রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৯:২৭ অপরাহ্ন

কৃষকরা কি সরকার নির্ধারিত দামে ধান, চাল, গম বিক্রি করতে পারেন?

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ৮.৫৭ পিএম

মরিয়ম সুলতানা

আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার, যার বাজারমূল্য পড়বে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।

মঙ্গলবার সাতই মে সচিবালয়ে অনলাইনে এই ধান-চাল কেনার কার্যক্রমের উদ্বোধনের সময় এ কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

তিনি জানান, এবার ৩২ টাকা কেজি দরে পাঁচ লাখ টন বোরো ধান, ৪৫ টাকা কেজি দরে ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ৪৪ টাকা কেজি দরে এক লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে।

এছাড়া, এবছর ৩৪ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাতই মে থেকে আগামী ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত ধান, চাল ও গম কেনার এই কার্যক্রম চলবে।

প্রসঙ্গত, গতবছর ধান, সেদ্ধ চাল ও গমের সংগ্রহমূল্য ছিল যথাক্রমে ৩০ টাকা, ৪৪ টাকা এবং ৩৫ টাকা।

এখন প্রশ্ন হলো, কৃষকরা, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা কি সরকারের বেঁধে দেওয়া এই দামে সন্তুষ্ট? কিংবা, তারা কি আদৌ এই দামে ফসল বিক্রি করতে পারেন?

এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন ধানচাষীর সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা যারা জানিয়েছেন নানা কারণে নির্ধারিত মূল্যে সরকারের কাছে ফসল বিক্রি করতে পারেন না তারা।

আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার।

কৃষকরা যা বলছেন

কৃষকদের ভাষ্য, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ধান-চাল বিক্রি করতে পারলে তাদের লাভ বেশি হতো। কিন্তু ধান বিক্রি করে সরকার নির্ধারিত এই মূল্য পান না।

চলতি বছর মোট ছয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন খুলনার দাকোপ উপজেলার খাটাইল গ্রামের কৃষক রফিক সরদার। সেখান থেকে মোট ১৮০ মণ ধান উৎপাদন করতে পেরেছেন। তবে উৎপাদিত ধানের মোট ১০০ মণ ধান তিনি ইতোমধ্যে স্থানীয় পাইকারদের কাছে ২৭ টাকা দরে বিক্রিও করে দিয়েছেন।

গোলায় থাকা বাকি ৮০ মণ ধানও পাইকারদের কাছে বিক্রি করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বিবিসিকে বলেন, “হ্যাঁ। কারণ সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করা ঝামেলার। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা, টিকিট কাটা…সহজে কোনও কাজ করা যায় না। তারপর ফুড অফিসারের ওইখানে কিছু ঘুসঘাস দিতে হয়।”

“ঘুসঘাস না দিলে কয় কি, আপনার এ ধানে পুষ্টি নেই,” তিনি যোগ করেন এবং বলেন যে তিনি যে দামে ধান বিক্রি করেছেন, তাতে “লাভও খুব হয়নি, আবার লসও হয়নি। তাও হয়রানির চাইতে এটা ভালো।”

বছর চারেক আগে একবার সরকারি প্রক্রিয়ায় ধান বিক্রি করেছিলেন উল্লেখ করে মি. সরদার বলেন, “এক বছর ওইভাবে বেচিছি। কিন্তু যে ভোগান্তি খাইছি, তারপর ওটা ছাড়ান দিছি। আর করবো না।”

তিনি জানান, তাদের গ্রামে কোনও বিক্রয় কেন্দ্র নেই। “ধান নিয়া আমাদেরকেই উপজেলায় যাইতি হয়। যাওয়ার পর যদি বলে যে পুষ্টি নাই, তাইলে পরে ওই ধান নিয়া ফেরত আসতে হয় আবার।”

এবার ৩২ টাকা কেজি দরে পাঁচ লাখ টন বোরো ধান কেনার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি যে কৃষকদের জন্য ভোগান্তির, তা ফুটে উঠেছে দিনাজপুরের কোতয়ালি থানার বড়ইল গ্রামের আরেক কৃষক মো. আজিজুল ইসলামের বক্তব্যতেও।

তিনি এবছর মোট পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তবে খুলনার মতো দিনাজপুরের দিকে এখনও ধান কাটা শুরু হয়নি, সেখানে ধান কাটা শুরু হতে হতে আরও ১৫ দিন লেগে যাবে।

তার আশা, কোনও দুর্যোগ না এলে প্রতি বিঘা জমি থেকে ২৮-৩০ মণ পর্যন্ত ধান হবে এবছর। তবে তিনি সরকারের কাছে বিক্রি করবেন না। তিনি বলেন, “কৃষকরা কখনও ৩২ টাকা কেজি দরে ধান বিক্রি করতে পারবে না এবং কৃষকরা সরাসরি সরকারকে ধান দিতেও পারে না।”

তার মতে সরকার যদি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে যায়, তাহলে “ক্রয়ের সিস্টেম চেঞ্জ করতে হবে”।

তিনি জানান, কৃষকদের বাড়িতে আগের মতো জায়গা না থাকায় ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে ধান কাটার পর সেগুলোকে বাড়িতে মজুদ করতে পারে না।

“সরকার তো শুকনা ধান নিবে। কিন্তু আমি যে ধানটা শুকাবো, শুকাতে গেলে আমার চাটালের দরকার আছে। সময় ও রোদের দরকার আছে। কৃষকদের বাড়িতে এখন আগের মতো খোলান নাই, চাতাল নাই যে ধান কেটে, মাড়াই করে, শুকিয়ে মজুদ করবে। তাই কৃষকরা কাঁচা ধানই রাইসমিলে বিক্রি করে দেয়। কারণ ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। বিক্রি হয়ে গেলে কৃষকরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল।”

এছাড়া, বিক্রয়কেন্দ্রে ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভোগান্তির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তার ভাষ্য, “আমি শুকনা ধান নিয়া গেলাম। আমাদের কাছে তো মেশিন নাই। ওরা ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। তারা ১৪ শতাংশ (ময়েশ্চার) শুকনা ধান কিনবে। এখন আমার ধানটা ১৪ পার্সেন্ট শুকনা হলেও অফিসাররা বলবে যে ১৬ পার্সেন্ট শুকনা আছে। অর্থাৎ, ধানটা ফেরত দিলো। এটা তো কৃষকের পক্ষে ভোগান্তির।”

বাংলাদেশের দিনাজপুর ধানের জন্য বিখ্যাত।

এখানে উল্লেখ্য, ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের মতো থাকলে তা কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নেয় সরকার।

দিনাজপুরের এই ধানচাষী মনে করেন, “উপজেলায় না, ইউনিয়ন পর্যায়ে যদি ক্রয়কেন্দ্র থাকতো, তাহলে কৃষক একদম কুলা দিয়ে ঝেড়ে ১৪ পার্সেন্ট কেন, সাড়ে ১৩ পার্সেন্ট শুকায়ে ভালো ধান দিবে।”

তিনি বলেন, সরকারের কাছে ধান বিক্রির প্রক্রিয়ার মাঝে জটিলতা থাকায় প্রান্তিক চাষীরা মিল মালিক বা হাটে-বাজারের পাইকারদের কাছেই ধান বিক্রি করেন। সরকার যদি সহজ উপায়ে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তাহলে কৃষকরা “লাভবান ও আগ্রহী হবে। ধানটা একদম শুকায়েই দিতো।”

যদিও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যে কৃষকরা সরকারকে ধান দিবেন বলে আবেদন করেছেন তাদের বাড়ি গিয়ে যেন কৃষি কর্মকর্তারা ময়েশ্চার মিটার দিয়ে ধানটা পরীক্ষা করেন।

“আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি থাকলে তাদের বলবেন, আরও শুকিয়ে ১৪ শতাংশে নিয়ে আসেন। যাতে কৃষক হয়রানি না হয়, সেজন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছি, আরও ময়েশ্চার মিটার (ধানের আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র) কিনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দেওয়া জন্য।”

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ধানচাষী মি. ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, “মন্ত্রী তো ঢাকা থেকে বলেন। তিনি কি জানেন যে ধানটা কীভাবে সংগ্রহ হয় আসলে, ফুড অফিসাররা কীভাবে কিনে। কৃষকদের কাছ থেকে তারা কয় বস্তা কিনে, কীভাবে কিনে, মন্ত্রী তা কখনোই বলতে পারবেন না।”

“বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের ধান পরীক্ষা করার সুযোগ নাই। তারা ধান ক্ষেত দেখতেই আসে না, সেখান কী পরীক্ষা করবে?” প্রশ্ন করেন এই কৃষক।

ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি থাকলে তা কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নেয় সরকার।

সরকারের দায়িত্বশীলরা যা বলছেন

ধানের ময়েশ্চার কীভাবে পরীক্ষা করে, সে সম্বন্ধে জানতে চাইলে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাস বিবিসিকে বলেন, “কৃষকরা আমাদের কাছে স্যাম্পল নিয়ে আসে।”

“তবে মাঠ পর্যায়েও উপ-সহকারীদের কাছে মেশিন দেওয়া আছে। কোনও কৃষক যদি মনে করেন যে তার সহায়তা লাগবে, তাহলে উপ-সহকারী বাড়িতে গিয়ে পরীক্ষা করে দিয়ে আসেন।”

ধানের ময়েশ্চার পরীক্ষা নিয়ে কৃষকদের এমন অভিযোগ সম্বন্ধে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “গোডাউনে ধান দিতে এসে কোনও কৃষক যেন হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য ডিসি ও কর্মকর্তাদের নজর রাখতে বলেছি। যদি সেটা (কৃষককে হয়রানি) করে তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ জানাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দুটি নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। ওই নম্বরে কৃষক বা কোনও ব্যক্তি ফোন করে হয়রানির কথা জানাতে পারবেন।”

তবে সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, কৃষক আদৌ ওই দামে ধান বিক্রি করতে পারবে কি না, এ বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তারা বিক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসলে এই দাম পাবে। কিন্তু বাইরে অনেকসময় বেশি দাম থাকায় তারা সেখানে ধান বিক্রি করেন।”

এই দামে লাভবান হবে কি না, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অবশ্যই কৃষকরা লাভবান হবেন। ৩২ টাকা কেজি তো কম না। যেখানে সারে ভর্তুকি দেওয়া হয়, বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, লাভবান হওয়া উচিৎ।”

মন্ত্রী জানান, সরকারের মোট ১০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে যে খাদ্য পরিবীক্ষণ ও বিপণন কমিটি আছে, তারা সবদিক বিবেচনা করে ধান, চাল ও গমের দাম নির্ধারণ করেন।

“কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদন খরচ বলা হয়। সেটি অ্যাসেস করে সব মন্ত্রণালয় মিলে এই দাম নির্ধারণ করেন,” বলেন মি. মজুমদার।

ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্রয়কেন্দ্র না থাকার ব্যাপারে মন্ত্রীর ভাষ্য, “প্রতি ইউনিয়নে আমাদের বিক্রয় কেন্দ্র নাই। আর এটা থাকা সম্ভব না। পৃথিবীর কোনও দেশে নাই।”

চাল পরিষ্কার করছেন একজন নারী

বিশ্লেষকরা কী মনে করছেন?

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কোষাধ্যক্ষ ড. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার মনে করেন, “দাম বেশি হয়েছে না কি কম হয়েছে, সেটার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো: যেভাবে নির্ধারণ হওয়া উচিৎ, সেভাবে হয়নি…(দামের বিষয়ে) কৃষকদের পার্সেপশন জানার জন্য তাদের সাথে কোনোদিনও যোগাযোগ করা হয়নি। একটা অফিস অর্ডার করে দেওয়া হলো। দাম নির্ধারিত হয়ে গেল।”

“কৃষক ওই দাম (সরকার নির্ধারিত) পাবে, এমন নিশ্চয়তা কম। যেসমস্ত কৃষকের দুরবস্থা, তারা জমিতে ধান থাকতেই তা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আগাম টাকা পেয়ে যাবে, তাই,” যোগ করেন মি. তরফদার।

তার মতে, কৃষকের এই দুরবস্থার কারণ, তাদের বাড়িতে ধান রাখার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ে “শস্য মজুদকারী কেন্দ্র” স্থাপন করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি যদিও এ বিষয়টি সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন খাদ্যমন্ত্রী।

“ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্যমজুদকারী কেন্দ্র করলে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা সেখানে ধান রাখতে পারবে। তখন আর তারা পাইকার, কর্পোরেটদের কাছে যাবে না। যারা ১০০-২০০ বিঘা নিয়ে মেগা প্রজেক্ট করে, তাদের জন্য শাইলো (শস্যমজুদকারী কেন্দ্র) দরকার নেই। কিন্তু গরীবদেরকে বাঁচানোর জন্য দরকার,” বলেন মি. তরফদার।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024