মরিয়ম সুলতানা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজার বা শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে’ পর্যায়ক্রমে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করতে বলেন তিনি।
আগে থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে রয়েছে। নতুন নির্দেশনার বাস্তবায়ন হলে প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা লাভবান হবে?
তাছাড়া, বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও অস্থিরতার অভিযোগ ওঠা বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে এমন উদ্যোগ কী প্রভাব ফেলবে?
ঢাকার একটা ব্রোকারেজ হাউজে ব্যস্ততা (ফাইল ফটো)
একনেকের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালাম বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে প্রতিযোগিতা সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশনা দিয়েছেন।”
“এতে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যয় কমিয়ে নিজেদের আয় দিয়ে চলতে পারবে,” যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার নির্দেশনায় ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির নাম উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “দেশের বেসরকারি অনেক সিমেন্ট কোম্পানি ছাতক কোম্পানির পরে এসেছে, কিন্তু তারা এগিয়ে যাচ্ছে।”
“বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে যাতে সরকারি কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতা করতে পারে সেজন্য শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী,” তিনি জানান।
কোন ধরনের সরকারি কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে যুক্ত করা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, “এটা অর্থ বিভাগের কাজ। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।”
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সংস্কার করার জন্য তাগাদা দিয়ে আসছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন যে সরকার প্রধানের এমন নির্দেশের সঙ্গে “আইএমএফ’র নির্দেশনার কিছুটা সম্পর্ক আছে। এটা এমনিতেও দরকার ছিল। এখন চাপে পড়ে আইএমএফের কথায় হয়তো রাজি হচ্ছে।”
“(নির্দেশনা মানার) কিছু কিছু (উদাহরণ) তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। যেমন, ব্যাংকসুদের হারটাকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলো। এটা আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী,” তিনি বলেন।
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের দরপতন হচ্ছে।
সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে শেয়ারবাজারে আছে, তাদের মাঝে অন্যতম হল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। কোম্পানিটির ২৫ শতাংশ শেয়ার জনগণের জন্য উন্মুক্ত।
তিতাসের কর্পোরেট ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক মো. লুৎফুল হায়দার মাসুম বলেন, “পাবলিকের জন্য শেয়ার থাকা ভালো। আর, আমাদের এক্সপেরিয়েন্স ভালো।”
যদিও তিতাসের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আছে বাজারে। তিতাসের গ্যাসলাইনগুলো ৫৫ বছরেরও বেশি পুরনো হওয়ায় সেগুলোতে লিকেজ আছে। যার ফলে অনেকসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস বিস্ফোরণের খবরও শোনা যায়।
এই বিষয়গুলোকে উল্লেখ করেই মি. মাসুম বলেন, “লাইনগুলো সংস্কার করলে আমরা নতুন লাইন দিতে পারবো। তবে আমাদের চ্যালেঞ্জ হল, আমাদের ডিমান্ড অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না।”
“এলএনজি আনতে হচ্ছে আমাদের বাইরে থেকে। এগুলোকে আমরা ২০২৬ সালের মাঝে সমাধান করবো। তখন আমরা পুরোপুরিভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারবো।”
তবে তিতাস ছাড়াও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসিকে বলেন, “আমাদের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে মার্কেটে আছে। যেমন- ডেসকো, পিজিসিবি, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তিতাস…”
“তবে আমরা বাকিগুলোকেও নিয়ে আসতেছি। যেমন, আমরা চেষ্টা করছি ডিপিডিসিকে নিয়ে আসতে। জ্বালানি থেকে তিতাসের জায়গা (শেয়ার) আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছি।”
পুঁজি বাজারে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো কবে আসবে, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মার্কেটে নিয়ে আসার জন্য আমরা অলরেডি প্রস্তুত। এই বছরের (২০২৪) মাথায় আমরা প্ল্যানিং শেষ করবো। আগামী বছর ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটের অবস্থা বেটার হলে আমরা মার্কেটে নিয়া আসবো।”
সেগুলোকে শেয়ার বাজারে আনা ভালো সিদ্ধান্ত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অবশ্যই।” “কারণ এগুলো আসলে রিস্ক ডিস্ট্রিবিউশন হবে, মার্কেটটা ওয়াইডার হবে। মোর ট্রান্সপারেন্ট এবং প্রফেশনাল ওয়েতে কোম্পানিগুলো চলতে পারবে। জবাবদিহিতা থাকবে।”
ঢাকায় ব্যাংক পাড়া বলে পরিচিত মতিঝিল এলাকা।
গত কয়েকমাস ধরেই শেয়ার বাজারের সূচক ওঠা-নামা করছে। তাছাড়া, সরকারের সব প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে লাভজনকও না।
এমন বাস্তবতায় ঢালাওভাবে সব প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার বাজারের অন্তর্ভূক্ত না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে খুবই অল্পসংখ্যক (চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা এয়ারপোর্ট, বাংলাদেশ বিমান) প্রতিষ্ঠান লাভজনক, তারা আসতে পারে। বা, যে প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটিভাবে লাভজনক বা মার্জিনালি হয়তো… কোনও কোনও বছর লাভ করে কোনও কোনও বছর ক্ষতি হয়, সেগুলোকে আনা যেতে পারে।”
“কিন্তু লসমেকিং প্রতিষ্ঠান এনে লাভ নেই। ক্ষতির মুখে থাকা প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে এলে আমরা এর থেকে কী অর্জন করবো? তাই, আনপ্রফিটেবল যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের আছে তাদেরকে স্টক মার্কেটে এনে তেমন কোনো লাভ হবে না,” তিনি যোগ করেন।
“সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনলে হবে না। কারণ তারা সরকারি পুঁজি বাড়াবে। এখানে বাইরের শেয়ার হোল্ডার কিছু লোক যদি কিছু শেয়ার কেনে তারা লুজার হবে। আমরা মানুষকে ঠকানোর জন্য স্টক মার্কেটের স্টক নিয়ে আসবো না তাই না?”
তাহলে করণীয় কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যেসব প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ব্যক্তিখাতে দিয়ে দিতে হবে।”
“যেগুলোর সম্ভাবনা নেই, যেমন- পাটকল, চিনিকল…সেগুলো যেমন আছে তেমন থাক। এগুলো থেকে কোনও লাভ নাই। শুধু বেতন ভাতা গুনতে হচ্ছে। পয়সা নষ্ট হচ্ছে সরকারের।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশাও প্রায় একই কথা বলেন।
তিনি মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শেয়ার বাজারে আনা গেলে সেটা ভালো সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু “এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার বাজারে আনার জন্য বড় প্রস্তুতি দরকারএবং এটার জন্য বেশ কিছুদিন সমাধান লাগবে।”
“এই মডেল উন্নত দেশগুলোর জন্য এপ্লিক্যাবল। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এখনই না। কারণ এখনও আমাদের সাধারণ মানুষের শেয়ার বাজারের ওপর খুব একটা বিশ্বাস তৈরি হয়নি। অনেকক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছাচ্ছে না। অনেক কোম্পানি হয়তো ইনসাইডার হিসাবে শেয়ারের ভ্যালুকে ফ্ল্যাকচুয়েট করার ক্ষমতা রাখে”
তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে…সেখানে কোনও ক্ষতি হলে দায়ভার তাকেই নিতে হবে, সেটা অনেকসময় রিস্কি। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতা আছে কি না দেখতে হবে। কারণ আমাদের সরকারি প্রষ্ঠানগুলো প্রফিট মোটিভেটেড না, বিজনেস মডেলের মতো কাজ করে না এগুলো। তাই, লোকসানের বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।”
“এইসব সমস্যাগুলোকে ঠিক না করে আগানো ঠিক হবে না। তবে আমরা টার্গেট রাখতে পারি।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হলে ভালো হবে।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে শেয়ার বাজারে বড় আকারের কেলেঙ্কারি ঘটে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে।
বিনিয়োগকারীদের অনেকই মনে করেন শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান-পতনের পেছনে একটি মহলের কারসাজি রয়েছে।
১৯৯৬ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
কিন্তু সেসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। শুধু একটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল দুজনকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতনের পর এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার একটি তদন্ত কমিটির গঠন করেছিল, যার প্রধান করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে।
অভিযোগ রয়েছে ১৯৯৬ সালের ঘটনায় যারা অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই ২০১০ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতেও জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটায় শেয়ার বাজার একটু পড়তির দিকে গেলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং তারা পুরনো কারসাজির গন্ধ খুঁজে পান।
২০২২ সালে অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন এ বিষয়ে বিবিসিকে বলছিলেন, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই এবং তারা শেয়ার নিয়ে পর্যালোচনাও করেন না। এর ফলে নানাভাবে কারসাজি করা সম্ভব হয়।
“বড়রা যেমন সুযোগ নিতে চায়, তেমনি ছোটরাও সুযোগ নিতে চায়। কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো তাদের এতো কম পুঁজি থাকে যে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর কিছুই থাকে না,” বলেন ফাহমিদা খাতুন।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply