মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৯ অপরাহ্ন

জিম্মিদশা থেকে মুক্তির এক মাস পর স্বজনদের কাছে ফিরলেন এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৫.৫৮ পিএম
জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পর মট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর ২৩ নাবিক

“একবার ভেবেছিলাম কলিজার টুকরাকে ফেরত পাবো না। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা ছিল। বড় বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে ফিরেছে আমার বুকে। আর কারো পরিবার যাতে এই পরিস্থিতিতে না পড়ে সে দোয়া করি” কথাগুলো বলছিলেন ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জোস্না বেগম।

ভারত মহাসাগরে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়ার একমাস পর এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক দেশে ফিরেছেন মঙ্গলবার। স্বজনের ফেরায় আবেগাপ্লুত তাদের পরিবারের সদস্য এবং পরিজনেরা।

চলতি বছরের মার্চ মাসের চার তারিখে সাগরে যাত্রা করারএক সপ্তাহ পর ১২ই মার্চ জলদস্যুর কবলে পড়েছিলেন এই নাবিকেরা।

আজ অর্থাৎ ১৪ই মে বিকেলে চট্টগ্রামের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে পদার্পনের পর নাবিকেরা বলেছেন, যেন নবজন্ম পেয়েছেন তারা।

জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জোস্না বেগমের সাথে বিবিসি বাংলার যখন কথা হয়, তিনি তখন জেটিতে জাহাজ ভেড়ার অপেক্ষা করছেন। জাহাজের ডেকে ছেলেকে ততক্ষণে দেখতে পেয়েছেন তিনি।

উচ্ছ্বাস তখন তার গলায়। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “ও হাত নাড়ছে আমাকে দেখে , মনে হচ্ছে আমার জীবনে এর চেয়ে ভালো দিন আর আসে নাই।”

জিম্মি-দশা থেকে মুক্ত নাবিকদের ফেরত পেয়ে আবেগে আপ্লুত স্বজনদের অনেকেই দেশে ফেরা স্বজনদের বরণ করে নিতে হাজির হয়েছিলেন জেটিতে।

অপেক্ষার পালা শেষ হলো ২৩ নাবিক ও পরিবারের

নাবিকদের মুক্ত করে নিতে পরিবারগুলো ছিল অধীর অপেক্ষায়। এমভি জাহান মনি বন্দরে পৌঁছানোর পর নাবিকদের স্বজনরা কেউ কেক, কেউবা ফুল নিয়ে বরণ করে নিয়েছেন নিজের প্রিয়জনকে।

কোন কোন নাবিককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।

নাবিকদের স্বজন ছাড়াও বন্দরে উপস্থিত ছিলেন জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এ সময় টেলিভিশনে কথা বলেছেন নাবিকরা।

এমভি আব্দুল্লাহ’র ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদ বলেন, “ ২৩ জন নাবিককে আগলে রেখেছিলাম। বিভীষিকার পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হবো বিশ্বাস ছিলো।

কিন্তু একটা জাহাজ গেলে তার লোকসান হয়তো মানা যায় কিন্তু একটা প্রাণ গেলে ফেরানো যাবে না কোনভাবেই।

তাই সবসময় সব ক্রুদের দস্যুদের থেকে নিরাপদে আগলে রাখার কথা ভাবতাম”।

“এই দিনটা খুবই স্পেশাল আমাদের জন্য। দীর্ঘ ৩৩ দিন যে সময়ের মধ্য দিয়ে গেছি তার অবসান হলো ” চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের ডেক থেকেই বলছিলেন একজন নাবিক।

কোন কোন নাবিক জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হবেন না একসময় এমন আশঙ্কাও করেছিলেন সে কথাও উল্লেখ করেন।

বিকেলে ২৩ নাবিককে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ফেরে জাহাজটি

‘এই দিনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করছিলাম’

জিম্মি দশা থেকে মুক্ত আরেকজন নাবিক বলছিলেন “ এই দিনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করছিলাম। ফিরতে পারবো কি না পরিবারের কাছে এ শঙ্কায়ও ছিলাম।

অবশেষে দেশে ফিরলাম। দূর থেকে দেখছি আমার পরিবারের সদস্যদের। মনে হচ্ছে আমারও নতুন জন্ম হয়েছে।”

দস্যুরা কিভাবে পাহারা দিতো তা বলতে গিয়ে একজন নাবিক বলেন, বন্দিদশার প্রথম কয়েক দিন ভয়াবহ অবস্থায় ছিলেন তারা।

তিনি বলেন, “শুরুর দিকে আমরা ব্রিজে অবস্থান করতাম। তারা সবসময় ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের পাহারা দিতো।

তারা যাতে খারাপ ব্যবহার না করে সেজন্য আমরা তাদের সাথে খুবই ভালো আচরণ করি। একটা সময় দস্যুরা আমাদের সাথে একটু সহজ হলেও সবসময় পাহারা দিতো” ।

“এটা একটা খারাপ সময়। বিভীষিকায় দিন ছিলো পুরা একটা মাস। দ্রুত শেষ হয়েছে এজন্য স্বস্তি। ওই দিন আর মনে করতে চাই না ” বলেন জিম্মি-দশা থেকে মুক্ত নাবিকদের একজন।

নাবিক আজিজ বলেন, “যেহেতু এই কোম্পানির একটা জাহাজ আগে এরকম পরিস্থিতি থেকে তিন মাসে মুক্ত হয়েছিল।

তাই একটা সময় আমার মনেও ভরসা জাগে। একমাসেই আমাদের মুক্ত করা হয়েছে সে জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ”।

ভাইকে বরণ করে নেয়ার পর ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বড় ভাই ওমর ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এ ধরনের পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়েছিলাম আমরা।

আর কারো পরিবার যাতে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি না হয়। রোজার ঈদ করতে পারি নি। আমাদের পরিবারের জন্য আজ ঈদের দিন”।

অপহরণের শিকার হয়েছিল জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ

নতুন নাবিকদের দায়িত্ব অর্পণ

সোমবার সন্ধ্যায় জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় এসে নোঙর করে।

মঙ্গলবার সকালে এমভি আব্দুল্লাহর দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন ২৩ জন নাবিক। দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া নাবিকেরা নতুন নাবিকদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন।

পরে প্রায় সাড়ে ১১টা নাগাদ নাবিকরা এমভি জাহান মনি জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্য রওনা দেন।

জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাওয়া এমভি আব্দুল্লাহ’র জেনারেল স্টুয়ার্ড নুর উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাড়ে ১১টায় আমরা কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি।”

এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি -১ জেটিতে পৌঁছে গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নাবিকদের বরণ করে নিতে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। নাবিকদের স্বজনরাও সবাই এখন বন্দরে রয়েছে।”

“এর আগে সকালে তারা নতুন নাবিকদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন,” বলেন মি. করিম।

জিম্মিদশা থেকে দেশে ফেরা

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে এমভি আব্দুল্লাহ ৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে গত ৪ঠা মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা হয়। ১৯শে মার্চ আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে জাহাজটির পৌঁছানোর কথা ছিল।

মাপুতু থেকে রওনা হওয়ার পর গত ১২ই মার্চ ভারত মহাসাগরে ২৩জন নাবিকসহ জাহাজটি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল।

এরপর জলদস্যুরা মুক্তিপণ দাবি করে জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রায় ২০ দিন ধরে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা চলে জাহাজ কর্তৃপক্ষের।

মালিকপক্ষ হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিপণ ফেলে দিয়ে আসে। জিম্মি হওয়ার দীর্ঘ ৩৩ দিন পর গত ১৩ই এপ্রিল মধ্যরাতে জাহাজটি থেকে নেমে যায় সোমালিয়ান জলদস্যুরা।

মুক্ত হওয়ার আট দিনের মাথায় গত ২১শে এপ্রিল বিকালে নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ দুবাই পৌঁছান।

জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের জেটিতে ভিড়ে ২২শে এপ্রিল।

এরপর ওই বন্দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খালাসের পর নতুন ট্রিপের পণ্য চুনাপাথর লোড করতে ইউএই’র মিনা সাকার বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজটিকে।

সেখানে ৫৩ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে এমভি আব্দুল্লাহ গত ৩০শে এপ্রিল দেশের পথে রওনা হয়।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024