সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন

আমার দেশ আমার মানচিত্র

  • Update Time : শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪, ৪.২৫ পিএম

তৌফিকুর রহমান খান

সত্তর দশকের মাঝামাঝি, বাবার চাকরির সুবাদে ঘোড়াশাল সার কারখানা কলোনিতে আমাদের বসবাস। সদ্য-স্বাধীন দেশে ‘বাংলাদেশ’ নামটি বারংবার উচ্চারিত হতো গুরুজনদের আলোচনায়, তাদের উচ্ছ্বাস-উৎকণ্ঠার প্রাত্যহিকতায়।

কিন্তু কোথায় সেই বাংলাদেশ – এ নিয়ে আমার রূপকথা শুনে শুনে বেড়ে ওঠা শিশুমন তখন দারুণ কৌতূহলী। এমনি এক পারিবারিক আলোচনায় বাবার কাছে আবদার করে বসলাম আমাকে যেন তিনি একবার বাংলাদেশে নিয়ে যান।

গুরুজনদের আসরে আমার শিশুসুলভ বোকামি উপলক্ষে হাসির রোল উঠল, আমি লজ্জা পেলাম। আমার বাবা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আমরা যেখানে বসবাস করি সেটাই বাংলাদেশ। শীতলক্ষ্যার পাড়ের সেই ঘোড়াশালই বাংলাদেশ;

ইছামতীর দু-পাড়ের গ্রামীণ জনপদের দৃশ্যপট চর্ম আর চিত্তের দুই চোখে মেখে লঞ্চে চড়ে নানুর বাড়ি যাই – প্রতি বর্ষায় পদ্মার নতুন জলে প্লাবিত হওয়া সেই বকচর গ্রামও বাংলাদেশ; যমুনার ধারঘেঁষা বিরাট বিলের পাড়ে আমার দাদুর বাড়ি সেই – টেংড়িপাড়া গ্রামও বাংলাদেশ আর ঘোড়াশাল থেকে নানু বা দাদুর বাড়ি যাবার পথে যাত্রাবিরতি হয় যে-শহরে – বুড়িগঙ্গার তীরের সেই ঢাকা – সেটাও বাংলাদেশ। এসব আমি কিছু বুঝি আবার কিছু বুঝিও না, তবে বাংলাদেশের অবস্থান ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে ভাবনার সূত্রপাত আমার সেই শিশু বয়সের বিব্রতবোধের মধ্য দিয়েই। শুধু খটকা লাগত যখন নানু আর মায়ের কাছে কলকাতার অজস্র গল্প শুনতাম। তাঁরা বলেন, সেটা নাকি ইন্ডিয়াতে, সে অন্য দেশ। কেন সেই দেশে আমরা যাই না? নানুরা কেন কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন? নানাভাই কেন কলকাতা থাকেন? এসব প্রশ্ন মনে আসত।

আর নানান দুর্বোধ্য কিন্তু বহুল উচ্চারিত যে-শব্দগুলো প্রায়ই কানে আসত সেগুলো হলো পাকিস্তান পিরিয়ড, ব্রিটিশ আমল, মুক্তিযুদ্ধ, গণ্ডগোলের বছর, মুক্তিবাহিনী, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। এসব প্রশ্ন ও শব্দমালার ধাঁধার মধ্যেও আমি আমার শৈশবে আমার মতো করে বহুবর্ণিল স্বপ্নের আবেশমাখা একটা বাংলাদেশকে বুঝে নিয়েছিলাম।

বাবার কল্যাণে দেশ-বিদেশের মানচিত্র আর গ্লোব নিয়ে নাড়াচাড়ার সুযোগ ঘটে শিশু বয়সেই। মানচিত্রের মধ্য থেকে কোনো জায়গার নাম খুঁজে খুঁজে বের করা ছিল আমাদের ভাইবোনদের খেলার অংশ। পুরনো একটা মানচিত্রের বই ছিল, সেটা ঘাঁটতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তাম। মানচিত্রের গায়ে লেখা পূর্ব বাংলা-পশ্চিম বাংলা এক রহস্য আবার পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান আরেক রহস্য। এর সাথে বাংলাদেশের নতুন মানচিত্রকে মেলাতে গিয়ে নানান প্রশ্ন আসত মনে; কিন্তু কারো কাছ থেকে সদুত্তর পাইনি আর কোনো প্রশ্ন কাউকে করতেও ভয় লাগত, আবার বোকার মতো কিছু বলে ফেলি কি না সেই শঙ্কায়।

ঘোড়াশাল ছেড়ে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আসি ১৯৭৯-এর মার্চ মাসে, চাকরি নিয়ে বাবার মধ্যপ্রাচ্য গমনের সুবাদে। এর কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা কিংবা বলা যায় দুর্ঘটনা মনের মধ্যে একটা স্থায়ী রেখাপাত করে যায়। ঘটনাটি এমন : ১৯৭৮ সালের সম্ভবত বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আমাদের স্কুলের মাঠে ধানের তুষে বিভিন্ন রকমের রঙ মিশিয়ে একটি বড় বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করা হয়। একেক রঙ সম্ভবত একেক বিভাগকে বোঝানোর জন্য।

সেদিন বাসা থেকে বের হবার সময় আমার সঙ্গী হয়েছিল সহপাঠী শরিফ। মামার বিয়েতে রঙখেলায় অংশ নিয়ে আগের দিন সে গ্রাম থেকে ফিরেছে, তার গায়ের বিভিন্ন স্থানে লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ তখনো স্পষ্ট। স্কুলের মাঠে আমরা দুজন যখন আমাদের তুলনায় বিশালাকার মানচিত্রের সামনে বিস্ময়মাখা চোখ নিয়ে দাঁড়ালাম তখন আশেপাশে আর তেমন কেউ ছিল না এবং আমরা হঠাৎ খেয়াল করলাম মানচিত্রের ওপর কয়েকটা পায়ের আঘাতে বিভিন্ন স্থানে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হঠাৎ দেখি হেডমাস্টার সাহেব কয়েকজন টিচারকে সঙ্গে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে মানচিত্রের দিকে এগিয়ে আসছেন। বুঝতে পারলাম মানচিত্র ভাঙার খবর কানে চলে গেছে এবং তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত। ওখানে ছিলাম বলে আমরা দুজন সন্দেহভাজনের খাতায় চলে এলাম। শরিফের গায়ে রঙের দাগ সন্দেহকে তীব্রতর করে তুলল। আমাদের ধরে আনা হলো হেডমাস্টারের রুমের বারান্দায়, সামনে জড়ো হয়ে গেল শতশত বালক- বালিকা। প্রথমেই শরিফের ওপর গোট্টাগাট্টা হেডমাস্টারের গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে বেত্রাঘাত আর স্বীকারোক্তির জন্য হুঙ্কার। মার সহ্য করতে না পেরে বেচারা মিথ্যা বলে ফেলল যে সে ভেঙেছে মানচিত্র। এরপর হেডমাস্টার সাহেব আমার দিকে চেয়ে হুঙ্কার দিলেন আমি ভেঙেছি কি না জানতে। আমি বারবার বলতে থাকলাম যে, আমি ভাঙি নাই, শরিফও ভাঙে নাই। এখন চিন্তাকরলে অবাকই লাগে ওই বয়সেও হেডমাস্টারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বন্ধুর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এর মূল্য দিতে হয়েছিল চড়া দামে। শরিফ স্বীকার করেছে যে সে ভেঙেছে তারপরও আমি কেন বলেছি যে সে ভাঙেনি একথা শুনে হেডমাস্টার উন্মত্ত হয়ে উঠলেন, আমার চুলের মুঠি ধরে আমার মাথাটা তাঁর দুই হাঁটুতে গুঁজে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার পিঠে অবিরাম কিল মারতে থাকলেন। চারিদিকে তখন পিনপতন নীরবতা, শত শত ছাত্রছাত্রীর চোখ তখন আমার দিকে তাক করা। আমার সাথে একই ক্লাসে পড়া ফর্সা আর জাপানিদের মতো চোখওয়ালা সুন্দর মেয়েটি, যে কি না মাঝে মাঝে এসে আমার পাশে বসত, যার নাম আজ আর মনে নেই, সেও কি দেখেছিল আমার সেই অপমান তা আর জানার চেষ্টা করিনি কোনোদিন। মানচিত্রকে অসম্মান একজন মানুষকে যে কত নির্দয় করে তুলতে পারে শিশু বয়সেই সেই হেডমাস্টার তা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মানচিত্র বিষয়ক এই ট্রমা আমাকে তাড়া করে ফিরেছে পরবর্তী বহু বছর, ভাগ্যের কী পরিহাস আজকে আমি এই মানচিত্র নিয়ে লিখতে বসেছি।

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে একবার সিলেটে বেড়াতে গিয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া সীমানা অঞ্চলে গিয়ে জানলাম যে, চারপাশের মনোরম পাহাড় আর ঝর্ণার সবই ভারতের অংশ। কষ্ট পেয়েছিলাম জেনে। পরে জেনেছি, কলকাতা এবং মুর্শিদাবাদও আমাদের মানচিত্রে যুক্ত হবার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। আবার কিছু কিছু অঞ্চল যুক্ত হবার কথা ছিল না কিন্তু হয়েছে। এই মানচিত্র তবে কে এঁকে দিল? কবে? কোন কোন বিবেচনা থেকে? এমনসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম যে, ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এর দেশভাগ তথা ভারতবর্ষ-বিভাগ তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানচিত্র নিয়ে প্রশ্নের অনেক উত্তর। আমাদের মানচিত্র তৈরির ইতিহাস যুগপৎ পরম বিস্ময়কর এবং অনেক ক্ষেত্রেই মর্মান্তিক।

১৯৪৬ সালে কুখ্যাত কলকাতা-দাঙ্গার পরে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে অখণ্ড ভারত আর বোধহয় টিকবে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা প্রায় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন ভারতবর্ষ এক রাখতে, দুশো বছর শাসন করার পর হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ফেলে রেখে গেলে যে-ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তার দায় ব্রিটিশ জাতিকে বহন করতে হবে – এই আশঙ্কায় তিনি চাইছিলেন ক্ষমতা হস্তান্তর খানিকটা বিলম্বিত করতে এবং তিনি এও জানতেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তর অনিবার্য। Wavell : The Viceroy’s Journal, edited by Penderel Moon বইটিতে এ-বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে। সেই সময় বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে ঘটে চলেছে বিরাট সব পরিবর্তন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নির্বাচনে ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন লেবার পার্টির অ্যাটলি। লেবার পার্টি ব্রিটিশ জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, দীর্ঘ বিশ্বযুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকদের নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে, কাজেই যেভাবেই হোক ভারতবর্ষ থেকে বিপুলসংখ্যক সৈন্য প্রত্যাহার তাদের জন্য রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছিল। অ্যাটলি তখন ওয়াভেলকে সরিয়ে তাঁর স্থানে চৌকষ নৌসেনাপতি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ‘ছেদন ও পলায়ন’ বা ‘cut and run’ মিশন দিয়ে ভারতে পাঠালেন।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারলেন যে জিন্নাহ তথা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি যদি ভারতীয় কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলেই কেবল তাঁর কাজ সহজ হয়ে যায়, যদিও ভারতীয় কংগ্রেস ছিল দেশভাগের ঘোর বিরোধী। একপর্যায়ে নেহেরু তথা কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা পার্টিশন বা ভারতভাগ মেনে নিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীও মেনে নিলেন বা মানতে বাধ্য হলেন, যদিও তিনি একসময় বলেছিলেন, দেশভাগ হবে তাঁর শবদেহের ওপর দিয়ে।

শুরু হলো ভারতবর্ষের মানচিত্র কর্তন, অন্যভাবে বলতে গেলে মানচিত্র বিনির্মাণের মহাযজ্ঞ। ডাক পড়ল সিরিল র‍্যাডক্লিফ নামক একজন দক্ষ উকিলের, যিনি আগে ভারতে আসেননি এবং রাজনীতি, ভূগোল, অর্থনীতি ও বিশাল জনঅধ্যুষিত এই ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁর জ্ঞান ছিল শূন্যের কোঠায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত দুই প্রান্তের দুটি রাজ্য পাঞ্জাব এবং বঙ্গ ভাগ করা হবে। গঠিত হলো দুটি বাউন্ডারি কমিশন; পাঞ্জাব বাউন্ডারি কমিশন এবং বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন। দুটি কমিশনের প্রতিটিতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ প্রদত্ত দুজন করে কমিশনার নিয়োজিত রইলেন, সবাই আইনজীবী এবং দুটি কমিশনেরই চেয়ারম্যান হলেন স্বয়ং র‍্যাডক্লিফ। কমিশনারগণ কোনো বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছতে না পারলে র‍্যাডক্লিফ যা বলবেন তা-ই মানতে হবে, অনেকটা একব্যক্তিতান্ত্রিক ব্যবস্থা; একে বলা হলো র‍্যাডক্লিফ-অ্যাওয়ার্ড। বিশাল এই উপমহাদেশ ভাগ করতে র‍্যাডক্লিফ সময় পেলেন মাত্র পাঁচ সপ্তাহ, যার অধিকাংশ সময় তিনি ভুগেছেন ডায়রিয়াতে।

পূর্ববর্তী জনমিতি থেকে দেখা হবে কোন কোন তহসিলে হিন্দু বা মুসলমানের সংখ্যা বেশি; যে-তহসিলে হিন্দুর সংখ্যা বেশি সেটা যাবে ভারতের ভেতর আর যেখানে মুসলমান বেশি সেটা যাবে পাকিস্তানের ভেতর – এই ছিল সাধারণ হিসাব। কিন্তু রাস্তাঘাট, রেলপথ, সেচ প্রকল্প, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ, নদীনালা, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি বিবেচনাতে আনতে গেলে এটা আর সাধারণ হিসাব থাকে না, হয়ে ওঠে অসম্ভব নাজুক এবং জটিল এক গবেষণার বিষয়। র‍্যাডক্লিফের অফিস ছিল দিল্লিতে আর কোর্টের হিয়ারিং বসত লাহোরে, তিনি কোনো দিন লাহোর কোর্টে যাননি, প্রতিদিন চার্টার বিমানে করে দলিলপত্র আসত তাঁর অফিসে। তাঁর হাতে যে-মানচিত্র ছিল তাও নাকি হালনাগাদ করা ছিল না।

১৯৪৭-এর ১৪ই এবং ১৫ই আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, অর্থাৎ প্রায় দুশো বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই উপমহাদেশবাসী ব্রিটিশের শাসন থেকে মুক্ত হয়; কিন্তু বিভাজিত নতুন মানচিত্র প্রকাশিত হয় ১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ অর্থাৎ তাদের স্বাধীনতা লাভের দুই-তিনদিন পরে। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত আমাদের নেতারা কেন মেনে নিলেন তার সদুত্তর আমার জানা নেই, তবে তাঁদের এই হঠকারিতার মূল্য দিতে গিয়ে লাখ দশেক মানুষ জীবন দিয়েছে, লাখ দশেক নারী হারিয়েছে সম্ভ্রম আর কোটির ওপরে মানুষ স্বাধীনতা পেলেও চিরতরে উচ্ছেদ হয়েছে তাদের পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে।

যাই হোক এমনিসব বিসদৃশ পরিস্থিতিতে ঘটে চলছিল আমাদের মানচিত্র অঙ্কনের কার্যক্রম এবং র‍্যাডক্লিফ শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অবাস্তব একটি কাজে তিনি নিয়োজিত হয়েছেন। পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, বছর দুয়েক সময় পেলে মোটামুটি সকলের গ্রহণযোগ্য মানচিত্র তিনি হয়তো আঁকতে পারতেন; কিন্তু পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তাঁকে সময় দেয়া হয়েছিল মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। ওই বাউন্ডারি কমিশন দুটিতে কোনো উপদেষ্টা পরিষদ নিয়োজিত ছিল না; খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি ছিল অনুপস্থিত। জাতিসংঘের সাহায্য নেবার প্রসঙ্গ উত্থাপন হওয়া মাত্র নেহেরু তা খারিজ করে দিলেন অযথা বাড়তি সময় ব্যয় হবার অজুহাতে।

এত কিছুর পরেও র‍্যাডক্লিফ যতটা সম্ভব নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। অভিযোগ আছে যে, তাঁর এই কাজে বাদ সেধেছিলেন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন স্বয়ং। পাঞ্জাবের কিছু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল র‍্যাডক্লিফকে চাপ দিয়ে তিনি ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করাতে বাধ্য করেন বলে মনে করা হয়। স্থানগুলো হচ্ছে – ফিরোজপুর, জিরা এবং গুরদাসপুরের অধিকাংশ এলাকা। এর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল গুরদাসপুর তহসিল। গুরদাসপুর তহসিল ভারতে অন্তর্ভুক্ত না হলে ভারত থেকে জম্মু-কাশ্মিরে স্থলপথে যাবার আর কোনো পথ খোলা থাকত না। গুরদাসপুর তহসিল ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবার ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সীমাহীন প্রভাব বিস্তার করে আছে আজ পর্যন্ত। বর্তমান কাশ্মির সমস্যার সাথে মানচিত্র অঙ্কনের সেই ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য। মাউন্টব্যাটেনের যুক্তি ছিল, গুরদাসপুর তহসিল ভারতে অন্তর্ভুক্ত না হলে শিখদের আবাসস্থল চারদিক থেকে মুসলমানদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাবে। ১৯৪৮ সালের ২রা এপ্রিল ইসমে-কে লেখা এক চিঠিতে মাউন্টব্যাটেন লেখেন –

‘I said to him (Radcliffe) the Sikh attitude became worse than we had anticipated and when he was balancing the border of East and West I hope he would bear the Sikh problem in mind and I think I went as far as to say that if he was really satisfied that the overall decision in both East and West was absolutely fair to both then I trusted that any generosity to Pakistan should be more in Bengal than in Punjab since there was no Sikh problem in Bengal.’ (১)

বোঝা যাচ্ছে শিখ-সমস্যা না থাকার কারণে আমরা মানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানিরা কিছু বদান্যতা পেয়ে গেলাম। তিন শতাংশ মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের মানচিত্রে যুক্ত হলো [ওই অঞ্চলের নেতারা যেটা মেনে নিতে পারেনি এবং এর জের এখনো চলমান], হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ খুলনা আমাদের মধ্যে যুক্ত হলো। কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদ আমাদের সাথে যুক্ত হলো না। মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে হুগলী নদীতে পানি পাম্প না করলে হুগলী নদীর নাব্যতা হ্রাস পাবে, বন্ধ হয়ে যাবে কলকাতা বন্দর, ধারণা করা হয় এই কারণে মুর্শিদাবাদ চলে গেল ওইপারে।

১৯৪৭-এর জুলাই মাসে সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এই বিষয়ে যে, তারা পাকিস্তানে যাবে না ভারতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেট পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিলে তা আমাদের মানচিত্রে যোগ হয়, যদিও করিমগঞ্জসহ কয়েকটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা অজানা কারণে ভারতে থেকে যায়। সিলেটের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দেশভাগের পরিধি পাঞ্জাব ও বাংলা ছাড়িয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়।

এমনিসব হিসাব-নিকাশ চলছিল তখন; কিন্তু কোন কোন বিবেচনা থেকে র‍্যাডক্লিফ এই সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার অনেক কিছুই আর কোনোদিনও জানা যাবে না, কারণ ভারত ছাড়ার পূর্বে তিনি মানচিত্রবিষয়ক তাঁর সমস্ত দলিলপত্র আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে চলে যান।

র‍্যাডক্লিফ ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তিনি ভারতে থাকা অবস্থাতে মানচিত্র প্রকাশিত হলে লোকজন তাঁকে আক্রমণ করবে, কারণ কোনো পক্ষকেই তিনি খুশি করতে পারেননি। তবে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, লন্ডনে ফিরে তিনি যখন তাঁর পারিশ্রমিক বাবদ দুই হাজার পাউন্ডের চেকটি পান সেটা তিনি ঘৃণা ভরে ছিঁড়ে ফেলেন।

যেহেতু র‍্যাডক্লিফ ছিলেন আমাদের তথা ভারতবর্ষের মানচিত্র নির্মাণের মূল কারিগর, তাই যাবতীয় অসঙ্গতির জন্য তাঁকে গঞ্জনাও সইতে হয়েছিল বিস্তর। পাকিস্তানি একজন নাগরিক র‍্যাডক্লিফ-এওয়ার্ডকে বলেছিলেন ‘টেরিটোরিযাল মার্ডার’। তবে র‍্যাডক্লিফ তাঁর সাধ্যমতো কাজ করেছেন বলে দাবি করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শেষ হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাঁর সৎছেলেকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছিলেন ‘… Nobody in India will love me for the Award about the Punjab and Bengal and there will be roughly 80 million people with a grievance who will begin looking for me. I did not want them to find me. I have worked, travelled, and sweated…oh I have sweated the whole time.’ (২)

অন্য এক স্থানে তিনি তাঁর প্রতি বিদ্বেষের প্রত্যুত্তরে এই উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘Amazing people. They have absolutely no conception. They asked me to come in and do their sticky business for them and when I had done it they hated it. But what could they expect in the circumstances? Surely they must have realized what was coming once they had decided on Partition. But they had made absolutely no plans for coping with the situation. Strange chaps. Just did not do homework.’ (৩)

আমাদের হোমওয়ার্ক বোধহয় সত্যিই ছিল না। জিন্নাহকে অনেকবার পাকিস্তানের সীমানা সম্পর্কে ধারণা দিতে বলার পরও তিনি নাকি তা দেননি বা দিতে পারেননি, যদিও মানচিত্র প্রকাশ হবার পরে তিনি এটাকে বলেছিলেন – পোকায় কাটা পাকিস্তান (‘moth-eaten Pakistan’)।

অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেন ২৪শে মার্চ ১৯৪৭ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঘটনা ঘটে চলেছিল অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুতগতিতে। ১৯৪৭-এর ৩রা জুন তিনি তাঁর ‘Partition Plan’ ঘোষণা করেন। ২০শে জুন বঙ্গীয় সংসদে তিন দফা ভোটিং হলো; [মুসলমানরা ভোট দিল যুক্তবঙ্গ নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের সদস্যরা ভারতে যোগ দেবার পক্ষে ভোট দিল, অবধারিত হয়ে গেল বাংলাকে ভাগ করা]। ৮ই জুলাই র‍্যাডক্লিফ ভারতে পদার্পণ করলেন। ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হলো। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার মাসের মধ্যে মামলা শেষ।

সে যাই হোক এত দ্রুততার সাথে ছেদন-কর্তনের মাধ্যমে মানচিত্র নির্মাণের ফলস্বরূপ ১৯৪৭-এর ১৭ই আগস্ট প্রকাশিত হবার পরে তাতে দেখা গেল নানান অসঙ্গতি। সদ্য স্বাধীন দুটি দেশের সীমানার গতিপথ যেন এক দুর্বোধ্য পথ ধরে এগিয়ে চলল। সীমানারেখা আঁকার পরে দেখা গেল কোথাও ভাইয়ের বাড়ি পড়েছে ভারতে তো বোনের বাড়ি পাকিস্তানে; আবার কারো নিজের বাড়ির শোবার ঘর পড়েছে পাকিস্তানে তো রান্নাঘর ভারতে; রেলস্টেশনের ফটক ভারতে তো প্লাটফরম পাকিস্তানে, এমনি সব অসঙ্গতি। অগণিত লোকালয়ের মানুষ, যারা শত শত বছর পাশাপাশি থেকেছে, অবাক বিস্ময়ে দেখল সীমানার গতিপথ অব্যাখ্যাত কারণে তাদের বিযুক্ত করে দিল একে অপরের কাছ থেকে। আর পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য বিষয় হিসেবে শত শত ছিটমহল (enclave) ৬৮ বছরের জন্য আটকে রইল ভিনদেশে। হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ ছিটমহলবাসী কয়েক পুরুষ কাটিয়ে দিল অবর্ণনীয় দুর্গতি-দুর্দশায়। কিছু কিছু আবার ছিল ছিটমহলের ভেতরে ছিটমহল। আর দাহলখাগড়াবাড়ি ছিল ছিটমহলের ভেতরে ছিটমহল তার ভেতরে আবার ছিটমহল। এটাই ছিল পৃথিবীর একমাত্র তিন স্তরের ছিটমহল, অর্থাৎ বাংলাদেশের ভেতরে এক খণ্ড ভারত, তার ভেতর এক খণ্ড বাংলাদেশ, তার ভেতরে আবার এক খণ্ড ভারত। কী আশ্চর্য ব্যাপার! ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার অবসান ঘটাল এই সমস্যার, সেই সাথে মানচিত্রেও ঘটল খানিকটা পরিমার্জনা।

অন্যদিকে আবুল মনসুর আহমদের বর্ণনা থেকে জানতে পারি যে, অনেক নাটকের পর কলকাতা চলে গেল আমাদের মানচিত্রের বাইরে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে নিজের যৌবনকালের স্মৃতিবিজড়িত কলকাতা শহরকে হারানোর ব্যথা বর্ণনা করেছেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।

মানচিত্র তথা সীমানারেখা প্রকাশিত হওয়া মাত্রই তাৎক্ষণিক দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করল পাঞ্জাব সীমান্তে। বিক্ষিপ্ত কিছু দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। একদিকে মুসলমান অন্যদিকে শিখ-হিন্দু। সীমান্তবর্তী মুসলমানরা আশ্রয় নিয়েছিল মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় – যে-অঞ্চল তাদের হিসাবে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবার কথা ছিল আর শিখ ও হিন্দুরা আশ্রয় নিয়েছিল হিন্দু-শিখ অধ্যুষিত এলাকায় যে-অঞ্চল তাদের হিসাবে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবার কথা ছিল। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তারা ভেবেছিল যে, সবাই নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর দুদিন বিলম্ব করে ১৭ই আগস্ট মানচিত্র প্রকাশিত হবার পর সকল হিসাব-নিকাশ ওলটপালট হয়ে গেল। সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতা উদ্যাপনের রেশ কাটতে না কাটতেই বাস্তবতা ধাবিত হলো এক মহাপ্রলয়ের পথে। কোটি কোটি মানুষ আবিষ্কার করল র‍্যাডক্লিফ-এওয়ার্ডের বদৌলতে তারা সীমান্তের ভুল দিকে অবস্থান করছে। শুরু হলো প্রাণভয়ে পলায়ন, বাস্তুভিটা পিছে ফেলে কোটি কোটি মানুষের দেশত্যাগের সে এক অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি; জল-স্থল-আকাশ পথে যে যেভাবে পারল পালানোর চেষ্টা করল আর অধিকাংশ মানুষ পায়ে হেঁটে যাত্রা করল অজানা দেশের উদ্দেশে। সেই সাথে শুরু হয়ে গেল নারকীয় তাণ্ডব। নিরস্ত্র অগণিত অসহায় মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, খুন, নারী অপহরণ, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করা ইত্যাকার ঘটনা ঘটে চলল পাইকারি হারে। মাত্রা কিছুটা কম হলেও বাংলা অঞ্চলেও প্রলয় খুব কম ঘটেনি। এমনিভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ উদ্বাস্তু সৃষ্টি হবার ঘটনার সাথে যুক্ত হয়ে গেল আমাদের প্রিয় মানচিত্র নির্মাণের কার্যক্রম। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের স্রোত, লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম আর কোটি কোটি বাস্তুহারা মানুষের আর্তনাদ মিশে থাকল ওই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে; এই হতভাগ্য মানবসন্তানদের কেউ সিন্ধি, কেউ উত্তর প্রদেশের অধিবাসী, কেউ বাঙালি, কেউ পাঞ্জাবি, কেউ বা আবার বিহারি। ছাত্রজীবনে কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ বই পড়ে মনে হয়েছে এক অবিশ্বাস্য পরাবাস্তব কাহিনি। আজ বুঝতে পারি যে, ওই নারকীয়তার সবই সত্য ঘটনা।

১৯৪৭-এ অঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ২৪ বছর পর একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত প্রায় আড়াই হাজার মাইলের সুদীর্ঘ সীমানা ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল অসামান্যরূপে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের যুদ্ধকৌশল অনুসারে এই সুদীর্ঘ সীমানা বরাবর অবস্থান নিতে গিয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, এতে করে সীমানার ভেতরে তাদের উপস্থিতি কমে যাওয়াতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য তা হয়ে ওঠে একটি বাড়তি সুবিধার কারণ।

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া তিনটি প্রধানতম রাজনৈতিক ঘটনা এবং এই প্রতিটি ঘটনাতেই আমাদের এই বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া এই মানচিত্র নিয়ে আমাদের আবেগ সীমাহীন। কিন্তু আমার ছোটবেলার সেই উগ্র জাতীয়তাবাদে ভোগা হেডমাস্টারের মনোভাব এখন সেকেলে হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর সেই আবেগের সাথে এই অঞ্চলের ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ এখন সময়ের দাবি। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো আজ আর পাশ কাটিয়ে যাবার সুযোগ নেই। আমার শৈশবকে ঋদ্ধ করেছে যে-সব নদী সেগুলোসহ আরো অসংখ্য নদী হিমালয় থেকে অনবরত বিপুল পলিসম্ভার নিয়ে ছুটে চলেছে আজো বঙ্গোপসাগরের পানে। সাগরের বুকে জেগে উঠছে নতুন জমিন।

একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরগর্ভে ভূমি বিলীন হবার আশঙ্কা, অন্যদিকে সাগরবুকে নতুন চর জেগে ওঠার বাস্তবতা; স্বপ্নের বাংলাদেশের মানচিত্র এক শতাব্দী পরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভবিষ্যৎই বলে দিতে পারে কেবল।

তবে আজ যখন আবার মানচিত্র খুলে বসি, আবার তাকাই বাংলাদেশের দিকে, আমার ছোটবেলার সেই স্বপ্নের বাংলাদেশকে পুরোপুরি আর পাই না। এই মানচিত্রের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে পৃথিবীর প্রশস্ততম এবং দীর্ঘতম একাধিক নদী। জালের মতো এতে ছড়িয়ে আছে আরো অসংখ্য নদনদী, তাদের শাখা-প্রশাখা। যে- নদীর বানের জলের আর্দ্রতায় আমার শৈশবের স্বপ্নরা ডালপালা বিস্তার করেছিল, সেই নদীনালা আজ তাদের নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে, পানিও হয়েছে কলুষিত। মানচিত্রের দাগ তো কেবল জমি স্পর্শ করেনি, এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে নদীর প্রবাহকেও। সীমান্তের ওপারের অতিকায় বাঁধগুলো গলা টিপে ধরেছে হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলা নদীর প্রবহমানতাকেও। সীমান্তের ভেতরেও নদীর বাঁধের মহিমায় ঢাকার কলাকোপা-বান্দুরা এলাকায় অবস্থিত আমার নানুর বাড়ির গ্রাম আর প্লাবিত হয় না। টলটলে পানিতে ডুবসাঁতার, বর্ষার একমাত্র বাহন হিসেবে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাওয়া, মামাদের সাথে নিয়ে সারাদিন মাছ শিকার, দলবল নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে যাওয়া আজ আর হয় না, সেই জলজ জীবনের দৃশ্যপট আজ অতীতের দীর্ঘশ্বাস। তখন বর্ষায় বাড়িতে মেহমান আসত নৌকায় চড়ে, ভিক্ষুক আসত মাটির চাড়ি বেয়ে, নানান পসরা সাজিয়ে আস্ত দোকান এসে বাড়ির ঘাটে ভিড়ত নৌকা হয়ে – ওইসব স্মৃতি এখন পরাবাস্তব রূপ নিয়ে কেবল স্বপ্নেই হানা দেয়।

 

রেফারেন্স

১, ২, ৩ Pangs of Partition, volume-I, Article by V.N. Datta/ edited by Settar-Gupta/ MANOHAR.

 

লেখক পরিচিতি: তৌফিকুর রহমান খান

পেশায় একজন স্থপতি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ থেকে বি.আর্ক ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে মেট্রোপলিস আর্কিটেক্টস-এর প্রধান স্থপতি হিসেবে কর্মরত। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সম্পাদক সেমিনার ও সম্মেলন পদে নিয়োজিত। আগ্রহের বিষয় স্থাপত্য, সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024