বাংলাদেশে সুন্দরবনের গভীরে লাগা আগুন নেভাতে পুরো এলাকা ঘিরে ফায়ার লাইন করে অর্থাৎ আগুনের চারপাশের এলাকায় গাছপালা এবং মাটিতে নালা কেটে পানি ছেড়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়েছে।
শনিবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন সুন্দরবনের আগুন লেগে যায়।
রবিবার সকালে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়, এখন সেখানে দমকল বাহিনী, নৌবাহিনীর ফায়ার ফাইটিং টিম এবং কোস্টগার্ড কাজ করছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মোড়েলগঞ্জ ও মোংলাসহ চারটি উপজেলার দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর মোঃ কায়মুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “রবিবার সকাল নাগাদ গভীর বনের প্রায় আড়াই কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে আগুন যে এলাকায় লেগেছে সেটি ঘিরে ফেলা সম্ভব হয়েছে। আশা করি দ্রুতই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।”
বেলা ১০টার দিকে গভীর বন থেকে আবার লোকালয়ের দিকে মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসার পর বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেন তিনি।
“আমি ঘটনাস্থলেই আছি। আমরা সুন্দরবনের আড়াই কিলোমিটার ভেতরে কাজ করছি। তবে নেভাতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আশা করছি আগুন আর বাড়বে না,” বলছিলেন তিনি।
এ তথ্য নিশ্চিত করে মোড়েলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম তারেক সুলতান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, একটি পয়েন্টে আগুন নেভানো হয়েছে আর আড়াই কিলোমিটার ব্যপ্তি নিয়ে যে আগুন সেটি ফায়ার লাইন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
“আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পুরোদমে কাজ চলছে,” বলছিলেন মি. সুলতান।
মূলত নৌবাহিনীর ফায়ার ফাইটিং টিম, কোস্টগার্ড ছাড়াও স্থানীয়দের সাথে মিলে আগুন নেভানোর কাজটি করছে ফায়ার সার্ভিস। বেলা বারটার পর বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকেও পানি ছিটাতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
সুন্দরবনের যেখানে আগুন লেগেছে সেটি পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া বন হিসেবেই স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। এটি লোকালয় থেকে অন্তত চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে এবং সেখানে আশেপাশে কোন খাল বা জলাধার নেই।
এদিকে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেবকে প্রধান করে সুন্দরবনের আগুনের ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে বন বিভাগ।
মোঃ কায়মুজ্জামান বলছেন আগুন সুনির্দিষ্ট এক জায়গায় জ্বলছে না, বরং খণ্ড খণ্ড আকারে বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলছে বিরাট এলাকা জুড়ে।
“আমরা যে অঞ্চলটিতে আগুন জ্বলছে সেটি পুরোটা ঘিরে কাজ শুরু করেছি। অনেক দূর থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ চলছে। এখন আর এই আগুন বাড়বে না বলেই আমরা আশা করছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে আগুন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকাতে পুরোপুরি নেভাতে বেশ সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আগুনের পুরো এলাকা ঘিরে কর্ডন লাইন করে পানি ছেড়ে দেয়ায় আগুন ওই লাইনের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগুন নেভানোর ওই দলের সাথেই ঘটনাস্থলে আছেন বেসরকারি একটি টেলিভিশনের স্থানীয় সাংবাদিক মোঃ ইয়ামিন আলী।
মি. আলী বিবিসিকে জানিয়েছেন, সকাল থেকেই ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও স্থানীয়রা মিলে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে।
“আমি দেখছি যে অন্তত অর্ধ শতাধিক জায়গায় আগুন জ্বলছে। আবার আগুন কমলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ধোয়ার কুণ্ডলী দেখতে পাচ্ছি অনেক জায়গায়,” বলছিলেন তিনি।
ধারণা করা হচ্ছে যে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকায় ৪০-৫০টি জায়গায় আগুন জ্বলছিল। যেসব জায়গায় শুকনো পাতা বা গুল্ম বেশি সেখানেই আগুন জ্বলেছে।
ইয়ামিন আলী বলছেন, “ধরেন একজায়গায় গুল্ম চলছে। আবার ৫০ মিটার দূরে আরেক জায়গায় জ্বলছে। এমন করে বিশাল এলাকা জুড়ে ছোট আকারে আগুন বা ধোঁয়া এখনো দেখা যাচ্ছে”।
মোড়েলগঞ্জের জিওধরা এলাকার আমুরবুনিয়া গ্রামের পাশেই ভোলা নদী। সেই নদী পার হলেই সুন্দরবনের ওই অংশের শুরু। সেখান থেকেই আগুনের দূরত্ব কমপক্ষে আড়াই কিলোমিটার ভেতরে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তারা কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন সুন্দরবনের এতো ভেতরে কীভাবে আগুন লাগলো সে সম্পর্কে তারা এখনো নিশ্চিত নন।
তবে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো এ সময়ে সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় পাতা ও গুল্মের স্তূপ তৈরি হয়।
কোন কারণে তার একটিতে আগুন লেগে হয়তো ধীরে ধীরে আশেপাশে ছড়িয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। তবে এর বাইরে গত এক দশকে অনেকবারই এ ধরণের অগ্নিকাণ্ডের পর জীবিকার তাগিদে বনের ভেতরে ঢোকেন এমন ব্যক্তিদের ধূমপানের প্রবণতা কিংবা মৌমাছি তাড়াতে মশালের ব্যবহারের কথাও অনেকে বলে থাকেন।
তবে স্থানীয় বন কর্মকর্তারা এখনই এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজী হননি। এমনকি আগুনের সূত্রপাত কখন হয়েছে সেটি সম্পর্কেও এখনো কেউ নিশ্চিত নন।
সাংবাদিক ইয়ামিন আলী বলছেন লোকালয় থেকে বনের ভেতরে অন্তত ৪-৫ কিলোমিটার দূরের এই আগুন নজরে আসতে সময় লাগাটাই স্বাভাবিক।
শনিবার বেলা এগারটার দিকে স্থানীয় লোকজন বনের ভেতরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে বন বিভাগকে খবর দেন।
যে এলাকায় আগুন লেগেছে তার থেকে বন বিভাগের কার্যালয় অনেক দূরে। আর গভীর বন হওয়াতে ওই এলাকায় মানুষের উপস্থিতি খুবই কম।
রবিবার সকাল নাগাদ আগুন নেভানোর কাজ সরাসরি ঘটনাস্থলে শুরু হলেও এর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে শনিবার থেকেই। বিকেলেই ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেয় ফায়ার সার্ভিসের দল।
কিন্তু রাতের অন্ধকার আর সুন্দরবনের ওই এলাকায় বন্যপ্রাণীর ঝুঁকির কারণে রাতে কাজ শুরু করতে পারেনি তারা। এছাড়া ওই এলাকায় কাছাকাছি খাল বা নদী না থাকায় পানিও নিতে হয়েছে বেশ দূর থেকে।
আবার রাতেই ফায়ার লাইন কেটে পানি ছাড়ার কাজ শুরু না হওয়া রাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশংকা অনেকের মধ্যে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি বলেই জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
মোড়েলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম তারেক সুলতান জানিয়েছেন আড়াই কিলোমিটার দুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে।
তবে সকালের জোয়ারের কারণে এখন পানির প্রবাহ ভালো থাকায় কাজটা কিছুটা সহজ হয়েছে।
“ভাটার সময় হয়তো একটু ঝামেলা হবে। তবে যেভাবে ফায়ার লাইন কর্ডন করে পানি দেয়ার কাজ চলছে তাতে আশা করি দ্রুতই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে অন্তত ২৪ বার সুন্দরবনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের আগুন নেভাতে দুই দিনের বেশী সময় লেগেছিলো।
এসব আগুনের পেছনে বন ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা, বন সংলগ্ন নদ-নদী মরে যাওয়া, অসচেতনতা, নাশকতা, ফেলে দেয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুনকে দায়ী করা হয়।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply