযোগগুলিকে তাদের টিকে থাকা এবং সামর্থ্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখে। যুদ্ধ এবং শান্তিতে, তাদের অংশীদারিত্ব যতই ভঙ্গুর এবং অসমান মনে হোক না কেন, রাশিয়া এবং চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূ-অর্থনৈতিক খেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আরও উল্লেখযোগ্য হতে চলেছে।
লেখক এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো এবং ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর চায়না অ্যানালাইসিসের অধীনে চীন-রাশিয়া প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা।
Leave a Reply