রবীন্দ্রনাথ যে ভারত উপমহাদেশীয় সভ্যতায় জম্মেছিলেন, সেই সভ্যতাকে ভাগ করে এখন তিনটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। অতীতে এই সভ্যতার ভুগোল শত শত রাজ্যে ভাগ ছিলো। রাজ্যের সীমা রেখা যেমন কখনও সভ্যতার রশ্মিকে বাধা দিতে পারে না তেমনি রবীরশ্মিকেও বাধা দেয়া যায়। রবীন্দ্রনাথকে হয়তো অনেকে বলবেন, তিনি তো পৃথিবীর কবি বা দার্শনিক। তাকে উপমহাদেশে এনে ভাগ করা কেন?
ভাগ করা নয়। যে সভ্যতায় তিনি জম্মেছিলেন, যেখানে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন আর সর্বোপরি তার হাত ধরে যে সভ্যতা নবরূপ পায় তিনি আগে সেই সভ্যতার সূর্য রশ্মি।
তাকে জম্ম ও মৃত্যুদিনে স্মরণ করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। আর সব সময়ই তিনি এমনভাবে মিশে আছেন এ সভ্যতার এই উপমহাদেশের মানুষের জীবানচারণে, সংস্কৃতিতে বা চর্যায় তা থেকে নিজের জীবনের কতটুকু নিজের আর কতটুকু রবীন্দ্রনাথের- এ আলাদা করা এক দুস্কর কাজ।
রবীন্দ্রনাথের যে সভ্যতায় জম্মেছিলেন, সেই সভ্যতার শরীরে এ মুহূর্তে নানান ব্যাধি। তবে সব থেকে বড় ব্যধি, উদারতার অভাব। আর ইহজাগতকিতার বাস্তব স্থানকে দখল করছে পরজাগতিকতার মতো কল্পলোক।
রবীন্দ্রনাথ এই পরজাগতিকতার কল্পলোককে ঠেকানোর জন্যে তিনি জীবনের এক পর্যায়ে ভৌগলিক জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করতে যেমন কলম ধরেছিলেন তেমনি পথেও নেমেছিলেন। পরে তিনিও তার ভুল বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে যেমন এক ধরনের কট্টরপন্থা আছে, তেমনি এটা ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের খেলার উপজিব্য হয়ে যায় এ জাতীয়তাবাদ। তাই তিনি আবার ফিরে গিয়েছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতায় যে মানবধর্ম রয়েছে সেই উদার মানবতন্ত্রে।
আর এই মানবতন্ত্র কখনও একটি ভুগোলের সভ্যতাকে নিয়ে বেড়ে ওঠে না। এর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগ হয় সারা বিশ্বের সভ্যতার সব সুন্দর উপাদান। তাকে বিশ্বায়ন বলা হোক আর আর্ন্তজাতিকতা বলা হোক। এই সুন্দর বিশ্বায়নের মানবতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে পৃথিবী থেকে দূর করা প্রয়োজন যুদ্ধের হিংস্রতা। তাই তিনি হিংসায় উম্মত্ত পৃথি থেকে পৃথিবীকে সরে আসার পথ একের পর এক খুঁজেছেন।
অন্যদিকে আজ যে ইহজাগতিকতার বা্স্তবতার স্থানে পরলোকের কল্পলোক প্রবল প্রতাপে তার সভ্যতার ভূমিতে- এমনটি যে ঘটবে তা তিনি নানান ভাবে সর্তক করেছিলেন। যারা তখন দেশ সৃষ্টির পথে বের হয়েছিলেন, স্বশাসনের পথে বের হয়েছিলেন, তিনি তাদের আগে নিজের চরিত্র গঠনের জন্যে বলেছিলেন। তার উপন্যাসে তাই দেখা যায় যারা দেশের টানে বের হচ্ছেন তারা পরাজিত হচ্ছেন জৈবিক শরীরের টানে। আসলে জৈবিক সকল লোভের উর্ধে উঠতে না পারলে কখনই দেশ পরিচালনা করা যায় না এবং সে দেশ প্রকৃত অর্থে নিজের দেশ থাকেও না। সেদিন এ সত্য রবীন্দ্রনাথে উচ্চারিত হলে অনেকে তাকে ভুল বুঝেছিলেন। প্রশ্ন হলো, এখনও কি সে সত্য এ উপমহাদেশ বুঝতে পারছে? এ উপমহাদেশের রাষ্ট্র তিনটি যে রুগ্ন তার মূলে কি চরিত্রের অভাব নয়?
আর এই রাষ্ট্র তিনটিতে সব থেকে বড় অভাব উদারতার। রবীন্দ্রনাথের নাটকে, গীতিনাট্যে, উপন্যাসে একজন দাদাঠাকুর বা ঠাকুরদাকে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের সময় এ উপমহাদেশ ছিলো যৌথ পারিবারিক কাঠামোতে। সেখানে পরিবারে সকলের শেষ আশ্রয় থাকতো ওই পিতামহ বা দাদাঠাকুর। যিনি তার অভিজ্ঞতা ও ভালোবাসার মিশ্রনে এমন এক উদারস্থান হতেন, সেখানে সকলে সহজে আশ্রয় পেতেন। বাস্তবে রাষ্ট্র বা মানব-জীবন যতক্ষন না ওই দাদাঠাকুর বা পিতামহের মত উদার না হয় ততক্ষন সে জীবন যেমন মানব জীবন নয় তেমনি রাষ্ট্রও প্রকৃত অর্থে মানুষের রাষ্ট্র নয়।
তাই উদার মানব জীবনের পথে নিজেকে চালিত করা আর উদার রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করে মানুষের বাসযোগ্য স্থান তৈরি করাই প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার ফুলটি নিবেদন করা। অন্য কোন আনুষ্ঠানিকতায় নয়।
Leave a Reply