মাক্সিম গোর্কি
নেপুল-এর ট্রানশ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছে। রিভিয়েরা-ডি-কিমাইআ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি খালি গাড়ি। পিয়াজা দেরা ভিত্তোরিয়া-তে এসে জমায়েত হয়েছে একদল ড্রাইভার আর কণ্ডাক্টর- সকলেই তারা খাঁটি নেস্বাসী ফুর্তিবাজ, মুখর, আর পারদের মতো অস্থির। পার্কের বেড়া ছাড়িয়ে লোকগুলোর মাথার ওপরে সরু তলোয়ারের মতো ঝিলিক দেয় একটা ফোয়ারার মূলধারা। চারপাশ ঘিরে বিরূপ একদল লোকের ভিড়- বিস্তীর্ণ শহরটার নানা খানে তাদের যাবার কথা। দোকান-কর্মচারী, কারিগর, ব্যবসায়ী আর মেয়ে দর্জিরা এই দঙ্গলটা ধর্মঘটীদের সরবে তিরস্কার করে চলে। দুপক্ষেই চলে কড়া কথা আর গা-আলানো টিটকারি। হাত নাড়ারও বিরাম নেই, কেননা নেস্-এর লোকেরা কথা বলে যেমন জিভ দিয়ে, তেমনি হাত নেড়ে, দুয়েতেই তাদের প্রাঞ্জলতা আর বাগ্মিতা সমান।
একটু হালকা বাতাস বয়ে যায় সমুদ্র থেকে। শহরে পার্কের দীর্ঘায়ত পামগাছগুলোর শ্যামলকৃষ্ণ পাতায় দোলানি জাগে একটু-গাছগুলোর গুঁড়ি দেখে মনে হবে যেন কোন এক দানবীয় হাতিয় গোদা গোদা পাগুলো। নে-এর রাস্তার যারা সন্তান, সেই সব অর্ধনগ্ন বাচ্চাগুলো ছটোপাটি করে বেড়ায়, চড়ুই পাখির মতো তাদের কিচির-মিচির হাসিখুশিতে বাতাস ভরা।
প্রাচীন একটা এনগ্রেভিং-এর মতো শহরটা দেখতে। জলন্ত সূর্যের অকৃপণ কিরণে নেয়ে উঠেছে, মনে হয় বুঝি সন্ত্রিত হয়ে চলেছে একটা অর্গানের মতো। শহরের হৈচৈ আর গণ্ডগোলের সঙ্গে তাম্বুরিনের চপচপের মতো অস্পষ্ট তাল দিয়ে সঙ্গত করে চলে উপসাগরের নীল তরঙ্গরাশি, পাথরের বাঁধের ওপর আছাড় খেয়ে।
ধর্মঘটীরা মুখতার করে গা ঘেঁসাঘেঁসি দাঁড়িয়ে। জনতার তীক্ষ্ণ মন্তব্যের কোনো জবাব প্রায় দেয়ই না। ওদের কয়েকজন পার্কের রেলিং-এর ওপর উঠে লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে কি দেখতে থাকে উদ্বিগ্ন হয়ে, মনে হয় যেন কুকুরের বেড়াজালে আটকা পড়েছে একদল নেকড়ে। বেশ বোঝা যায় একই রকম পোষাক-পরা এই লোকগুলো যা ঠিক করেছে তা করবেই এমন একটা প্রতিজ্ঞায় হাতে হাত মিলিয়েছে। তাতে আরো ধৈর্যচ্যুত হয়ে উঠে ভিড়টা। কিন্তু জনতার মধ্যেও দার্শনিকের অভাব হয়নি। ধীরেসুস্থে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তারা রুষ্টতর ধর্মঘট-বিদ্বেষীদের বোঝায়:’লোকগুলো যদি তাদের ছেলেপুলেদের মুখে দেবার মতো সাকারনিও না জোটাতে পারে, তাহলে কি করে বলুন, সিনোর?’
ফিটফাট সাজের পৌরসভা পুলিসের দুজন তিনজনের এক একটা দল তদারক করে, যাতে লোকের ভিড়ে গাড়ির রাস্তা না আটকায়। ওরা চেষ্টা করে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নিরপেক্ষ থাকতে। ধিকৃত এবং ধিক্কারকারী উভয় পক্ষ সম্পর্কেই তারা সমান উদার। চিৎকার আর অঙ্গভঙ্গিতে যখন ব্যাপারটা বেশ গরম হয়ে ওঠে, তখন সপরিহাসে ওর্য টিটকারি দেয় উভয় পক্ষকেই। ছোটো ছোটো হালকা বন্ধুকওয়ালা এবদন সশস্ত্র সেপাই পাশের গলির খালানের গায়ে লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। গুরুতর সংঘর্ষ বাধলে তারা গিয়ে হস্তক্ষেপ করবে। তিনকোণা চুপি, খাটো কুর্তা, আর ট্রাউজারের দুপাশ দিয়ে নেমে আসা দুই ধারা রক্তের মতো দাল দুটো করে ট্রাইপে ওদের দেখায় কেমন একটু তয়ঙ্কর।
হঠাৎ কোন্দল, টিটকারি, ধিক্কার আর অনুনয়-বিনয়ের পাবা থেমে আসে। নতুন একটা ঝোঁক পেয়ে বসে জনতাকে-বোধ হয়, বুঝিবা শান্ত হয়ে আসার ঝোঁক। ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার ওঠে:’সৈন্য।’
আর সঙ্গে সঙ্গে আরো যন হয়ে দাঁড়ায় ধর্মঘটীরা। মুখ চোখ তাদের শক্ত শক্ত।
ধর্মঘটীদের প্রতি চিৎকার, শিস আর টিটকারির সঙ্গে এবার এসে মেশে একটা ফুতির আওয়াজ। হালকা ধুসর পোষাক আর পানামা- টুপি-পরা মোটা মতো একটি লোক হঠাৎ ফুটপাথের পাথরের ওপর পা ঠুকে লাফাতে শুরু করে।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে পথ করে এগুতে থাকে কণ্ডাক্টর আর ড্রাইভারেরা। কেউ কেউ গাড়িতে চেপে বসে। চারদিককার উল্লাসের জবাবে ওরা যখন কাটা কাটা উত্তর দিয়ে ভিড় ঠেলে এগোয় তখন ওদের দেখায় কেমন আগের চেয়েও থমথমে। হৈচৈ থেমে আসে।
সান্তা লুচিয়া বাঁধের ওপর থেকে হালকা নাচের মতো কদম ফেলে আসে ধূসর পোষাকের হ্রস্বকায় একদল সৈন্য। ওদের পা পড়ে তালে তালে, যন্ত্রের মতো দোলে বাঁ হাত। দেখে মনে হয় বুঝি টিনের সেপাই – খেলনার মতোই বা ঠুনকো। লম্বা সুপুরুষ একটি অফিসার ওদের নেতৃত্বে। লোকটার চোখে ভ্রুকুটি, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের রেখা। তার পাশে লাফাতে লাফাতে আসে একটা গাঁট্টাগোটা লোক, মাথায় উপ-হ্যাট, কথা বলে হড়বড় করে আর ক্রমাগত হাত নেড়ে নেড়ে বাতাসে কি যেন কাটাকুটি করে।
গাড়িগুলোর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায় ভিড়টা। ধূসর কয়েকটা বিন্দুর মতো ছড়িয়ে পড়ে গাড়ির প্ল্যাটফর্মে যেখানে ধর্মঘটীরা দাঁড়িয়ে তার সামনে গিয়ে তাক করে দাঁড়ায় সৈন্যগুলো।
টপ্-হ্যাট-পরা লোকটার সঙ্গে আরো কিছু ভদ্রদর্শন নাগরিক এসে জুটেছিল। দারুণভাবে হাত নেড়ে তারা চিৎকার করে ওঠে: ‘এই শেষ কথা… উল্টিমা ভোল্টা! শুনতে পাচ্ছ?’
উদাসীন ব্যাজার এক ভঙ্গিতে মাখা হেলিয়ে অফিসার দাঁড়ায় মোচ চুমড়িয়ে। টপ-হ্যাটটা দোলাতে দোলাতে লোকটা ছুটে যায় তার কাছে। ভাঙা গলায় কি যেন বলে। কটাক্ষে তার দিকে একবার তাকিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় অফিসার, তারপর বুক চিতিয়ে হুকুম দেয় চিৎকার করে।
সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা লাফিয়ে উঠতে থাকে ট্রামগাড়িগুলোর প্ল্যাটফর্মে, প্রতি প্ল্যাটফর্মে দুজন দুজন করে। অন্য দিক দিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে ড্রাইভার কণ্ডাক্টররা।
জনতার কাছে ব্যাপারটা মজার মনে হয়। হল্লা আর শিস আর হাসি ওঠে ভিড়ের মধ্যে থেকে। কিন্তু হঠাৎ সব গোলমাল থেমে গিয়ে থমথমে উৎকণ্ঠিত মুখ আর ভয়ার্ত চোখে লোকগুলো সরে এসে গভীর নিঃশব্দে এগুতে থাকে সামনের ট্রামগাড়িখানার দিকে।
সেখানে, গাড়ির চাকার ঠিক দুই ফুটের মধ্যে লোহার লাইনের ওপর শুয়ে পড়েছে একজন ড্রাইভার, নাঙ্গা মাথাটা তার পাকা চুলে ভরা, ক্রোধে স্ফীত হয়ে উঠেছে মোচ জোড়া, সৈনিকসুলভ মুখখানা আকাশের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ বাঁদরের মতো পুঁচকে চটপটে একটা ছোঁড়া গিয়ে শুয়ে পড়ে ড্রাইভারের পাশে। তারপর দেখাদেখি শুরু হয়ে যায় আরো এমনি শুয়ে পড়া …ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন ওঠে। শোনা যায় আর্তস্বরে ‘মাডোনা’কে স্মরণ করার ডাক, ভয়ঙ্করভাবে শাপান্ত করতে থাকে কেউ, মেয়েরা চ্যাঁচাতে শুরু করে আর রবার বলের মতো বাচ্চাগুলো লাফায় উত্তেজনায়।
হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার করে কি যেন বলে টপ-হ্যাট- পরা লোকটা। অফিসার তার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকায়: ওর সৈন্যেরা ট্রানশ্রমিকদের হাত থেকে গাড়িগুলো দখল করার জন্যে চলে গেছে বটে, কিন্তু ধর্মঘটীদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাবার কোনো অর্ডার ওর নেই।
টপ-হ্যাট-পরা লোকটা অতঃপর কিছু বাধ্যবিনীত নাগরিককে জুটিয়ে চলে যায় সশস্ত্র সেপাইগুলোর দিকে, তারপর লাইনের ওপর শুয়ে থাকা লোকগুলোকে হটাবার জন্যে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে ওদের ওপর।
ধস্তাধস্তি চলে কিছুটা। তারপর সহসা ধূলিধূসর গোটা ভিড়টাই দুলে ওঠে, হাঁক ছাড়ে, গর্জায়, তারপর ছুটে যায় লাইনের দিকে। পানামা-টুপি-পরা লোকটা তার টুপিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সর্বাগ্রে গিয়ে শুয়ে পড়ে ধর্মঘটীদের শেষ প্রান্তে আর পাশের ধর্মঘটীকে কাঁধ চাপড়ে উৎসাহ দিতে থাকে সকলরবে।
ধপধপ করে একের পর এক লোকে লাইনের ওপর শুয়ে পড়তে শুরু করে, এমন ভাবে যেন হঠাৎ তাদের পা খোয়া গেছে। ফুর্তিবাজ হৈহল্লা করা এই লোকগুলো দু’মিনিট আগেও এখানে ছিল না। মাটির ওপর শুয়ে পড়ে ওরা হাসতে থাকে, পরস্পরকে মুখ ভেঙচায় আর চিৎকার করে অফিসারের উদ্দেশ্যে। টপ-হ্যাট-পরা লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অফিসারটা মৃদু হেসে তার নাকের কাছে দস্তানাটা নাড়াচাড়া করে আর সুন্দর মাথাখানা দোলার।
এদিকে লোকের পর লোক চলে লাইনের দিকে- মেয়েরা ছুঁড়ে ফেলে তাদের ঝুড়ি-পুঁটুলি, আর হাসিতে লুটিয়ে পড়ে, হি-হি করা কুকুরের বাচ্চার মতো এসে শুয়ে পড়তে থাকে ছোঁড়াগুলো। এমন কি সুদৃশ্য পোষাক-পরা লোকেরাও গড়াগড়ি দিতে শুরু করে ধূলোর মধ্যে।
প্রথম গাড়িখানার প্ল্যাটফর্মে যে পাঁচ জন সৈন্য মোতায়েন ছিল, তারা চাকার নিচে মানুষের স্তূপ দেখে রগড়ের দমকে হেসে ওঠে হো হো করে, ডাণ্ডায় ভর দিয়ে, মাথাটা পেছনে হেলিয়ে, শরীরগুলো সামনে ঝুঁকিয়ে। এখন আর তাদের মোটেই টিনের সেপাই বলে মনে হয় না।
আধ ঘণ্টা পর বান বান করে নে-এর রাস্তা দিয়ে ছোটে ট্রামগাড়িগুলো। গাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে স্মিতমুখ বিজয়ীরা। গাড়ির ভেতরে বিজয়ীরা। যাত্রীদের মধ্যে দিয়ে পথ করে হাঁটতে হাঁটতে তারা জিগ্যেস করে: ‘টিকিট?!’
আর চোখ ঠেরে, হেসে, সরস মুখ ঝামটা দিয়ে যাত্রীরা এগিয়ে দিতে থাকে তাদের লাল হলদে নোট।
Leave a Reply