এবছরের স্বাস্থ্য শিবিরে যত জনকে সিলিকোসিস রোগী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রায় দেড় দশক আগের স্বাস্থ্য শিবিরেও সন্দেহজনক সিলিকোসিস রোগীর সংখ্যাটাও অনেকটা একই ছিল।
যে ‘খড়ি কোম্পানি’-র কথা বলছিলেন মি. কামালুদ্দিন, সেই খড়ি মাটির কারখানা বীরভূমের মুহম্মদবাজারে বেশ অনেকগুলিই চোখে পড়েছে আমাদের। মি. কামালুদ্দিন যে এলাকায় থাকেন, সেই প্যাটেলনগরেও নজরে এসেছে খড়ি মাটির আর ‘রিফ্র্যাক্টরি’ কারখানা।
খড়ি মাটি দিয়ে যেমন দারুণ সুন্দর আলপনা দেওয়া হয়, তেমনই ইস্পাত বা বিভিন্ন কারখানার ব্লাস্ট ফার্নেসে ব্যবহৃত ‘ফায়ার ব্রিক’ তৈরিতে এবং, ব্যাপকভাবে চিনামাটির নানা জিনিস তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়।
শেখ কামালুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর মনে হচ্ছিল ওই ‘চিনামাটি’র কাপেই তো চা খাই আমরা! ওই খড়ি মাটি দিয়েই তো আলপনা দেওয়া হয়, আর সেই মাটির যোগান দিতে গিয়েই ফুসফুসের এই দুরারোগ্য রোগ বাঁধল তার!
তিনি বলছিলেন, নাক মুখ ঢাকার জন্য তো মাস্ক বা অন্যকোনও আবরণ থাকত না, তাই মুখে গামছা বেঁধেই তিনি প্রায় ৩৫ বছর কাজ করেছেন ওই ‘খড়ি কারখানা’-তে।
“মুখে কিছু দিত না তো, ওই গামছা বাঁধতাম। গামছা বেঁধে কাজ করতাম। শ্বাসকষ্ট হইলে তখন ওই ডাক্তার দেখাইতাম, ওষুধপত্র খাইলে কমে যেত। তিন-চারজন যারা ওইখানে কাজ করত, তারা মারা গেছে,” একটু হাঁপাতে হাঁপাতেই কথাগুলো বলছিলেন মি. কামালুদ্দিন।
মুহম্মদবাজার এলাকার পাথর খনি আর ক্রাশার এলাকাগুলোতে কোথাওই চোখে পড়েনি যে কারও মুখে কোনও আবরণ আছে। শ্রমিক হোন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া গ্রামের নারী-পুরুষ অথবা স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ির পথ ধরা ছেলে-মেয়েরা বা একটা বিয়ে বাড়িতে আসা অভ্যাগতদের কাউকেই দেখলাম না মাস্ক অথবা অন্য কোনও ধরনের মুখ-আবরণী ব্যবহার করতে।
গাছের পাতা ঢেকে থাকে ধুলোয়
বিপদে পরিবেশ
হাবড়াপাহাড়ী গ্রামের সমাজকর্মী সাদি হাঁসদা বলছিলেন এমন অনেক এলাকা আছে, যেখানে খোলা জিনিসপত্র রাখলেই সেসব পাথরের ধুলোয় ঢেকে যায়।
“হরিণসিং-এ, আর ওই কেতপাহাড়ি, এখানে পাথরচাল, নতুনপাড়া- ওইগুলোতে এরকম থালা বাসন বাটি রাখলে পুরো ধুলোয় ভর্তি হয়ে যায়। কাপড়চোপড়ও রাখা যায় না।”
সেটি আমরাও বিলক্ষণ টের পাচ্ছিলাম। গাড়ির জানালার কাঁচ নামানোই যাচ্ছিল না। যখন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গাড়ি থেকে নামছিলাম তখন দেখছিলাম, ওই রাস্তায় চলতে চলতে আমাদের গাড়ির ওপরেও মোটা ধুলোর আস্তরণ পড়েছে।
মনে হচ্ছিল আমরা তো এসেছি দুদিনের জন্য, আর যারা এই পরিবেশে সারা বছর থাকেন, বছরের পর বছর থাকেন, তাদের তাহলে কী অবস্থা হতে পারে!
“এই জন্যই এটাকে শুধুমাত্র পেশা-জনিত রোগ, অর্থাৎ যারা পাথর খাদানে কাজ করে, তাদের সমস্যা বললে হবে না। এটা এনভায়রনমেন্টাল হ্যাজার্ড,” বলছিলেন সমাজকর্মী কুনাল দেব।
তিনি প্রায় আড়াই দশক ধরে এই অঞ্চলে সামাজিক কাজ করেন এবং ‘উথনাও’ সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক।
তার কথায়, “গোটা অঞ্চলে যেভাবে ধুলো উড়ছে, যেভাবে ট্রাকগুলো যায়– ওভারলোডেড ট্রাক চলে, তার ফলে যে ধরনের মেটাল রোড তৈরি হয় ইনিশিয়ালি, যে ছয়মাসের বেশি টেকে না, তার ফলে আরও বেশি ধুলো ওড়ে। জল যেভাবে দেওয়ার কথা, সেটা দেওয়া হয় না, খুবই অনিয়মিত। তার ফলে ২৪ ঘণ্টাই ওখানে রাস্তা থেকে ধুলো ওড়ে। রাস্তার পাশে যেসব বাড়িঘর থাকে – সাঁওতাল গ্রামগুলোতে, তারা কিন্তু ওই ধুলোটা খায়।”
মি. দেবই বলছিলেন যে কয়েকশো পাথর খনি আর ক্রাশারের বেশিরভাগটাই চলে বেআইনিভাবে।
কিছু খনি আর ক্রাশারের লাইসেন্স থাকলেও বেশিরভাগই বেআইনি
বেআইনি খনি আর ক্রাশার
শুধু মুহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাচামী অঞ্চলেই প্রায় ছয়শোটি পাথর খনি আর ক্রাশার চলে। লাগোয়া এলাকা শালভদ্রায় রয়েছে আরও প্রায় আড়াইশোটি খনি।
পাথর খনি শিল্পের সূত্রগুলো জানিয়েছে এর মধ্যে দেউচার ১৫২টি আর শালভদ্রার গোটা ১২ খনির আইনি অনুমতি আছে। বাকি সবগুলোই চলে বেআইনিভাবে।
আবার পুরো বীরভূম জেলায় বেআইনি পাথর খনির সংখ্যা হাজারেরও বেশি, বৈধ খনি দুশোরও কম।
তবে প্রশাসন অবশ্য স্বীকারই করে না যে বীরভূমে কোনও অবৈধ খনি আছে।
বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ বলছিলেন, “এখানে পাথর ব্যবসা আছে। পাথর ব্যবসা থাকার প্রয়োজন আছে, নাহলে ডেভেলপমেন্টের কাজ হবে না। রাস্তা থেকে, ড্রেন থেকে নির্মাণ, কিছুই হবে না, উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে। তবে আমাদের কাছে অবৈধ পাথর খাদানের কোনও খবর নেই। বৈধ খাদান যতগুলো আছে, ততগুলোই চলছে। অবৈধ খাদান আমরা চলতে দেব না প্রশাসনিকভাবে আর চলবেও না বীরভূম জেলাতে।”
জেলা প্রশাসন স্বীকার না করলেও কয়েক বছর আগেই এই অঞ্চলের বহু পাথর খনি যে অবৈধ, তা ঘোষণা করে সেগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।
আবার এই পাথর খনি থেকে নির্গত মিহি পাথর-গুঁড়া যে মানুষের শরীরে রোগ বাধাচ্ছে, তা নিয়ে সরব হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।
তা সত্ত্বেও কীভাবে চলে এই অবৈধ খনিগুলি?
একজন লাইসেন্স-প্রাপ্ত খনি মালিক এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে, তবে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এত বড় বেআইনি ব্যবসাটা চলে কীভাবে?
তার কথায়, “এটা আমাদের যে রাজ্য সরকার আছে, তাদের কিছু প্রভাবশালী নেতাদের পারমিশনে চলে। রাজ্য সরকারের কয়েকটি দপ্তরের সঙ্গে যোগসাজশে চলছে এগুলো।
“সরকার পায় ২৫% অর্থ আর ৭৫% যায় প্রভাবশালী নেতাদের কাছে এবং যে ব্যক্তির নামে টেন্ডার করা হচ্ছে, তার কাছে। প্রতিটা দপ্তরেই টাকা যায় – রাজ্য সরকারের হোক বা কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তর,” বলছিলেন ওই খনি মালিক।
হুইসল ব্লোয়ারের মুখোমুখি বিবিসি
দূষণ থেকে মুক্তি কীভাবে?
পাথর গুঁড়ার দূষণ থেকে বাঁচার উপায় খুবই সহজলভ্য, বলছেন, বিশেষজ্ঞরা।
পেশা-জনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কুনাল দত্তের কথায়, “সেফ প্র্যাকটিস আছে। যে কোনও জায়গায় ডাস্ট এমিশন প্রিভেন্ট করার জন্য হয় এনক্লোজড লোকাল এক্সহস্ট ভেন্টিলেশন পদ্ধতিতে বড় পাখা দিয়ে টেনে নেওয়া হবে ধুলোটাকে। অথবা ড্রাই প্রসেসের বদলে ময়েস্ট প্রসেস – স্প্রিঙ্কলার লাগিয়ে জল ছেটানো হবে।
“খুব সহজ পদ্ধতি, এগুলো টেকনোলজিকালি বিরাট কিছু রকেট সায়েন্স নয়। কিন্তু এগুলো করা হবে না। কারণ বেআইনিভাবে যেখানে এই জিনিস চলতে পারে, মানুষের জীবন নেওয়ার মতো ঘটনা চলতে পারে, সেখানে এই ছোট ছোট জিনিস করতে গেলে তাদের খরচ বাড়বে। ফলে প্রফিট কমে যাবে, তাই করবে না,” বলছিলেন মি. দত্ত।
তবে সরকার এই অঞ্চল নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে দেউচা পাচামীর মানুষ হয়তো ভবিষ্যতে পাথর-গুঁড়ার দূষণ থেকে রক্ষা পাবেন, কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে অন্য এক দূষণের কবলে পড়ার।
এই দেউচা-পাচামী অঞ্চলে পাথরের স্তরের নিচে পাওয়া গেছে ভারতের সব থেকে বড় কয়লা ভাণ্ডার।
গোটা এলাকা জুড়ে কয়লা খনি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে এখন।
তাই পাথর গুঁড়ার দূষণ থেকে রক্ষা পেলেও ভবিষ্যতে হয়তো এখানকার মানুষকে সহ্য করতে হবে কয়লা গুঁড়ার দূষণ।
এই দেউচা-পাচামীতেই পাওয়া গেছে ভারতের সব থেকে বড় কয়লা ভাণ্ডার
বিবিসি নিউজ বাংলা, বীরভূম থেকে ফিরে
Leave a Reply