শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন

মার্চের আগুন ও অশুভের ছায়া

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ৫.৩১ পিএম

মার্চের আগুন ও অশুভের ছায়া

আসাদ মান্নান

তেইশ বছর নয় শুধু হাজার শতাব্দী ধরে

কী দুঃসহ শোষণে পেষণে জর্জরিত রাম-রহিমের

বাংলার মাটি ও তার জীর্ণ শীর্ণ নিরন্ন মানুষ!

সবুজ বনানী থেকে শুরু করে পাটের আড়ং

হাড্ডিসার কৃষকের কষ্টে বোনা জীবনের বীজ

নদী নালা খাল বিল হাওরের শালুক পাপিয়া

লাশ হয়ে ভেসে গেছে পঁচা গলা ভাসানের জলে

যে যায় এমন করে চলে যায় অদৃশ্য গাঙুরে!

ঝড়ে ও ঝঞ্ঝায় ভাঙাচোরা বাতিঘরে নেমে আসে

কৃষ্ণপক্ষ; মুরগির খাঁচায় অন্ধকারে ঢুকে পড়ে

বর্ণচোরা চতুর শিয়াল-ঘাপটি মেরে বসে থাকে

ঘুমন্ত চাষার অগোচরে; মুরগী খাওয়া শেষ হলে

শিয়ালেরা অতঃপর সুযোগেই মানচিত্র খাবে:

রাত্রি শেষে ধীরে ধীরে সূর্য উঠবে- শিয়াল পালাবে।

বুকে তীব্র হাহাকার; রক্তশূন্য এক জনপদে

শকুন- শকুনি আর শাপগ্রস্ত পঙ্গপাল ওড়ে;

জরাগ্রস্ত জন্মভূমি, ঘরে ঘরে অভুক্ত শিশুর

ক্ষণে ক্ষণে মর্মভেদী কী করুণ কান্নার আওয়াজ:

অন্ন নাই বস্ত্র নাই, পথ্য বলে কিছুই ছিল না।

এমন বিপন্ন এক হতশ্রী দেশের জলাঙ্গিনী

এক অবহেলিত দুর্গম গাঁয়ে এক শুভক্ষণে

বনেদী শেখের ঘরে শতবর্ষ আগে জন্ম নেয়া

অপূর্ব সুন্দর আর দূরন্ত খোকার প্রাণে তাই

অভাগা মায়ের জন্যে জন্মে কালজয়ী দেশপ্রেম;

রবীন্দ্রনাথের গানে কে তাকে গোপন মন্ত্র দেয়?

দেশটাকে ভালোবেসে গেয়ে ওঠো কালজয়ী গান –

ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা;

একদিন তুমি মুক্তি পাবে, মুক্ত হবে তোমার আকাশ।

তারপর রক্তগামী ইতিহাসে অগ্নি জ্বেলে জ্বেলে

এ কোমল মৃত্তিকায় উঁচু মাথা ঠেকাতে ঠেকাতে,

কারাগার থেকে কারাগারে যেতে যেতে একদিন

দীর্ঘদেহী খোকা সব শোষিতের প্রিয় নেতা হলো

অতঃপর বঙ্গবন্ধু; তার চির সমুন্নত শির-

আকাশ বিদীর্ণ করে মুক্তিদূত স্বরূপে দাঁড়ান:

হিমালয় নত হয়ে মাথা ঠুকে তাঁর পদতলে;

বুকে তাঁর বহে চলে কত শত দুর্বিনীত নদী!

একটা সোনার দেশ আর তার স্বাধীন নীলিমা

আবেগী শিল্পীর মতো স্বপ্ন দিয়ে আঁকতে গিয়ে তিনি

কাটালেন সহস্র বিনিদ্র রাত, দিনের উত্তাপ;

এ মাটি মায়ের মতো মিশে আছে তাঁর দেহ-মনে,

আকাশ জড়িয়ে বুকে চোখে তাঁর নক্ষত্রের আলো:

শপথ নিলেন – এ দেশের মানুষকে মুক্ত করবেন

8

কত যে উর্বর আর শস্যবতী এ বাংলার মাটি!

তা তাঁর নিবিড় চিত্তে মনেপ্রাণে শৈশব থেকেই

লালন করলেন মর্মে গাঁথা রবীন্দ্রনাথের সেই

প্রিয় গান, আহা! যে গানের বাণী চির অপরূপ :

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-

এ মধুর গান যার মর্মমূলে নিত্য দিবানিশি

বাউলা বাতাস হয়ে বাজে,  কে তাঁকে রুধিতে পারে,

কে তাঁকে থামাতে পারে? কেউ তাকে থামাতে পারে না।

চারণের বেশে তিনি মুক্তির নেশায় ছুটেছেন

এ বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে; গণতন্ত্রে

আস্থা রেখে দরিদ্র কাঙাল আর নিরক্ষর কোটি

মানুষকে ভালোবেসে দুঃসাহসে প্লাবন বিজয়ী

নূহের কিস্তির মতো সেই স্বপ্নজয়ী গৌরবের

নৌকখানি ভাসালেন জনতার হৃদয় সাগরে।

কী উত্তাল সমুদ্রের প্রমত্ত ঢেউয়ের তালে তালে

এলো অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১; সংখ্যা থেকে জন্ম নেয়

আমাদের স্বাধীনতা- বাঙালির মহা ইতিহাস।

হ্যাঁ, তিনি এমন বীর সুদর্শন কবিদের কবি,

যাঁর ডাকে জেগে ওঠে বেহুলার ঘুমন্ত ঘুঙুর-

কী এমন জাদু ছিল মন্ত্র ছিল তাঁর ওই তর্জনীতে?

নদীর ওলান ছেড়ে জলবতী মেঘের ঔরসে

ওই নামে মুখ ঘষে সমুদ্রের জরায়ুমণ্ডল।

তেরশ নদীর জলে ডুবে থাকা বদ্বীপের বুকে

আরো এক নদী ছিল দৃশ্যাতীত বঞ্চনার নদী,

সহস্র বছর ধরে বহে চলা সেই নদীটাকে

কে তিনি থামিয়ে দেন তাঁর ওই স্বপ্নজয়ী ডাকে:

ভাইয়েরা আমার! “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো,

এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ!

একটা দেশের সব মানুষের মুক্তি আনতে,

জানি প্রথমে দরকার একজন অনিবার্য খাঁটি নেতা;

অনিবার্য খাঁটি নেতা ছাড়া সে-দেশের অনিবার্য

স্বাধীনতা কখনো আসে না। তিনিই ছিলেন আমাদের

সেই অনিবার্য একমাত্র নেতা, এ দেশের মুক্তিদাতা।

তিনি আর তাঁর দুর্দিনের সঙ্গী-সহচর ছিল যারা

তারা ছাড়া এ দেশে প্রকৃত নেতা কাউকে দেখি না;

অনেকে রক্তের দামে তিনি দেশটাকে মুক্ত করেছেন।

তিনি কিন্তু এও জানতেন, জন্ম দোষে দুষ্ট অকৃতজ্ঞ

মীর জাফরের বংশধর কতিপয় বেজন্মাকে

মুক্ত করা যায় না কখনো। এ জন্য তিনি তা করেননি;

মুক্ত করবার আগেই দেখা গেল অমানুষ ঘাতকেরা

তাঁর বুকটাকে বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয়;

রক্তে ভাসে সংবিধান ডুকরে কাঁদে বাংলার আকাশ।

তারপর দেখতে দেখতে নতুন নিয়মে শুরু হলো

পুরাতন খেলা; দেশটা ভূতের পায়ে হাঁটতে থাকে-

পেছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় ভূতের গলিতে

অশ্বহীন আস্তাবলে এক সানগ্লাস পরিহিত

অমাবস্যা কালোজামা গায়ে নির্বিকার বসে আছে;

তাকে ঘিরে জমে ওঠে পরাজিত পশুদের হাট,

এ হাটে জলের দামে বিক্রি হয় বেশ্যা ও বিবেক;

সের দরে বিক্রি হলো শহিদের রক্ত আর খুলি।

চারিদিকে অশুভের আস্ফালনে ডাকিনী উল্লাস:

ক্ষেতের ফসল থেকে শুরু করে বসন্তের হাওয়া

হঠাৎ উধাও; এইভাবে একদিন আলো ছাড়া

সূর্য ওঠে ঘড়ির কাঁটায়; চতুর্দিকে মহা রাহু;

চণ্ডালের হাড় থেকে এক ভীতিকর দীর্ঘতর

ছায়া নামে; ছিন্নভিন্ন স্বাধীনতা নর্দমায় ভাসে।

কবিদের কবি তিনি- একটি অমর কবিতার রচয়িতা;

তাঁর সেই কবিতার অমরত্বে আজো

শত চেষ্টা করেও হায়েনাগুলো বসাতে পারেনি

দাঁত: চোখ বন্ধ করে কবি তাই বাতাসের বুকে

কান পেতে শুনতে পায় তাঁকে নিয়ে লেখা শত গান,

হাজার কবিতা: এমন দেশের জন্য গান বাঁধে

হরিনাম জপে, জয় গুরু সকলের প্রিয় অন্ধ

ফকির লালন আর দীন হীন কবি হরিনাথ।

হাড্ডিসাড় কলুর বলদ জীবনের ঘানি টানে;

বধূ চলে গেছে-মধুবনে মধুহীন সর্ষে ক্ষেতে

মৃত প্রজাপতি; যদিও এমন দৃশ্য আজকাল

কোথাও দেখি না আর, তবু বলতেই হবে, বলতে হয়,

বুনো শুয়োরের দল সুযোগের অপেক্ষায় আছে

যে কোনো সময় ওরা তছনছ করে দেবে মার্চের বাগান।

প্রতিপক্ষ অন্ধকার- কে তাড়াবে? আছেন আড়ালে

আমাদের বুকে তিনি একজন নিরন্তর; এ মাটির

প্রতিবর্গ ইঞ্চি জুড়ে দেখো আজ জ্বলছে চিরন্তন

ওই মহামানবের অবিনাশী গৌরবের শিখা;

আমরা করি না ভয়- আমাদের বিজয় উদ্যানে,

মহাকাব্যে আছেন দাঁড়িয়ে কবি, বাঙালির পিতা

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে দুঃসময়ে তিনি

মার্চের আগুন জ্বেলে তাড়াচ্ছেন অশুভের ছায়া।

বাঙালির রত্নগর্ভা বীর প্রসবিনী এই মাটি

যুগে যুগে দেখিয়েছে সুকান্তের কবিতার মতে

এ মাটি দুর্জয় ঘাটি পরাজয় কখনো মানে না;

যতই আসুক ঝড়, বিপরীত বাধা ও বিপত্তি

ডিঙিয়ে বীরের জাতি বিজয়ের সানাই বাজিয়ে

সামনে যাবে- কেউ তাকে কোনোদিন থামাতে পারে না।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024