মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
‘শেষ পর্যন্ত বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হালো তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম এ যাত্রায় বিছানা-বালিশ জব্দ করার পালাটা আরো বেশ কিছুদিন ধ’রে চলবে।’
বড় বড় চোখে রজুর দিকে তাকালো থোকা। বললে, ‘কি বলতে চাস পষ্টাপষ্টি ব’লে ফ্যাল। এমনভাবে রোয়াব দেখাচ্ছিস যে এসবে তোর রাজ-রাজেশ্বরীর মাথাটা একেবারে কাটা যায়।’
‘আরেথাস। অমনি তা-ছোটা মুরগির মতো ঝটপটানি শুরু হ’য়ে ‘দ্যাখ রঞ্জু, বেশি ফাজলামি মারবি না ব’লে দিচ্ছি! দিন দিন তোর পাকামির মাত্রাটা অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে; বড়-ছোটর মান্য নেই। কি ঠাউরেছিস আমাকে?’
‘তোর মাথায় নির্ঘাত ছিট হয়েছে। তোষক-বালিশে তা দিয়ে যে হারে ন্যালাখ্যাপার মতো ছারপোকার বংশবৃদ্ধি ক’রে চলেছিস তাতে কোনো ভদ্রলোক আর এ বাড়ি মাড়াবে না।’
‘বুঝেছি। তাতে তোর বেজায় লোকসান।’
রঞ্জু হেসে বললে, ‘রাখ, চান্স পেলে কানকো মারা বের করবো একদিন। চোত মাসের কই কোথাকার।’
মায়ের কথা মনে পড়লো খোকার ঝট ক’রে। খুব ছোটবেলায় তার লিকলিকে হাত-পা আর হাড় জিরজিরে শরীরের তুলনায় বেঢপ হেঁড়ে- মাথার জন্যে যশুরে কই ব’লে ডাকতো মা, ওটা নাকি বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলার নাম। কিন্তু রজু–কোথা থেকে এসব পায় রঞ্জু।
বিছানার ময়লা চাদরের খুট ধ’রে জাল টেনে তোলার মতো ধীরে ধীরে খুব সন্তর্পণে তুললো সেটা রঞ্জু। অভিধানসহ ইংরেজি-বাংলা গোটা তিনেক বই, সিগ্রেটের প্যাকেট, দেশলাই, খোকার ব্যবহৃত গুচ্ছের
আলতু-ফালতু জিনিশ জালের সুতো থেকে মাছ বাছাই করার মতো একটা একটা ক’রে টিপয়ের উপরে রাখলো। চাদরটা মেঝেয় ছুড়ে দিয়ে বালিশের গায়ে ময়দা ঠাসার মতো ক’রে ঘুসি বসালো কয়েকটা। তারপর এপিঠ-ওপিঠ থাবড়া মেরে সেটাকে যথাস্থানে রেখে বিছানার তলা থেকে দলামোচড়া রুমাল, হিজিবিজি কাটা কাগজ, এটা-সেটা টেনে বের করতে করতে বললে, ‘নাহ্, সত্যি তোকে এ বাড়িতে এক্কেবারেই মানায় না; তুই বরং–”ই-য়াহ্! পোয়াবারো আর কি তোমার! একটা কাঁট বেল্লিক!’
‘অতো ঝাল লগড়াচ্ছিস কেন আমাকে নিয়ে? তোর মতো এই এলুম ব’লে মাঝরাতে দেবদাস হ’য়ে ঘরে ফিরি না, আবার গাঁটে গাঁটে রসবাত না ধরা পর্যন্ত একনাগাড়ে পাঁচ-সাতদিন বিছানায় সাঁতারও দিই না, চোর-চোট্টা-হাজতীর মতো আমার দাড়ি-গোঁফও নেই, দাঁতে মাখনের পলেস্তারাও জমে না তোর মতো! ইশ, গায়ের বোঁটকা গন্ধ নিয়ে, দাঁত না মেজে, দাড়ি না কামিয়ে, পানি না ছুঁয়ে থাকিস কি ক’রে? তোর মতো পিপুফিশু আমি কোথাও দেখিনি।’
‘কী-ইবা এমন দেখেছিস তুই, বয়েস তো আধপাতা! বেশি গার্জেনি ফলাতে আসবি তো শালার ক’ষে এইসা রদ্দা লাগাবো যে ফিয়াসের নামতক ভুলে যাবি।’
‘কি বললি?’
‘ফিয়াসে ফিয়াসে! কেন মুরগির মগজে ঢোকেনি বুঝি? জানি মানে ভাতারের নাম নজ্জায় ধরি না, রাখ, তোর ন্যাকামি একদিন বার করবো!’
Leave a Reply