মণীশ রায়
লিটুভাই সম্পর্কে কী আর বলবো ?
এদেশের যারা সচেতন মানুষ, সচেতন বলতে অজ্ঞান-ইগনোরেন্ট নন এমন নগরবাসী, সামান্য খোঁজখবর রাখেন চারপাশের, মাঝে মাঝে মর্জি হলে বইর পাতা উল্টে-পাল্টে দেখেন এবং নিজেদের উদার ভেবে রীতিমতো সুখ খোঁজেন যেখানে-সেখানে, এরা সবাই একবাক্যে চেনেন তাঁকে।
চিনবেই বা না কেন? এমন প্রাণ-জুড়ানো হাসিমুখ আর যখন-তখন পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর তুবড়ি ছুটানো কথা বলে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পারা কি সহজ কাজ? বললেই হলো?
লিটুভাই ছিলেন এ নগরের এক বিরল পুরুষ। এখানে সব উদার মানুষেরা যখন গা বাঁচিয়ে এবং এবং মিহি মৃদু স্বরে নিজেদের প্রকাশ করতে নিত্য অভ্যস্ত , সেখানে লিটুভাই হৈ হৈ করে মুখের উপর যা বিশ^াস করতেন তা-ই বলে ফেলতেন আনয়াসে। কোন রাখঢাক ছিল না কথায়। যখন খুশি সত্যি কথাটা অবলীলায় বলে দিতেন। এজন্য বেশ কবার অপদস্থও হতে হয়েছে তাঁকে। নিজের হাতে গড়া আর্ট এন্ড ডিজাইন নামের আর্কিটেকচারেল ইনিস্টিটিউটটির উপর নেমে এসেছিল অদৃশ্য খড়গ। যারা এ সমাজে খড়গ হাতে ঘুরে বেড়ায় তাদের একটাই আব্দার ছিল তাঁর কাছে, এসব কথা আমাদের অফিসে এসে সবার অলক্ষ্যে ফিসফিস করে বলে গেলেই তো হয়। প্রকাশ্যে কেন ? আমরা তাতে বেপর্দা হয়ে পড়ি না ? মাথায় এতো চাপ , আরো চাপ দিচ্ছেন কেন ভইসাব ?
লিটুভাই তাদের কথা রাখেননি ; কিছুতেই তাঁর মুখ বন্ধ করা যায়নি। তিনি মুখের উপর বলে দিতেন, ঢাকাকে বাঁচাতে চান ? আর একটিও বিল্ডিং করবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিন। যদি বিল্ডিং করার এতোই খায়েস জন্মায়, উপচে পড়া অর্থ-সম্পদ যদি খোসপাঁচড়ার মতো চুলকাতে শুরু করে তো এক কাজ করুন। বিল্ডিংটির চারপাশে জায়গা রেখে সেখানে বসবাসকারী সবার নামে একটি করে দিশি গাছ লাগিয়ে নিন। সবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করে দিন নিয়মটি। প্রথমে খানিকটা বেখাপ্পা হয়তো লাগবে। এর বিরুদ্ধে লম্ফ-ঝম্ফও হবে। কিন্তু একসময় দেখবেন এটি বিল্ডিংওলাদের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
অন্য এক সেমিনারে হয়তো বলে উঠলেন , এতো গাড়ি চড়ে কি হবে নগরবাসীর ? ডাক্তারদের পিছনে তো কম টাকা ঢালছেন না। তা না দিয়ে গাড়ির ব্যবহার সীমিত করুন। পায়ে হেঁটে পথ চলতে শিখুন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে উঠে এসেছেন , বেশিদিন তো হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি পায়ের ব্যবহার ভুলে গেলেন ?
খোশমেজাজে থাকলে লিটুভাই বলতেন , হাতির ঝিলের মতো আরো ঝিল বানান। বুড়িগঙ্গাকে এর তারুণ্যে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তা নিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখুন। গাছে-গাছে ছেয়ে ফেলুন রাস্তাঘাট আর খালি জায়গা। বাগিচায়-বাগিচায় ভরিয়ে দিন এ শহর। বুলবুলিদের গান ধরতে দিন। জলাশয়গুলোকে বাঁচিয়ে তুলে নৌকা-বাইচের আয়োজন করুন। রাজধানির জনসংখ্যায় লাগাম টানুন। দেখবেন, বিদেশীরা দলে দলে ঢাকা দেখতে চাইবে। ঝিলের পাশে বসে বান্ধবীর গলা জড়িয়ে বলে উঠবে , অতগুলো নদী একটা শহরে? ভাবা যায় ? সুজন মাঝিকে দেখতে পাবেন বালুনদীর তীরে নৌকার পাটাতনে পা ছড়িয়ে বসে বাঁশিতে সুর ভাজছে, মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না। আমার-আপনার সেই পুরাতন মন আবার কথা কইবে !
তারপরই তিনি বলে উঠতেন , আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে ইঞ্জিনচালিত সব নৌকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিতাম। আবার ফিরিয়ে আনতাম জারিসারি আর ভাটিয়ালির সুর। বাঙলার রূপ-সৌন্দর্যের তো অনেকখানি পড়ে রয়েছে নদী নালা খালবিল আর ঝিলের জলে। সেসব ফিরিয়ে আনতে পারলে ঠিকই দেখবেন, এ নগরে হারানো পাখিরা আবার ফিরে এসেছে। নদী-ঝিলের পাড়ে ঘন ঝোপজঙ্গল বাড়বে। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস নেবে সারাক্ষণ। তাপদাহ-দাবদাহ যতই বাড়–ক, দেখবেন , পুরনো দিনের মতো মানুষের সহ্যক্ষমতাও সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। এসির জন্য শুধু শুধু মন খারাপ হবে না। এ গাছ-পাখি-লতাপাতা মনে শান্তিও বয়ে আনে। আর অন্তরে প্রশান্তি থাকলে হিংসা হানাহানি কমবে। অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেও আর ইচ্ছে হবে না। সত্যি বলছি।
এই তা আমাদের লিটু ভাই , তাঁর সম্পর্কে নতুন কী আর বলবো ?
তিনি নিঃস্বার্থ কিংবা মহৎপ্রাণ ছিলেন কিনা জানা নেই আমার। জানতেও চাই না। নিদারূণ এসময়ে বেঁচে-বর্তে থাকতে হলে মোটেই মহৎ হবার প্রয়োজন নেই। একটুখানি মানবিক হলেই হয়। কারো সম্পর্কে অর্থহীন বড়বড় বিশেষণ খামোকা ব্যবহার করার বাই আমার নেই। এগুলো ছ্যুৎমার্গ ছাড়া আর কি ? আপনি কতোটুকু নিষ্ঠুর আর কতটুকু মানবিক সেটা আপনার চেয়ে আর কে ভালো যাচাই করতে পারবে ? লিটুভাইর ভেতর ছিলো পঁচিশভাগ মানবিক এক মানুষ , তাতেই আমি গদগদ, খুশিতে একেবারে অত্মহারা। কারণ আমার নিজের ভেতরও এটুকু নেই !
তবে একথাও সত্য যে এমন অমায়িক সজ্জন মানুষ আজকাল আর পাওয়া যায় না। একেবারেই ব্যতিক্রম চরিত্রের এক মানুষ বলে মনে হয়েছে তাঁকে। নইলে সারাজীবন এত বকবকানি করে গেলেন , এতো গালমন্দ করলেন আমাদের কই , আমরা কি তাঁর কথা কখনও শুনেছি নাকি শুনবো কোনদিন ? আমরা তাঁর কথা শুনি না, সেটা তিনি ভালোই বুঝতেন। তবু নিরলসভাবে বকে যেতেন। এমন নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য মাঝে মাঝে বড় মায়া হয়।
লিটুভাই পেশায় ছিলেন একজন আর্কিটেক্ট। বাউলদের মতন লম্বা চুল। ডাগর চোখ। ফর্সা গায়ের রঙ। স্যুটেড-বুটেড থাকতে পছন্দ করতেন। বয়সে আমার চেয়ে বিশ বছরের বড়। আমি পেশায় ডাক্তার , তাও মনের। কোন মিল থাকার কথা নয় দুজনার।
তবু আমি তাঁর ফ্যান ছিলাম। তাঁর প্রতিটি টকশো-সেমিনারের আমি ছিলাম নিষ্ঠ এক দর্শকশ্রোতা। তিনি যখন গালমন্দ করতেন সমাজের ক্ষয়রোগ নিয়ে, তখন অন্য সবার মতন আমিও খুব উপভোগ করতাম। দুদিন বাদে বেমালুম ভুলে যেতাম , স্যার কী বলেছিলেন। সম্ভবত এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
লিটুভাইর মুখ থেকেই প্রথম শুনলাম গুলশানের সতেরো নম্বর বাড়িটার কথা। পাখপাখালি, গাছগাছালি ঘেরা কয়েক বিঘার একটা বিশাল বাড়ি নাকি ছিল সত্তরের দশকে। যে কেউ যে কোন সময় ঢুকে যেতে পারতো বাড়ির ভেতর। খানিকটা ভুতুড়ে ; বাড়ির মালিক কে তাও জানা ছিল না কারো। বাড়িটার শেষমাথায়, যেখানে একটা গোয়ালঘর আর গোময়ের ঢিবি রয়েছে, হয়তো সেখানেই টালি দেয়া দুখানা ঘর নিয়ে থাকতেন মালিক স্বয়ং। তবে সতেরো নম্বর বাড়িটার বেলায় বাড়িওলার ভূমিকা ছিল একেবারেই গৌণ। বাড়িটাই মুখ্য, বাড়িওলা নয়।
লোকজন বাড়ির ভেতর ঢুকে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে বেরিয়ে আসতো বাইরে। গরমকালে একটুখানি শীতল হতে সেখানে চলে যেতো লোকজন। কেউ নারিন্দা থেকে , কেউ আজিমপুর থেকে , কেউ বা সূত্রাপুর-ফরিদাবাদ-যাত্রাবাড়ি থেকে। সবাই দলে বলে পায়ে হেঁটে শুধুমাত্র এ বাড়িটা দেখার জন্য ছুটে আসত। লেকের পাড়ের বাড়ি। সবার জন্য মুক্ত। ক্ষ্যাপাটে কোন কুকুর নেই। কিম্ভূতদর্শন কর্কশভাষী কোন দারোয়ানের জিজ্ঞাসাবাদ নেই। যখন মন চায় ভেতরে ঢুকে পড়, আবার বেরোও যখন বেরাবার ইচ্ছে জাগে। শুধু সন্ধ্যার পর বাড়িটা বেশিরকম নিরিবিলি হয়ে গেলে কেউ আর থাকার সাহস করতো না । নানারকম পশুপাখির শব্দের ভেতর বাড়িটা মুখ গুঁজে থাকতো বলে কেউ সন্ধ্যার পর এক সেকেন্ডও থাকতে চাইতো না সেখানে।
সতেরো নম্বর বাড়িটা ছিল লিটুভাইর প্রিয় এক স্থান। যখনই ঢাকা নিয়ে কথা বলতেন তখন এ বাড়িটার উদাহরণ টানতেন। কত রকমের পাখি এসে আশ্রয় নিতো সেখানে। দোয়েল শ্যামা টিয়া শালিক চড়ুই। পাখিরা প্রচুর খাবার পেতো আর আনন্দে গান গাইতো। মাটির উপর পড়ে থাকতো পাকা আতাফল, পেয়ারা, বড়ই। কীট-পতঙ্গ তো রয়েছেই। ওরা কখনও গাছে চড়ে, কখনও বা মাটিতে নেচেনেচে খাদ্য সংগ্রহ করতো। মানুষ কিংবা কুকুর-বিড়াল-বেজির আানাগোনা ছিল। ওদের সন্দেহজনক চলাফেরা বেড়ে গেলে পাখিরা চড়ে বসতো গাছের মগডালে। নইলে সারাদিন মাটিতেই ঘুরে বেড়াতো। অনেকগুলো কাঠবিড়ালির ছুটাছুটি ছিল গাছে গাছে। ওদের আধা খাওয়া ফলগুলো অনাদরে মাটিতে পড়ে থাকতো।
পাশের লেক থেকে বয়ে আসতো দমকা হাওয়া। সে হাওয়ায় নানাজাতের ফুল-ফলের সুগন্ধী ভেসে বেড়াতো। এরকম বাড়ি শুধু একটা কেন , ঢাকা শহর জুড়ে ছিল অনেকগুলো। বাড়ি মানেই মানুষের থাকা নয় , প্রকৃতিরও একটা হিস্যা ছিলো সেখানে। সেই বাড়িগুলো এখন কোথায় ? চার-চারটা বড় নদী, খালবিল আর ঝিলের শহর ঢাকা এখন পৃথিবীর সেরা বায়ু দূষণের শহর Ñ বসবাসের অযোগ্য বলে অনেকে নাক সিঁটকান। খুব বাজতো লিটু স্যারের বুকে। চোখ ছলছল করতো কখনও। তিনি অপরাধবোধে ভুগতেন। নিজেকে দূষণকারীদের একজন হিসাবেই তিনি ভাবতেন। কেননা তাঁর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। সব বুঝতে পারার পরও একজন ব্যর্থ অপারগ মানুষ ছাড়া তিনি আর কি ?
তাঁর এসব আহাজারি শুনে , সত্যি বলছি , আমিও কেমন এক শূন্যতা বোধ করতাম নিজের ভেতর। সেখান থেকেই আমি হয়ে গেলাম লিটু স্যারের ফ্যান। প্রতিটি সভা-সেমিনারে গিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারতাম , লিটুভাইকে সবাই সম্মান করেন, তাঁর কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধরে শোনেন, বাহবা আর হাততালি দিয়ে উৎসাহ যোগান। কিন্তু তাঁর কথার কোন প্রতিফলন নেই এ শহরে। মনে হতো ডা. লুৎফর রহমানের ‘উন্নত জীবন’-এর মতন তিনিও এসব বলে বলে ভালো একখানা বই হয়ে গেছেন আমাদের জীবনে। বইটির নাম ‘বসবাসের উপযোগী এ ঢাকা ঃ নগরবাসীর দায়িত্ব ও কর্তব্য’। কথায় কথায় সবাই বইটির নাম উল্লেখ করেন । কিন্তু কেউ আর সেটি চোখের সামনে মেলে ধরেন না , মেনেও চলতে রাজি নন। না প্রশাসন, না নাগরিকগণ!
যাহোক, আবার ফিরে যাই সেই সতেরো নম্বরে। স্যারের একটি খেদোক্তি অনেকেই শুনেছেন। এ বাড়ির মালিক কে তিনি কখনও জানতে পারেন নি। প্রথমদিকে মালিক নিয়ে অত মাথাব্যথাও ছিল না তাঁর। কিন্তু যত বয়স বেড়েছে স্যারের, যত এ নগর নষ্ট ও মলিন হয়েছে , যত এ নগরের মানুষজনের লোভ বেড়েছে , যতো মূক-বধির ও অন্ধ হয়েছে এ নগরবাসী, ততো সতেরো নম্বর বাড়ির মালিকের প্রতি লিটু স্যারের দরদ বেড়েছে , ততো লোকটির জন্য অনুদঘাটিত রহস্যের মতো কৌত‚হল জন্মেছে তাঁর মনে। হয়তো কল্পনাও মিশেছে খানিকটা।
প্রথম প্রথম মনে হয়েছে, এ নিয়ে হেঁয়ালি করছেন বিশিষ্ট প্রকৃতি-প্রেমিক আখতারুজ্জামান লিটু । বাড়ির মালিক কে , এটা জানা তো সবচেয়ে সহজ একটা কাজ। এটা নিয়ে তিনি অত ন্যাকামো করছেন কেন ?
প্রশ্নটা স্যারকে করেও ফেলেছি বেশ কবার। প্রতিবারই একথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বাড়িটা নিয়ে বুঁদ হয়ে যেতেন। ফিরে যেতেন সেখানে।
বাড়িটার অভ্যন্তরে তিন-চারটে মধুমক্ষিকার চাক ছিল। যতবার সেখানে তিনি পা দিয়েছেন, ততবারই মধুমক্ষিকার চাকগুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকেছেন। কুকুর, বিড়াল, বেজি , পাতিকাক, দাঁড়কাক দেখে দেখে সময় কেটে গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একবার একটা লক্ষী প্যাঁচাকে দেখে পুরো দিন চলে গেলো। বাড়িওলার খবর নেবার সময় কোথায় হাতে? যখন মনে হলো, এবার অন্তত বাড়ির মালিকের খবর নেয়া যাক, তখনই তিনি দেখতে পেলেন , সতেরো নম্বরের শবদেহের উপর দু-দুটো ছ-তলা উঠতে চলেছে। পুরো গুলশান তখন কংক্রিটের সাজে সেজে উঠছে: নতুন বন্দোবস্ত, নতুন সব অর্থশালী মালিক আর নিত্য-নতুন কংক্রিটের কেমিক্যাল-মেকাপে ধোঁয়ায় ধোঁয়া এককালের গুলশান এলাকার নির্মল নীলাআকাশ। গাছ ফুলপাখি সব নিশ্চিহ্ন ! ফেন্স আর টব-সংস্কৃতি সেখানকার অভিজাতদের গিলে ফেলে।
অগত্যা , লিটু স্যার মালিকের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন।
শুধু আমার মাথার ভেতর রয়ে গেল অনুপম এক বাড়ির ছায়া। প্রায়ই মনে হতো সতেরো নম্বর বাড়ির মালিকের কথা। যাবো-যাবো ভাবি প্রায়াই। কিন্তু রোগীর চাপে গুলশানমুখো হতে পারি না। তাছাড়া , লিটু ভাইর সেই প্রকৃতি লগ্ন বাড়িটাই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন গিয়ে কি হবে ? রড-সিমেন্ট-কংক্রিটের নির্দয় নান্দনিকতা দেখবো বলে যাবো ? তাই শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি আমার।
আচানক ঘটনাটা তারপরই ঘটে গেলো। আমার চেম্বারে একজন অদ্ভুত কিসিমের বয়স্ক মানসিক রোগীকে নিয়ে এলো তার ছেলেমেয়েরা। মাথাভরা পক্ককেশ। সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি গায়। ভরাট মুখ। উজ্জ্বল শ্যামল গায়ের রঙ। আমার সামনে রোগীর চেয়ারে বসে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। মনে হলো তিনি ডুবে রয়েছেন অন্য কোথাও।
‘সমস্যা কি ?’
বড় মেয়ে গুলশান আরা উত্তর দিলেন,‘ পাখি। ’
অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি ,‘ মানে ?’
মেয়েটি এবার পুরো ঘটনাটা বলল আমায়। সব শুনে রীতিমতো অবাক আমি।
রোগীর নাম মনসুর সাহেব। এককালে জমির কেনাবেচা করতেন ঢাকায়। এখন অপ্রকৃতস্থ মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধ। মাথার ভেতর শুধুই হরেক রকম পাখির ওড়াওড়ি।
পাখিদের একটানা কিচিরমিচির আর কলকাকলিতে তিনি পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন। ফরফর করে দুটো সবুজ টিয়া এ গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যায়। স্পষ্ট দেখতে পান তিনি। একটা বড় ধনেশ লেকের ওপার থেকে উড়ে এসে তেঁতুল গাছে আশ্রয় নেয়। সকালবেলায় একসঙ্গে অনেকগুলো শালিক টিউ-টিউ করে গেল। চড়–ইগুলোর একটানা কিচির-মিচিরের যেন অন্ত নেই। দাঁড়কাকটা ঠোকর বসাচ্ছে গাছের নিচে পড়ে থাকা পঁচা-গলা একটা আতাফলে। কাঠঠোকরাটা সুপারিগাছে ঝুলে থেকে একনাগাড়ে কাঠমিস্ত্রীর মতো ঠোকর বসাচ্ছে গাছের গায়। কতগুলো চিল লেক আর বাড়িটার উপর অসীম আকাশে উড়োজাহাজের মতো চরকি কাটছে। কিছু একটা তাক করছে নাকি ? পোষা কবুতরগুলো বাক-বাকুম করে শস্যদানা খুঁটে নিচ্ছে মাটি থেকে।
প্রথমদিকে এসব নিয়ে কেবল বিড়বিড় করতেন মনসুর সাহেব । ধীরে ধীরে নিজেই এমন এক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে চুপচাপ আর ঘরে থাকতে পারতেন না। ছুটে যেতেন এদিক থেকে সেদিকে। নিজেকে পাখি ছাড়া যেন আর কিছুই ভাবতে পারেন না। চোখের সামনে শুধু পাখির ছায়া। ওড়ার অদম্য আকাক্সক্ষা নিয়ে ব্যালকনি কিংবা সিঁড়ি পেরিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে চাইতেন। সে এক ভয়ংকর অবস্থা। বেঁধে পর্যন্ত রাখা যায় না। শুধুই পাখি হয়ে আকাশ ছোঁবার অনন্ত আকাক্সক্ষা অন্তর জুড়ে!
সব শুনে কদিন কেসটা নিয়ে ভাবলাম। কোন কুল-কিনারা পাচ্ছি না। একসময় মনে হলো যেখানে পাখিদের অবাধ আনাগোনা সেখানে মানুষটাকে রেখে দিলে কেমন হয় ? হয়তো সেখানে মানুষটাকে রাখতে পারলে মানসিক প্রশান্তি ফিরে পেলে পেতেও পারেন। মনসুর সাহেবের ছেলেমেয়েরা সবাই সচ্ছল । তাঁদের আব্বাকে কয়েকমাস সিলেটের একটা প্রকৃতি ঘেঁষা রিসোর্টে রেখে দিলে কিছু যায়-আসবে না। পরামর্শটি দিয়ে আমি নিজেই দ্বিধান্বিত ছিলাম কদিন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেটি কাজে দিলো। মনসুর সাহেব নিজের ভেতর ফিরতে শুরু করলেন। একসময় অস্থিরতা হ্রাস পেলো। মনসুর সাহেব ঢাকার গুলশানের ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন।
কিন্তু কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই ফের পাখিদের জন্য আকুলতা বাড়তে থাকে তার। শরীরে কাঁপুনি দেখা দিল। উন্মাদের মতন ফ্ল্যাট জুড়ে ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। বেশ কবার মারাত্মক বিপদ হতে হতে কোনরকমে বেঁচে যায় মনসুর সাহেব । পরিবারের সবাই ভয় পেয়ে ফের আমার কাছে চলে এলো। কোন সিডেটিভ না দিয়ে ওদের বললাম,‘এ নগরে একটা জায়গা বের করেন তো , যেখানে পাখিরা সমবেত হয়, রাত্রিযাপন করে, কিচিরমিচির আর কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। আছে এরকম চেনা জায়গা ?’
ওদের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে পরক্ষণে মনে পড়ে গেল গুলশান মোড়ের কথা। ইদানীং সেখানে হাওর এলাকার বেশকটি করচগাছ ডালপালা মেলেছে। ঘন পাতায় ছাওয়া পক্ষীবন্ধু দিশি কটি গাছ ধীরে ধীরে সেখানে বেড়ে উঠছে। ত্রিভুজাকৃতি সিমেন্টের পাকা ঘেরের ভেতর গাছগুলো যেন হাত-পা ছড়িয়ে অসহায় আশ্রয়হীন পাখিদের আহবান করে চলেছে,‘আয়, আয়। এখানে শান্তি পাবি। আয় !’
বেশ তাজা প্রফুল্ল সব গাছের চেহারা, এখনও ধুলা-বালিতে মলিন হয়নি। পথচারীদের কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে জিরিয়ে নিতে পারে সেখানে। বেশ ছায়াময় স্থান। এরকম তিন-চারটি বেদি রয়েছে মোড়ে। সবগুলোই করচের পত্র-পল্লবে ছাওয়া। সকাল-সন্ধ্যায় এদিকটায় গেলে পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে পাওয়া যায়। ক্ষণিকের জন্যে বেশ লাগে। মনে হয় গ্রামে ফিরে গেছি। চারপাশের নাগরিক চপলতা আর উদ্দামতার সঙ্গে ঠিক মিলেনা। তবু পাখিগুলো যে একটুখানি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে এ নির্দয়-নিষ্ঠুর নগরে, তাই ভেবে প্রশান্তি জাগে মনে।
গুলশান আরাকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘ আপনাদের বাড়ি কোথায় ?’
প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন মহিলা। ঢাকার একটি নামজাদা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষয়িত্রী তিনি। উত্তর দিলেন,‘আপনি চিনেন নিশ্চয়ই। গুলশানের বিখ্যাত সতেরো নম্বর বাড়িটাই আমাদের। লিটু স্যার যে বাড়িটির কথা কখনও ভুলতে পারেন না , কথায় কথায় যে-বাড়িটার কথা উল্লেখ করতেন , সেই বাড়ির মালিক আমার আব্বা। এখন সেখানে তিনটি বিল্ডিং উঠে গেছে। গাছ-পাখি কিছুই নেই আর। ’
আমি চমকে উঠলাম। এরা সবাই সেই সতেরো নম্বর বাড়ির মালিক ? মনে হলো প্রশ্ন করি ,‘ এতদিন কোথায় ছিলেন ?’ পরক্ষণে অভিমান হলো। এর সঙ্গে মিশে রইল খানিকটা ক্ষোভ,‘ এরকম একটা বাড়ি ধ্বংস করে ফেললেন ?’ কিন্তু প্রশ্নটা আর করা হলো না। আমি যে ওদের ডাক্তার। অসহায় হয়ে ওরা এসেছে সমাধান খুঁজতে আমার কাছে। আমি কিভাবে তাদের অপরাধী বানাই ? তাছাড়া এরকম ধ্বংসযজ্ঞের হোতা তো আমরা সবাই। কাকে দোষ দিবো আলাদা করে?
‘ডাক্তার সাহেব, আব্বাকে নিয়ে কী করবো বলেন ? আম্মা বেঁচে থাকলে এ প্রশ্নটা তিনিই করতেন। এখন আমিই সবার গার্জিয়ান। ’ আকুতি ঝরে মেয়ের কণ্ঠ থেকে।
‘একটা কাজ করেন। ছুটির দিনে কিংবা সাতসকালে গুলশান মোড়ের গাছতলায় নিয়ে আপনার আব্বাকে বসিয়ে রাখতে পারেন। বেলা বাড়লে নাহয় পার্কে নিয়ে গেলেন । ’
আমার কথামতো ওরা সেভাবেই কাজ শুরু করে দেয় । তাতে খানিকটা থিতু হয় মনসুর সাহেবের মানসিক ভারসাম্য। একুটখানি হলেও পরিবারটির রেহাই মেলে এরকম ঝামেলা থেকে।
লিটু স্যারের সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা ও ¯েœহ-বিনমিয়ের গল্প , এর শুরুটা ঠিক এখান থেকেই। অর্থাৎ একথাটা লিটু স্যারকে জানিয়ে আমি প্রথম অনুভব করলাম , তাঁর চোখে আমি কিছু একটা হয়ে গেছি। কদিনেই আমি তাঁর আপনজনে পরিণত হলাম। ধীরে ধীরে তিনি আমার বাসায় আসতে শুরু করেন। আমার স্ত্রী-বাচ্চাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। আমরাও তার ইস্কাটনের বাসায় যেতে শুরু করলাম। স্যারের নাতিপুতিদের আপন করে নিলাম। যখন তখন তিনি আমায় টেলিফোন করেন। সেটা রাত দুটো আর ভোর চারটে হউক, কিছু যায় আসে না।
‘আচ্ছা কামাল , রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও বড় ইচ্ছে হয়, এদেশে একটা শান্তিনিকেতন করার। করা যায় না ? ’
‘কেন যাবে না স্যার ? চেইন হাসপাতাল কিংবা চেইন খাওয়ার দোকান হলে বিশ্বব্যাপী শান্তিনিকেতন কেন নয় স্যার? ’ আমি স্যারকে আশ্বস্ত করি । অবশ্য , বলার সময় নিজেকে কেমন খেলো বলে মনে হয়।
এবার তিনি হেসে উঠলেন হোঃ হোঃ করে। হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ কাশলেন, খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন , তারপর বলে উঠলেন ,‘ না রে পাগল , আমি করলে সেটা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন হবে না। হবে লিটু-নিকেতন । লোকজন আড়ালে বলে বেড়াবে লিটুর বাগানবাড়ি। হাহাহা।’
এ নগরে কাউকে নিজের সম্পর্কে অতটা নিরাসক্ত-নির্মোহ হতে আমি কমই দেখেছি। খাই-খাই চাই-চাই-র সমাজ-সংসারে স্যার কি একটুখানি ব্যতিক্রম নয় ?
হ্যা, এটা সত্যি কথা , লিটু স্যারকে সবাই অসম্ভব শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। কেউ তাঁকে পরিবেশবিদ বলতেন। কেউ বলতেন নগরপরিকল্পনাবিদ। তাঁর ছাত্র বলে অনেকে গর্বও বোধ করতেন। তাঁর সঙ্গে একটা ছবি থাকলে অনেক প্রকৌশলী নিজেদের ধন্য বোধ করতেন। কিন্তু কেউ কথা শুনতেন না তাঁর। বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দেলনে নেমে তিনি কতটা নাকাল হয়েছিলেন তাতো সবারই জানা। তিনি এসব ভালোই বুঝতেন । তবু কাউকে সেরকমভাবে দোষারূপ করতেন না।
স্যার মনসুর সাহেবকে দেখতে গিয়েছিলেন । দুজনার দেখা হয়েছিলো গুলশানের সেই মোড়ে। চেয়ার পেতে বসে বুড়ো পাখির শব্দ শুনছে। পাশেই গাড়ির পাশে দাঁড়ানো কন্যা গুলশান আরা।
তিনি এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,‘ আব্বা দেখেন কে এসেছেন ? খুব বিখ্যাত মানুষ , আপনার মতোই প্রকৃতি-প্রেমিক । আমাদের গুলশানের বাড়িটায় তিনি যেতেন। এখনও ভুলতে পারেন না সেকথা। ’
ভদ্রলোক লিটু স্যারকে এক ঝলক দেখলেন। তারপর মুখভরা অনীহা ও উষ্মা নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিয়ে চেয়ে, আঙুল দিয়ে আকাশটাকে দেখিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন ,‘ সব পাখি আকাশে উড়ে গেছে। ওরা নেই। ’
এর কদিন বাদে ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন মনসুর সাহেব।
স্যার খবরটা শুনে কাঁদ কাঁদ গলায় আমাকে জানান ,‘ কামাল , একদিন দেখিস আমারও এ অবস্থা হবে । আজকাল আমার মাথার ভেতরও নদীগুলো কুলকুলু রবে বয়ে যায়। পাখিরা অবাধে উড়ে বেড়ায় । গাছেরা কথা কয়। বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তনাদ করে। প্রচুর রোদে পানি পানি বলে হাহাকার করে। এ ভার কতদিন সহ্য করা যায় কামাল ? ’
‘কথাগুলো বলুন। শুনতে দিন মানুষকে।’
‘ওরা সবাই কংক্রিটের জঙ্গল করে সেই জঙ্গলের মাথায় আবার বাগান করতে চায়। নদী পাখি গাছ ফুল লতাপাতা সব আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। জানি না সম্ভব কিনা । জীবন থেকে যা অপহৃত হয় তা কি আর হুবহু ফিরে আসে কামাল ?’
এ প্রশ্নের আমার উত্তর জানা নেই। লিটু স্যারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমিও প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিচ্ছি সবাইকে , সম্ভব ?
লেখকঃ গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।
Leave a Reply