স্বদেশ রায়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ মে গণভবনে অর্থমন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবি্আর এর শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারনীদের সঙ্গে মিটিং এ আগামী বাজেট সংকোচন মূলক ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের পক্ষে বাজেট করার জন্যে বলেছেন।
২০২০ সালে কোভিডের সময়ই একটি পোর্টালে লিখেছিলাম, এ বছর বাজেটটি দুটিভাগ ভাগ করে দিলে মনে হয় ভালো হয়। কারণ, কোভিডের ভেতর অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নতুন রূপ নিতে পারে। তাই আমাদের মতো দেশের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এছাড়া ২০২১ সালেও এমনি সংকোচন মূলক বাজেটের কথা লিখেছিলাম। কারণ, তখন একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো, কয়েকটি দেশ তাদের উন্নয়ন যাত্রার গতির ফলে অনেক বেশি জ্বালানি কিনবে, তাই পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, জ্বালানির দাম বাড়বে।
আর জ্বালানির দাম বাড়লে ছোট দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বেই।
অন্যদিকে কোভিডের সময় পুনরায় পৃথিবীর মহামারীর ইতিহাসগুলো পড়তে পড়তে আবারও যে বিষয়টি বেশি চোখে আসে তাহলো যে কোন মহামারীর ভেতর দিয়ে পৃথিবীতে শিল্প ও ব্যবসায় একটা রূপান্তর আসে।
আর এই নতুন যাদের উত্থান ঘটে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরোক্ষ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ব্যবসা দখল করার জন্যে যু্দ্ধ সহ নানান উপাদানকে ব্যবহার করে।
তাই ২০২১ সাল থেকে যে পৃথিবীর অর্থনীতি একটা বাঁক নিয়ে নতুন দিকে যাবে সেটাও অর্থনীতির জ্ঞানে নয়, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মহামারীর ইতিহাস অনেকটা স্পষ্ট করে দিচ্ছিলো। তা্ই সে সময়েও ২০২১- ২২ এর বাজেট সংকোচন মূলক বাজেট, বিশেষ করে প্রকল্প গ্রহন যাতে কোন মতেই অপ্রয়োজনীয় না হয় সেটা উল্লেখ করে লিখেছিলাম।
তাছাড়া সে সময়ে দেশীয় অর্থনীতিতে আরেকটি ভয় সামনে চলে এসেছিলো, সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমানে তাদের সঞ্চয় তুলে নেবে। কারণ, কোভিডে অনেকের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে, ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। তারা এখন তাদের পরিবার পরিচালনার জন্যে সঞ্চয় ভাঙ্গবে। অর্থাত্ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেবে।
এ সময়ে ব্যাংকগুলো যাতে সবল থাকে, অর্থাত্ ব্যাংকে যথেষ্ট পরিমান অর্থ থাকে সেজন্য ওই লেখায় ঋন খেলাপিদের কাছ থেকে ঋন আদায়ের বিষয়টি কঠোর করার মত দেই।
পরবর্তীতে দেখা যায়, ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী ভিন্ন পথ নেন। তিনি বাজেটকে ঢালাওভাবে আরো প্রসারিত করেন এবং ঋন খেলাপিদের ঋন কার্পেটের নিচে লুকানোর জন্যে ২% পেমেন্টে এ রিশিডিউল করে ব্যাংকে টাকা ফেরত আনার পথ আরো বন্ধ করে দেন। তাছাড়া পাশাপাশি দেখতে পাই কয়েক অর্থনীতিবিদ যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পদে ছিলেন, তারা লেখালেখি করতে শুরু করলেন, কোভিডে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোন ক্ষতি হয়নি। স্বাভাবিকই তখন আমাদের মত সাধারণ সাংবাদিকদের চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
এরপরে হঠাৎ দেখা গেলো ২০২৩ এ ওই অর্থনীতিকরা সরকারকে আমদানী সংকোচন সহ নানান সংকোচন নীতির পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে তারা কি পরামর্শ দিলেন, সেটা বড় নয় সরকারও আমাদানী সংকোচন নীতি গ্রহন করে। এবং কিছুদিনের মধ্যে ব্যাংক ও রিজার্ভ দুই এর চিত্র প্রকাশ পেতে থাকে।
অর্থনীতিবিদ ও যারা সরকারি পদে থাকেন তারা ভালো বলতে পারবেন- তবে মহামারী বা বড় যুদ্ধোত্তর অর্থনীতির গতি প্রকৃতির ইতিহাস এবং বর্তমানে অনান্য কিছু দেশ যারা ২০২০ থেকে অনেক কিছু সংকোচন করার নীতি নিয়েছিলো, তাদের কাজ পর্যালোচনা করে বলা যায়, ২০২০ থেকে সংকোচন মূলক নীতি গ্রহন করলে আজ অর্থনীতির স্বাস্থ্য বর্তমানের থেকে ভালো থাকতো। এবং এতটা আমদানী সংকোচন নীতি করতে হয়তো হতো না, রিজার্ভের অবস্থাও এর থেকে ভালো থাকতে পারতো। এমনকি ২০২৩ অবধি প্রায় যে ২৫ ভাগের মত ঋন নেয়া হয়েছে এগুলোও তখন আরো পর্যালোচনা করে নেয়ার সুযোগ হতো।
এর বিপরীতে হঠাৎ কঠোর সংকোচন মূলক নীতিতে চলে গিয়ে দৃশ্যত মনে হচ্ছে ডলার বা রিজার্ভ রক্ষা হচ্ছে। কিন্তু আমদানীর সঙ্গে তো উৎপাদনও জড়িত। কাঁচামাল আমদানীতে বাধা পড়লে তো উৎপাদন ও রফতানি কমে যাবে বা তাতে বাধা পড়বে। তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও কমে যাবে। আর যখনই কঠোর সংকোচনমূলক নীতি গ্রহন করা হয় তখন তো আর তা শুধু বিলাস পণ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা কাঁচামাল আমদানীর ওপর গিয়েও পড়ে পরোক্ষভাবে। কারণ তখন বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার ওপর একটা বাধা নিষেধ এসে যায় বা কঠোরতা আসে। উত্পাদনের ক্ষেত্রে কিছু না হলেও এটা সময় ক্ষেপন তো হয়। সেটাও বড় ঘাটতি সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে আরো একটি বিপদ ঘটে দেশের অর্থ তখন একটি শ্রেনী বিদেশে গিয়ে ব্যয় করে। কারণ যে শ্রেনীটি বিলাস পন্য কেনে তার ভেতর যে গুলো বহনযোগ্য সেগুলো তার নানা কারণে যখন বিদেশে যাচ্ছে সে সময় কিনে আনে। তাই সংকোচন নীতি বলতে শুধু আমদানীতে সীমাবদ্ধ করে ফেললে তার একটা বড় অসুবিধা থেকেই যায়।
যাহোক, পৃথিবীর অর্থনীতির ইতিহাস বলে, কোন দেশের অর্থনীতি কখনও অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেননি। অর্থনীতিবিদরা ব্যাখা বিশ্লেষন করে সেটা পরবর্তীতে বুঝিয়েছেন। অর্থনীতির স্বাস্থ্য যখন খারাপ হয় সে সময়ে তা সুস্থ করার দ্বায়িত্ব পড়ে বা সুস্থ করে থাকেন রাজনীতিবিদরা বা রাষ্ট্র পরিচালকরা অর্থনীতিবিদরা তাদের সহায়ক হন।
সরকার প্রধান এবারের বাজেটের আগে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। এক, তিনি একনেকের মিটিং -এ বলেছেন অপ্রোজনীয় প্রকল্প গ্রহন না করার কথা।দুই, বাজেট প্রননয়কারীদের মিটিং এ নির্দেশ দিয়েছেন সংকোচনমূলক বাজেট করার জন্যে।
সংকোচনমূলক বাজেটের কথা শুনে প্রথমত মনে হতে পারে এবারের বাজেটের আকার গতবারের থেকে ছোট হবে। বা্স্তবে সেটা নয়, যেহেতু অর্থনীতির আকার বেড়ে গেছে তাই স্বাভাবিকই গতবারের থেকে বাজেট বড় হবেই। তবে সেটা অপ্রয়োজনীয় বড় নয়।
বাস্তবে এ মুহূর্তে প্রকৃত সংকোচনমূলক নীতি বলতে অর্থনীতিতে যে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু বিষয় ঢুকে গেছে সেগুলোকে বন্ধ করা। যেমন, গত অর্থমন্ত্রী ঋন খেলাপিদের যে অর্থ কার্পেট চাপা দিয়ে রেখেছেন সেগুলো বের করে আনতে হবে। ওই অর্থ বের করে আনলে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা কাটবে। কারণ, এ মুহূর্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থনীতির গতি প্রবাহের জন্যে। দুই, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহন না করার জন্যে। ঋণ খেলাপি যেমন কোন একটি গোষ্টির স্বার্থে তাদের গায়ে পরিস্কার কাপড় পরার সুযোগ পেয়েছে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও কোন কোন গোষ্টির স্বার্থে নেয়া হয়। এই গোষ্টিগুলো সরকার ও সরকারের বাইরে দুই জায়গাতেই থাকে। এদেরকে নিষ্ক্রিয় করা কঠোর বাজেটের শর্ত। কারণ, বাজেট তো আর আয় ব্যয়ের হিসাব নয় – বাজেট মূলত রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি। এর পাশাপাশি আর যে সংকোচনের বিষয়টি এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাহলো, একশ্রেনীর জনপ্রিনিধিদের অবিবেচক ও নিজস্ব স্বার্থে নেয়া প্রকল্প গ্রহন না করার চাপ বন্ধ করা। তারা প্রধানমন্ত্রীর ওপর এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ দেয় ঠিকই। সে চাপের মূল্য কি দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে? বাস্তবে খুব কম জন প্রতিনিধির বর্তমানে সেই রাজনৈতিক চাপ দেবার ক্ষমতা আছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা ছাড়া শতকরা নব্বইভাগ জনপ্রতিনিধি’র পার্লামেন্টে আসার ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে বার বার নির্বাচন পার করে আনছেন। তাই এই সকল জন প্রতিনিধিদের গনণায় না নিয়ে বর্তমানের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরনের জন্যে প্রকৃত কঠোরতার মাধ্যমেই এবারের বাজেট প্রণয়ন ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহন করা দরকার।
কারণ, এ মুহূর্তে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের এনে যে রেললাইনে দেশ উঠেছিলো ওই রেল লাইনে আবার তা যাতে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করা।
লেখক, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
খুবই সময়োপযোগী, তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণাত্মক লেখা। জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট উত্তোরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রভাব ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ লেখায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আসু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যেরও উল্লেখ আছে। এ লেখা বাজেট প্রনয়নের সাথে সংশ্লিষ্টদের জন্য ইতিবাচক দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।